শূন্য এ বুকে...

.
.

রাজকুমার সিংহ, শ্রীমঙ্গল শহরের স্কুলশিক্ষক, একদিন বাসায় এসে তাঁর লেখা মৈত্রেয়ী নেই, মৈত্রেয়ী আছে বইটি আমাকে দিয়ে যান। পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার বইটি, সযত্নে প্রকাশ করেছে ঢাকার পালক পাবলিশার্স। অধিক বয়স, ক্রনিক রোগের ধকল, তদুপরি চোখে ছানি ইত্যাদি কারণে বই পড়া ইদানীং আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠেছে।
কিন্তু দীর্ঘদিনের অভ্যাসটি ছাড়তে পারি না। ভালো বই কষ্ট হলেও পড়ি। কিছুদিন আগে করুণাময় গোস্বামীর লেখা ভারতভাগের অশ্রুকণা (সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা) তাও পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার, নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের আরেকটি ক্ল্যাসিক, এক-দু পৃষ্ঠা করে অনেক দিনে শেষ করেছি। রাজকুমারের ক্ষেত্রেও অন্যথা ঘটার সুযোগ ছিল না—এতটাই সম্মোহক এই অশ্রুগাথা।
রাজকুমার দক্ষ গণিত শিক্ষক, কট্টর যুক্তিবাদী, বহির্জাগতিক বাস্তবতা সম্পর্কে বেখেয়াল, কোথাও কোনো অসংগতি টের পেলে তুমুল তর্কে ঝাঁপিয়ে পড়েন, স্থান-কাল-পাত্র হিসেবে নেন না, হারজিত দুটোই জোটে। এমন একজন মানুষ যখন ৯ বছরের কন্যার জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান, তখন তিনি যে পদে পদে বিড়ম্বিত ও লাঞ্ছিত হবেন, তা সহজবোধ্য।
আর এসবই এ বইতে আছে লেখকের অনুপুঙ্খ বয়ানে। কিন্তু এহ বাহ্য। কেন্দ্রে রয়েছে কন্যা মৈত্রেয়ী—মুগ্ধকর পবিত্র মুখশ্রী, প্রখর বুদ্ধিমত্তা, হৃদয়ে প্রগাঢ় ভালোবাসা ও মনে অটুট আত্মবিশ্বাস। সে স্বপ্ন দেখে ভালো হয়ে সমুদ্র দেখার, বিমানে উড়ে বাড়ি ফেরার। এই বালিকা মুহূর্তে পাঠককে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে মায়ার বাঁধনে; আত্মজাসম হয়ে ওঠে এবং আমাদের তার সুখ-দুঃখের অনুক্ষণ সঙ্গী হতে বাধ্য করে। বইটি পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে আমি এতটাই কাতর হয়ে পড়েছি যে পাঠ বন্ধ না রেখে পারিনি এবং এই বন্ধের পাকচক্রে অবিরাম আবর্তিত হয়েছি—মৈত্রেয়ী নেই, মৈত্রেয়ী আছে।
এই গ্রন্থ রচনার পটভূমিজুড়ে আছে বহু মর্মান্তিক কাহিনি। ভেলোর পৌঁছে সিংহ-পরিবার নানা অভাবিত সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। ডাক্তার মিললেও হাসপাতালে সিট মেলে না। দিন যায়, রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে, শত অনুনয়-বিনয়ে কেউ কর্ণপাত করে না। রাজকুমার ফাঁকফোকরের আঁচ পান, কিন্তু তাঁর মতো মানুষের পক্ষে সেই সব চোরাই পথের খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয় না। শেষে নিজের চেকআপ করাতে গিয়ে এক ডাক্তারের সাক্ষাৎ মেলে এবং তিনি মৈত্রেয়ীকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন। দৈব ঘটনাই।
এই অভাবিত সৌভাগ্যে সবাই উৎফুল্ল হন। রোগীর ব্রেন টিউমারের বায়োপ্সি যথারীতি সম্পন্ন হয়। সে কিছুদিন ভালো থাকে আর রাজকুমার তখন তাঁর ডায়েরি লিখতে শুরু করেন। কিন্তু এ ছিল প্রকৃতির এক নিষ্ঠুর প্রতারণা। একদিন মৈত্রেয়ী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাকে পরম পরিচর্যা বিভাগে স্থানান্তর করা হয়, কোনো ফলোদয় ঘটে না এবং শেষ পর্যন্ত ডাক্তাররা তার জীবনের আশা ছেড়ে দেন। এমন দুর্দৈব সম্পর্কে রাজকুমারদের কোনো পূর্বধারণা ছিল না। তাঁরা ভাবতেন কন্যা দুসপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে উঠবে এবং সবাই ভারত ভ্রমণ সেরে দেশে ফিরবেন। তাই আঘাতটি ছিল আকস্মিক ও প্রচণ্ড। এই পরিস্থিতিতে রাজকুমার আংশিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, হাসপাতালের বারান্দায় চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন, পাগলের মতো গান গান ও কবিতা আবৃত্তি করে
চলেন, সমাজের যাবতীয় অসংগতিকে ধিক্কার জানাতে থাকেন।
দুঃখী মানুষের এই আস্তানার বাসিন্দারা তাঁর দিকে চেয়ে থাকে, কেউ বা সহানুভূতি জানায়। এসব সান্ত্বনায় রাজকুমারের কোনো ভাবান্তর ঘটে না। তিনি নিষিদ্ধ বিষ শলাকা অর্থাৎ সিগারেট পুড়িয়ে চলেন এবং কোনো কোনো সময় হঠাৎ করেই ডায়েরি লিখতে বসে যান।
অচিরেই ডাক্তাররা রোগীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলেন এবং ছলে-বলে-কৌশলে সম্মতি দিতে তাদের বাধ্য করেন। কোনো বিমানই এই মুমূর্ষু রোগীকে ঠাঁই দিতে চায় না। অগত্যা নার্সসহ একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে তাঁরা কলকাতা রওনা হন এবং চেন্নাইয়ের মহাসড়কে এক অচেনা জায়গায় অন্ধকার রাতে মৈত্রেয়ী প্রবল কাশিতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। ভোরে লাশ নিয়ে কলকাতা পৌঁছে আইন ও আনুষ্ঠানিকতার কুটিল বেড়াজাল পার হতে তাঁদের দুদিন কেটে যায়। একসময় ধ্বস্ত এই পরিবারটি অন্তহীন পথ পাড়ি দিয়ে শ্রীমঙ্গল পৌঁছায়।
দেশে ফিরে রাজকুমার কাহিনিটি আবার লিখতে থাকেন এবং একসময় তাঁর মনে হয় মৈত্রেয়ী যেন তাঁকে বলছে, ‘তোমাকে এত কষ্ট দিচ্ছি কেন, জানো বাবা? এই প্রেক্ষাপটকে পুঁজি করে তুমি তোমার না বলতে পারা কথাগুলো যাতে বিশ্ববাসীকে জানাতে পারো।’ পাঠক, আত্মজাকে লিখিত এ অশ্রুগাথা, বলা বাহুল্য, আমাদের সবার জন্যও। আসুন, আমরা এই শোকার্ত পিতার দুঃসহ মর্মবেদনার শরিক হই, তাঁকে যথাসাধ্য সান্ত্বনা জোগাই।
দ্বিজেন শর্মা: নিসর্গী ও লেখক।