বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত ফ্যাক্ট শিট ‘করপোরাল পানিশমেন্ট অ্যান্ড হেলথ’ (নভেম্বর ২০২১) শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণার সারাংশ তুলে ধরেছে। এ শাস্তির অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। শারীরিক শাস্তি বলতে এমন শাস্তিকে বোঝায়, যেখানে কোনো না কোনো মাত্রার ব্যথা বা অস্বস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে শারীরিক বল প্রয়োগ করা হয়। নিষ্ঠুর ও অবমাননাকর আচরণ এ ধরনের শাস্তির অন্তর্ভুক্ত। শাস্তি শিশুর নির্যাতন ও অমর্যাদাকর আচরণ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারের লঙ্ঘন।
ফ্যাক্ট শিট অনুযায়ী, অসংখ্য গবেষণায় শিশুর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে শাস্তির সঙ্গে বেশ কিছু নেতিবাচক বিষয়ের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক প্রমাণিত হয়েছে। এগুলো হলো শারীরিক ক্ষতি; দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবন্ধিতা বা মৃত্যু; ক্যানসার, মাইগ্রেন, হৃদ্যন্ত্রের রোগ, আর্থ্রাইটিস এবং ওজন বেড়ে যাওয়া; মানসিক অসুস্থতা, যার মধ্যে আছে আচরণগত ও উদ্বেগসংক্রান্ত ডিজঅর্ডার, বিষণ্নতা, হতাশা, নিজের ক্ষতি করা এবং আত্মহত্যার চেষ্টা; অ্যালকোহল ও মাদকাসক্তি; আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও দ্বন্দ্ব নিরসনে দক্ষতার ঘাটতি; বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া এবং শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে কম সফল হওয়া; শিশুদের মধ্যে আগ্রাসী আচরণ; অপরাধপ্রবণতা; অন্যান্য ধরনের সহিংসতা মেনে নেওয়া; পারিবারিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি।
শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে বৈশ্বিক সহযোগিতা (গ্লোবাল পার্টনারশিপ টু এন্ড ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট চিলড্রেন) প্রকাশিত ‘করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন: সামারি অব রিসার্চ অন ইটস ইম্প্যাক্ট অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনস’ (অক্টোবর ২০২১) জানাচ্ছে যে ৩০০টির বেশি গবেষণা শাস্তির সঙ্গে অসংখ্য নেতিবাচক ফলের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করেছে। কোনো গবেষণায় শাস্তির কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে কবীর সুমনের গান মনে পড়ে, ‘কত হাজার মরলে পরে মানবে তুমি শেষে/ বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে।’ আর কত গবেষণা হলে বড়রা শিশুদের শাস্তি অবসানের গুরুত্ব বুঝবেন?
বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে ২০১১ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিদ্যালয়ে শাস্তি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তা ছাড়া বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে শিশুদের শাস্তি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ অনুযায়ী বাংলাদেশের ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৮৯ শতাংশ শিশু জরিপ-পূর্ববর্তী এক মাসের মধ্যে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। শতকরা ৩৫ ভাগ মা-বাবা জানিয়েছেন যে শিশুদের শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন আছে।
শিশুদের কিছু শেখানোর কৌশল হিসেবে শাস্তি একটি অকার্যকর পদ্ধতি। শিশুদের বড় করার জন্য তাদের ভালোবাসা এবং বয়স অনুযায়ী নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। পর্দায় রেহানাকেও আমরা দেখি, শাস্তি দেওয়ার বদলে এমন কিছু শেখানো না, যাতে মেয়ে বুঝতে পারে কেন একটি আচরণ করা যাবে অথবা যাবে না।
রেহানা মরিময় নূর চলচ্চিত্রটি দেখতে গিয়ে আমরা এক শিক্ষক মাকে পেলাম, যিনি তাঁর শিশুসন্তানের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করছেন। এক ছাত্রীর যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে শিক্ষক রেহানার প্রতিবাদ এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার লড়াইকে ঘিরেই কাহিনি আবর্তিত। উচ্চশিক্ষিত, পেশাগতভাবে সফল, অন্যদের প্রতি সংবেদনশীল চরিত্রটি নিষ্ঠুরতার সঙ্গে নিজের মেয়েকে বারবার শাস্তি দেন। এমন শাস্তি, শিশু, পরিবার ও সমাজের ভীষণ ক্ষতি করলেও আমরা শিশুদের শাস্তি দিচ্ছি এবং তা মেনে নিচ্ছি। এই আচরণ সমাজে শিশুর অধস্তন অবস্থা তুলে ধরে। রেহানা একবার মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসা দেন, আবার কিছুক্ষণ পরই শিশুটি তাঁর দ্বারাই শাস্তির শিকার হয়। সমাজে কোনো কোনো মা-বাবার ক্ষেত্রে আমরা এমনটিই দেখতে পাই। এতে একটি শিশু সারা জীবনের জন্য ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে নির্যাতনকে স্বাভাবিক মনে করতে শেখে। বড় হয়ে তার সহিংস আচরণ করার ও সহিংসতার শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি। শিশুদের শাস্তির অবসান না হলে সমাজ সহিংসতার চক্র থেকে মুক্ত হতে পারবে না।
শিশুদের কিছু শেখানোর কৌশল হিসেবে শাস্তি একটি অকার্যকর পদ্ধতি। শিশুদের বড় করার জন্য তাদের ভালোবাসা এবং বয়স অনুযায়ী নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। পর্দায় রেহানাকেও আমরা দেখি, শাস্তি দেওয়ার বদলে এমন কিছু শেখানো না, যাতে মেয়ে বুঝতে পারে কেন একটি আচরণ করা যাবে অথবা যাবে না। তাহলে ভবিষ্যতেও একই ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়া এড়ানো যায়। বেশির ভাগ সময়ই শাস্তির ঘটনা ঘটে বড়দের ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনের হতাশা থেকে। এসব কারণ দেখিয়ে অনেকে শাস্তির পক্ষে অজুহাত দেন। মা-বাবা, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহায়তার প্রয়োজন আছে। কিন্তু কোনো কারণেই শিশুদের শাস্তিকে মেনে নেওয়া যায় না।
বিশ্বের ৬৩টি দেশ সব ক্ষেত্রে শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশের শিশুসহ বিশ্বের ৮৭ শতাংশ শিশু আইন দ্বারা শাস্তি থেকে সুরক্ষিত নয়। শাস্তি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রকোপ কমতে থাকে। আইন প্রণয়নের ফলে সুইডেন, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, রোমানিয়ায় শাস্তির গ্রহণযোগ্যতা কমেছে।
শাস্তির অবসান হলে তা শিশুদের বিকাশ, শিক্ষা ও কল্যাণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এবং গার্হস্থ্য সহিংসতা হ্রাস ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সহায়তা করবে। ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশু নির্যাতন অবসানে বিশ্বকে যদি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ১৬.২ (শিশুদের ওপর অত্যাচার, শোষণ, পাচার এবং সব ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ করা) পূরণ করতে হয়, তবে শাস্তি বিলোপ অপরিহার্য। এ জন্য বাংলাদেশে যা করা প্রয়োজন তা হলো:
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধসংক্রান্ত সরকারি পরিপত্রের বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সব ক্ষেত্রে (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যাকেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। নীতিমালা, কর্মসূচি ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে আইনি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা এবং এর বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে কি না, তা তদারক করা প্রয়োজন।
শাস্তি না দিয়ে ইতিবাচকভাবে শিশুদের বড় করা ও শিক্ষাদান সম্পর্কে মা-বাবা, অভিভাবক ও শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। পরিবার ও শিশুদের নিয়ে স্বাস্থ্য, সমাজসেবাসহ বিভিন্ন খাতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলোতে এ-সংক্রান্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা কি শিশু নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে দেশটাকে শিশুদের জন্য আরও বাসযোগ্য করার অঙ্গীকার করতে পারি না?
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী