বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জাতীয় শিক্ষাক্রমের তিনটি আবর্তন সম্পূর্ণ হয়েছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল (এম এ) জব্বার সব কটি আবর্তনের শিক্ষাক্রম তৈরি ও পরিমার্জনে নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশের শিক্ষাক্রমের গুরু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। অধ্যাপক জব্বার ১৯৩১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রায় ৮৫ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তাঁর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
এম এ জব্বার ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন (১৯৪৭) এবং ইন্টারমিডিয়েট (১৯৪৯) পাস করে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিষয়ে বিএসসি অনার্স (১৯৫২) ও এমএসসি (১৯৫৩) পাস করেন। শিক্ষাবিজ্ঞানের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থাকায় ১৯৫৬ সালে বিটি (ব্যাচেলর অব টিচিং) ট্রেনিং কোর্স করে এম এ জব্বার যুক্তরাষ্ট্রের নর্দার্ন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন (১৯৬১)।
যশোর এম এম কলেজের প্রভাষক পদে ১৯৫৪ সালে কর্মজীবন শুরু করলেও এম এ জব্বারের পছন্দের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Institute of Education and Research–এ (IER) প্রভাষক হিসেবে। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা পরামর্শক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে তাঁকে বাংলাদেশের শিক্ষা বিভাগে উপপরামর্শক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি (১৯৭৬) গঠিত হলে অধ্যাপক জব্বার এ কমিটির পরিচালক ও সদস্যসচিব পদে নিযুক্ত হন। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রথমে অধ্যাপক শামসুল হক, পরে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। কমিটির দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে অধ্যাপক জব্বার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের কাজের নেতৃত্ব দেন।
স্বাধীন দেশের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা ও পরিমার্জনের জন্য ন্যাশনাল কারিক্যুলাম ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (এনসিডিসি) প্রতিষ্ঠিত হলে (১৯৮১) অধ্যাপক জব্বার এর পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে এনসিডিসি বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডের সঙ্গে একীভূত হয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (National Curriculum and Textbook Board–NCTB) রূপ নেয়। এনসিটিবিতে অধ্যাপক এম এ জব্বার প্রথম সদস্য (শিক্ষাক্রম) নিযুক্ত হলেন ১৯৮৪ সালেই। তিনি এই পদে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অধ্যাপক জব্বার ১৯৮৭ সালে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল অ্যাডমিনেস্ট্রেশন, এক্সটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ (NIEAER)-এর পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) নিযুক্ত হন। এই পদেই তাঁর সরকারি চাকরি শেষ হয় (১৯৮৮)। ১৯৯২ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম সংক্ষিপ্ত করে ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট (নায়েম) রাখা হয়।
নায়েমের পরিচালক হিসেবে সক্রিয় কর্মজীবন শেষ হলেও অধ্যাপক জব্বার আজীবন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত থেকেছেন। বাংলাদেশ শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের দ্বিতীয় আবর্তন প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চলেছে। শিক্ষাক্রম পুনর্বিন্যাসের (Curriculum Reform) এ পর্যায়ে অধ্যাপক জব্বার শিক্ষাক্রম রিপোর্ট প্রণয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে শিক্ষাক্রমের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণীত হলে এর আলোকে শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের পরিকল্পনাও অধ্যাপক এম এ জব্বারের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়েই গৃহীত হয়। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে ২০১১-১২ সালে দেশের শিক্ষাক্রম তৃতীয়বার পরিমার্জিত হয়। এই পরিমার্জন প্রক্রিয়ায় জাতীয় পরামর্শকের দায়িত্বে ছিলেন আইইআরের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান। শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের এই সব৴শেষ ধাপেও অধ্যাপক জব্বার শিক্ষাক্রমের কারিগরি (বিষয়ভিত্তিক) কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন।
১৫ জানুয়ারি ২০১৬ এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের আগের দিন পর্যন্ত অধ্যাপক জব্বার নিজেকে শিক্ষাক্রমের প্রতি নিবেদিত রেখেছেন। ১৪ জানুয়ারি এনসিটিবিতে অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমানের একটি শিক্ষাক্রম সভা ছিল। ওই সভায় অধ্যাপক জব্বার আমন্ত্রিত ছিলেন না; তথাপি শিক্ষাক্রমের এই নিবেদিতপ্রাণ গুরু হৃদয়ের টানে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। অসুস্থ বোধ করলে সভা থেকেই তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং তিনি আর জীবিত ঘরে ফেরেননি। অধ্যাপক জব্বারের পরিণত বয়সের কর্মজীবন কেটেছে এনসিটিবি ও নায়েমে। বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের প্রয়াত এই গুরুকে সম্মান জানিয়ে এনসিটিবি বা নায়েমের অন্তত একটি গ্রন্থাগার তাঁর নামে উৎসর্গ করার জন্য আমি গত দুই বছর লেখার মাধ্যমে অনুরোধ করে আসছিলাম। গত ডিসেম্বর মাসে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ এর গ্রন্থাগার-সংলগ্ন অংশকে একটি মিলনায়তনে রূপদান করে এটির নাম দিয়েছে ‘মুহাম্মদ আবদুল জব্বার মিলনায়তন’। দেরিতে হলেও এনসিটিবি দেশের শিক্ষাক্রমের এই পথিকৃৎকে সম্মান জানিয়ে জাতীয় কর্তব্য পালন করল।
বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষাক্রমের প্রায় ১ হাজার ৫০০ কপি নিয়ে অধ্যাপক জব্বার এনসিটিবিতে বসে শিক্ষাক্রমের কাজ শুরু করেছিলেন। দুঃখজনক হচ্ছে শিক্ষাক্রমের এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি দলিলের শুধু দ্বিতীয় খণ্ড (নিম্নমাধ্যমিক) এবং তৃতীয় খণ্ডের (মাধ্যমিক) একটি করে কপি আছে, বাকি সব উধাও হয়ে গেছে! বাকি কপিগুলো জোগাড় করে কম্পোজ করে বোর্ডের ওয়েবসাইটে আপলোড করা দরকার। এভাবে বোর্ড কর্তৃপক্ষ শিক্ষাক্রম গবেষক ও ব্যবহারবিদদের জন্য এই জাতীয় দলিলগুলো উন্মুক্ত করতে পারে।
আরও একটি বিষয় এখানে জরুরিভাবে উল্লেখ্য। এনসিটিবি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও পরিমার্জনের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। দেশের শিক্ষাক্রম প্রক্রিয়া দেখভাল করার প্রধান দায়িত্ব পালন করেন প্রতিষ্ঠানটির দুজন সদস্য (যথাক্রমে সদস্য, মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম এবং সদস্য, প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) এবং তাঁদের দুই উইংয়ের কর্মকর্তারা। কিন্তু শিক্ষাক্রম জানা-বোঝা সদস্য (শিক্ষাক্রম) ছিলেন শুধু অধ্যাপক জব্বার এবং পরে অধ্যাপক মুহম্মদ আলী। ১৯৮৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিগত প্রায় ৩৫ বছরের মধ্যে মাত্র বছর সাতেক এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) ছিলেন শিক্ষাক্রম বোদ্ধা ওই দুজন অধ্যাপক। বাকি প্রায় ২৮ বছর ধরে এনসিটিবির সদস্যের (শিক্ষাক্রম) দায়িত্ব পালন করছেন যেকোনো বিষয়ের একজন কলেজ অধ্যাপক।
নতুন শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় শিক্ষাক্রম বিষয়টিকে যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন আশা করি।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা শিক্ষাক্রম গবেষক এবং সদস্য, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার