প্রতিবছর এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পরদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় কিছু হাস্যোজ্জ্বল তরুণীর বাঁধভাঙা খুশির ছবি আসে। হাতে বিজয়ের প্রতীক আর মুখে যুদ্ধজয়ের খুশি। আর প্রতিবার আমার নিজের জীবনের সেই দিনটির কথা মনে পড়ে যায়। কী প্রচণ্ড উত্তেজনাপূর্ণ একটি দিন ছিল! পরিবার, সমাজ, আত্মীয়, বন্ধু, শিক্ষক, পরিচিত সবার প্রশ্নসূচক দৃষ্টি ছোট একটা বাচ্চার ওপর, পরীক্ষার ফলাফল কী? ফল ভালো হলে প্রশ্নটা পাওয়ার জন্য টেলিফোন ধরা বা বেল বাজলে দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলা খুবই আনন্দের হতো। তবে ফল খারাপ হলে এই প্রশ্নকেই খুব কর্কশ শোনাত।
লেখাপড়া করতে হবে পরীক্ষায় নম্বর বেশি পাওয়ার জন্য। কে কত জানে, তার মূল্যায়ন করা হয় নম্বর দিয়ে। নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত প্রশ্নের উত্তর নির্ধারিত শব্দসংখ্যায় দিতে হবে। সবকিছু এতই নির্ধারিত যে কী লিখব, সেটা ভাবার সময়ও থাকে না। সব উত্তর বাড়ি বসে শিখে আসতে হবে। মোটা মোটা গাইড বইয়ে আছে সব প্রশ্ন ও তার উত্তর। গাইড পড়ে পড়া না বুঝলেই-বা কী? পাড়ায় মানিক স্যারের কোচিং সেন্টারে পড়লে জিপিএ-৫ নিশ্চিত। ক্লাসে? ৮৫ জনের ক্লাসে ১ জন শিক্ষক ৪৫ মিনিটে এক-একটা ক্লাস নেন। তিনি সিলেবাস শেষ করবেন, নাকি সব ছাত্রকে বোঝানোর দায়িত্ব নেবেন!
বাচ্চাদের খাবার খাওয়ানোর সময় যেভাবে ভূতের ভয় দেখানো হয়, শিক্ষার্থীদের সেভাবে ফেল করানোর ভয় দেখিয়ে পড়ানো হয়। আমরা জেনেই বড় হতে থাকি যে পরীক্ষায় অসফল হওয়া জীবনের সবচেয়ে খারাপ একটা ঘটনা। তাই হয়তো প্রতিবছর পাসের খবরের পাশাপাশি পত্রিকার কোনো কোনায় ছোট করে কিছু ছাত্রের জীবনহানির খবরটাও থাকে। কী ভয়াবহ মানসিক চাপ এই খুদে, অপরিপক্ব কাঁধে চাপায় আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা! কই এতগুলো বছরে কাউকে তো দেখলাম না এতগুলো বাচ্চার কাছ থেকে তাদের শৈশব কেড়ে নেওয়ার দায়ে এই পীড়াদায়ক ব্যবস্থাকে আসামি করে মামলা করতে!
আসলে জীবনে অসফলতাই বাস্তব। জীবনে সফল হয়ে গেলে আর এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা কোথায়? এই বাস্তবমুখী শিক্ষাটি কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দিতে পারে না! দিলে হয়তো শিক্ষাজীবনের পরের জীবনের সংগ্রামটার জন্য মানুষ আরেকটু তৈরি থাকত। মূল্যায়ন পদ্ধতির নামে মেলে কিছু সনদ, যা একজন মানবসম্পদ হওয়ার জন্য দক্ষতার মানদণ্ডের স্মারক। ভালো আঁকিয়ে, নাকি খেলোয়াড়, নাকি ভালো লেখক, তাতে কিছু যায়-আসে না। বাজারে এসব দক্ষতার কোনো মূল্য নেই। সবাইকে অঙ্ক-বিজ্ঞানে ভালো হতে হবে।
আমার এক সহকর্মী তাঁর ছেলে ও মেয়েকে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে দিয়ে তাঁর বাচ্চাদের ভবিষ্যৎটা নিশ্চিত করতে পেরে খুবই খুশি। ভালো লেখাপড়ার পাশাপাশি সেই স্কুলে নাকি গিটার, পিয়ানো, নাচ, গান, পারকাসন, বিতর্ক, সাঁতার-সবকিছু শেখার সুব্যবস্থা আছে। আমি তাঁর কথা শুনে ভাবি, এই সুযোগগুলো তো সব বাচ্চার সমানভাবে পাওয়ার কথা।
পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষ নিজস্ব কিছু গুণ বা স্বকীয়তা নিয়ে আসে। সামাজিক জীব হওয়ার ইঁদুরদৌড়ে ছেলেবেলা থেকেই সেই স্বকীয়তাকে তিলে তিলে কতল করে সেই মানুষের মাঝে আরোপিত একজন ‘সামাজিক জীব’ বসানো হয়। আর বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেই আরোপিত একজনকে ঘষেমেজে নিজেদের প্রয়োজনমতো তৈরি করে নেয় পুঁজিবাজারের খোরাক জোটাতে। এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারলাম না! আমরা নিজের দেশের, নিজের মানুষদের বিচার-বুদ্ধি, সৃজনশীল ভাবনা বিকশিত হতে দিই না। হিসাব কষতে জানতে হবে, নিজেকে উচ্চ থেকে উচ্চতর দরে আনতে হবে, শ জনেককে ডিঙিয়ে কাজ পেতে হবে। এখানে আবেগ বা সহানুভূতির কোনো জায়গা নেই। এখানে কেবল দৌড় আর দৌড়। সবাই দৌড়াচ্ছে, আমাকেও ছুটতে হবে, আগে যেতে হবে।
বাজারের এই ইঁদুরদৌড়ের প্রস্তুতি শিক্ষাব্যবস্থাই দিয়ে থাকে। পড়া মুখস্থ করো, এক ঘণ্টায় ১৫ পাতা লেখো। জোরে হাসবে না। মাথা নিচু করো। খেলতে যাবে না, পড়তে বসো। পড়া শেষ, এখন লিখতে বসো। কথা বলবে না, এখন কথা বলো। কিছু ভাবতে পারবে না, পড়া মুখস্থ করো, কাল পরীক্ষা। এ যেন বাগানে বিভিন্ন গাছ কেটেছেঁটে হাতি-ঘোড়া বানানোর মতো অবস্থা। বেচারা গাছটাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করত সে হাতি হতে চায়, নাকি ঘোড়া? নাকি গাছ থাকতেই সে খুশি! তেমনি ছাত্রদেরও নেই নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে বড় হওয়ার স্বাধীনতা। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থা সবাই মিলে তার ভবিষ্যৎ এঁকেছে, তার নিজের স্বপ্ন দেখার অবস্থা নেই। কিংবা সাহসটাই আর নেই হয়তো।
তরুণদের মাঝে হতাশা-স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাস করে দেশে চাকরি নেই। লাখে লাখে গণহারে কেন স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাস করতে হবে! শিক্ষাব্যবস্থা তাদের স্বপ্ন দেখিয়েছে, তাদের জীবনের পরিবর্তন হবে। সবাই যদি লেখাপড়া করে অফিসে বসে কাজ করার স্বপ্ন দেখে, তবে আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান হবে কীভাবে? এসব কাজ, যেখান থেকে আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয়, সেসব কাজে মানুষের অনীহা। দায় সেই শিক্ষাব্যবস্থারই, যেখানে মাটির বুকে সোনার ফসল ফলানোর মতো অলৌকিক ক্ষমতা ও মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার মতো মানবমুখী কাজকে মূল্যায়ন করতে শেখানো হয় না। অন্যের জন্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত করা হয় না। বদলের স্বপ্ন দেখতে শেখানো হয় না মানুষকে, নিজেকে ভালোবাসতে বা নিজেকে বিশ্বাস করা শেখানো হয় না। আমাদের প্রত্যেকের মাঝে, আমাদের চারপাশে এত এত জ্ঞান ছড়ানো আছে, তা দেখতে বা তার থেকে শিক্ষা নিতে শেখানো হয় না। আমরা কৃষকের জ্ঞানকে শ্রদ্ধা করি না, যে বাতাসের গতি আর স্পর্শে বুঝে যায় ঝড়-বৃষ্টির আলামত, যে শুকনো মাটিতে খাদ্যশস্য ফলাতে জানে। আমরা শ্রদ্ধা করি না মাঝির দুঃসাহসকে, যে উত্তাল সমুদ্রের বুকে রাতের আঁধারে জীবন বাজি রেখে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। রাস্তায় আমরা আমাদের রাগ ঝাড়ি সেই সব ভয়াবহ কায়িক শ্রম দেওয়া রিকশাওলার ওপর, যাঁরা নিজের গতরের শক্তি দিয়ে আমাদের যাতায়াতে সাহায্য করেন।
আমরা সময় দিই না আমাদের বাচ্চাদের। সময়ের অভাব পূরণ করি যা চায় তা-ই মেনে নিয়ে। ধৈর্য ধরে না বুঝিয়ে, কথা বা বায়না বন্ধ করি হাতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দিয়ে। নিজেদের স্বপ্ন তাদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তাদের স্কুলে পাঠাই একের পর এক মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য। ফলাফল খারাপ হলে প্রশ্ন করি না নিজেকে, আমার সন্তান কেন খারাপ করছে? আমি কি তাকে কোথাও বুঝতে ভুল করছি? ভাবি না আমার সন্তান কী চায়, কীভাবে চায়। বরং বারবার তার সব ডালপালা কেটে দিয়ে তাকে আমাদের সেই চিরাচরিত ছাঁচের মাঝে ফেলি। বাংলাদেশ একটি তরুণ রাষ্ট্র। মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ ৫৪ বছর বয়সের নিচে। এই বিপুল জনগণ দেশের অপার সম্ভাবনা, যাদের হাতেই আগামী দিন নির্ভর করছে। শুধু শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার এনে, বাজারমুখী শিক্ষার বদলে উন্নয়নমুখী শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি শিশুকে যদি কেবল একজন সামাজিক জীব নয়, বরং মানুষ হতে শেখানো হয়, প্রত্যেকের স্বকীয়তা বাঁচিয়ে রেখে যদি তার মেধার বহিঃপ্রকাশ করতে দেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের পায়ের নিচে থাকবে পুরো মহাবিশ্ব।
আইরিন খান: লেখক ও গবেষক
khan. ayreen@gmail. com