করোনাকালে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ১৮ মাস বন্ধ ছিল। তারপর ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খোলার পর সপ্তাহে এক-দুই দিনের সীমিত শ্রেণি কার্যক্রম হয়েছে। এরপর কী এক আশ্চর্য কারণে মাধ্যমিক স্কুলে তড়িঘড়ি করে নভেম্বরের মধ্যেই কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম সমাপ্ত করা হয়েছে। এতে পুরো ডিসেম্বর মাসই মাধ্যমিক স্কুলগুলো বন্ধ ছিল। এদিক দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা ভাগ্যবান, কারণ তারা বছরের শেষ সময় পর্যন্ত ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছে এবং তাদের ওপর কোনো আলাদা পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হয়নি।
তারপর আবার চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে অমিক্রনের জন্য প্রায় এক মাস স্কুলগুলো বন্ধ ছিল। এ সময় বিশ্বের আর কোথাও স্কুল বন্ধ ছিল কি না আমি জানি না। হয়তো ছিল। যাহোক এখন আমাদের স্কুলগুলো পুরোদমে শুরু হয়েছে। রোজার মধ্যেও স্কুলগুলো খোলা ছিল, যা প্রশংসাযোগ্য।
আমাদের দেশের শিক্ষা কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে গত দুই বছরে আমাদের শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো শিখন-ঘাটতি হয়নি। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন শ্রেণিতে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছে। তারা ভাবছে টেলিভিশন, অ্যাসাইনমেন্ট ও অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের শিখন কার্যক্রম সঠিকভাবে চালাতে পেরেছে। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে বলতে গেলে তেমন কোনো মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ পায়নি। এতে তার অবস্থা কেমন হয়েছে, সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন প্রাথমিক শিক্ষক তুলে ধরেছেন, ‘প্রাথমিকে মাঠপর্যায়ে আমরা যেভাবে পাচ্ছি, তাতে আমরা হতাশ। কীভাবে কী করব, বুঝতে পারছি না। বিশেষ করে গ্রামে পঞ্চম শ্রেণির বাচ্চারা দেখে বাংলাও পড়তে পারছে না।’
এই শিক্ষকের কথাগুলোর প্রতিধ্বনিই করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১০ এপ্রিল প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘শিক্ষায় এ বিরতির প্রভাব সামনাসামনি যা দেখা যাচ্ছে, তার চেয়েও অনেক বেশি ও বড়। কারণ, শিক্ষাব্যবস্থায় এ প্রভাব গোচরীভূত হয় না। কোনো শিক্ষার্থী যদি তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর ১৮ মাস বিদ্যালয়ে না যায়, তার মানে কী দাঁড়ায়? শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর মানে হচ্ছে সেই শিক্ষার্থী এখন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষা শেষ করতে চলেছে। কিন্তু এ সময়ে সেই শিক্ষার্থী প্রকৃতপক্ষে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর স্তরকে সমন্বয় করা হলো না।’ অধ্যাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সতীর্থরা এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনও লিখেছেন, যা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক ও ইউনিসেফ।
এ সমস্যার উত্তরণে অধ্যাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় স্তরভিত্তিক শিখন কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শিশুরা প্রকৃতপক্ষে কোন স্তরে আছে, সেটার প্রতি মনোযোগ দেওয়াটাই হবে এখনকার মূল বিবেচ্য বিষয়। বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টাতে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষিত মা-বাবা এবং যাদের অনলাইন ক্লাস করার সুবিধা ছিল, সম্ভবত তাদের অবস্থা ঠিক আছে। কিন্তু কম সুবিধাপ্রাপ্ত শিশুদের ক্ষেত্রে অবশ্যই অবস্থাটা ভিন্ন।
অথচ বছরের শুরু থেকে আমরা আলাদাভাবে বিষয়টাকে নজর দিতে পারতাম। চলতি শিক্ষাবর্ষের শুরুর দুই মাস বিগত দুই বছরের শিক্ষাক্রমের একটি ক্রাশ কোর্স দিয়ে শুরু হতে পারত। যেকোনো কারিকুলামে শিখনফলগুলো সর্পিলাকারে আবর্তিত হয়। এ কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের গত দুই বছরে বাদ পড়ে যাওয়া শিখনফলগুলো ধরিয়ে দেওয়া যেত। আর বর্তমান শ্রেণির কারিকুলামের অনেক বিষয় থাকে, যেগুলো পূর্ববর্তী শ্রেণির ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে নির্ধারিত অধ্যায় শুরু করার সময় পূর্ববর্তী বিষয়গুলো ধরিয়ে দেওয়া যাবে।
একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। গণিতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভগ্নাংশ। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ভগ্নাংশের ধারণা থেকে এর যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ—সবই চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে শেষ হয়ে যায়। এখন যে শিশুটি ২০২০ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে ছিল, সে এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে চলে এসেছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তাকে কিন্তু আর ভগ্নাংশ শেখানো হবে না। ফলে গণিতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা ছাড়াই তাকে এগিয়ে যেতে হবে এবং প্রতিনিয়ত হোঁচট খেতে হবে। একইভাবে ২০২০ সালের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীকে বীজগণিতে হাতেখড়ি ছাড়াই এখন অষ্টম শ্রেণিতে বীজগাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হবে। কেমন করে পারবে?
শহরাঞ্চলের এবং সম্পন্ন পরিবারের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট, কোচিং ও অনলাইন ক্লাসের সুযোগে এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু সারা দেশের সব ছেলেমেয়ের শিক্ষার মান উন্নীত করতে হলে এ বিষয় নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হবে এবং সেটা এখনই।
এ সমস্যার উত্তরণে অধ্যাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় স্তরভিত্তিক শিখন কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শিশুরা প্রকৃতপক্ষে কোন স্তরে আছে, সেটার প্রতি মনোযোগ দেওয়াটাই হবে এখনকার মূল বিবেচ্য বিষয়। বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টাতে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষিত মা-বাবা এবং যাদের অনলাইন ক্লাস করার সুবিধা ছিল, সম্ভবত তাদের অবস্থা ঠিক আছে। কিন্তু কম সুবিধাপ্রাপ্ত শিশুদের ক্ষেত্রে অবশ্যই অবস্থাটা ভিন্ন। এ মুহূর্তে একই শ্রেণির শিশুদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ স্তরে ভাগ করে শিক্ষা দিতে হবে। মৌলিক ধারণা না হলেও এ ধারণার একটা নিয়মতান্ত্রিক চর্চা এখন প্রয়োজন।’
মুশকিল হচ্ছে, আমাদের দেশে এভাবে একই শ্রেণিতে ভিন্ন ভিন্ন স্তরভিত্তিক শিক্ষাদানের সুযোগ নেই বললেই চলে। সে জন্য গড় মানের চেয়ে কিছুটা নিচে ধরে নিয়ে শ্রেণি শিক্ষা কার্যক্রম সাজানো দরকার। এর পাশাপাশি দুর্বল শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে প্রয়োজনে স্কুল সময় শেষে বাড়তি শিখনফল কার্যক্রম করানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
এই ক্ষেত্রে আবার ঝামেলা হলো, দীর্ঘদিন স্কুলের বাইরে থাকার কারণে ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে শিশুদের স্কুলে মনোযোগ ফিরিয়ে আনাটা সহজ হচ্ছে না। এ জন্য দরকার শিক্ষাকে আনন্দময় করা। খেলার ছলে মূল বিষয়গুলো শিক্ষার্থী যেন শ্রেণিকক্ষেই আয়ত্ত করতে পারে, সেদিকেই বরং নজর দেওয়া যায়।
করোনা মহামারি কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। আর তার কারণে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগও শতবর্ষে একবারই হয়েছে। কাজে এটি শিক্ষায়ও ক্ষত তৈরি করেছে, সেটি সারানোর জন্য নানামুখী বাস্তব পদক্ষেপ প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।
● মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান