শারমিন আর দেশ - মিলেমিশে একাকার
সব চোখ এখন ব্যালট বাক্সে। একটা নির্বাচন হবে দেশে। তাই ঘুম নেই। সমীকরণ থেকে সমীকরণে ঘুরছে সবার চোখ। এ দেশ অমৃতবচনের। এ দেশ ডিগবাজিরও। নির্বাচন মানে দুইয়েরই উৎসব। সকালের উন্নয়ন–আলাপ, বিকেলেই পাল্টে যাচ্ছে বয়ান। ভিশনের (ভীষণ নয়) শেষ নেই। স্রোত বইছে যেন। এ স্রোত ভাসিয়ে নিচ্ছে সবাইকে। কারও কোথাও তাকানোর ফুরসত নেই একেবারে। গোপীবাগে রেললাইন ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় যে মেয়েটি বঁটির আঘাতে মরে গেল, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের বিতণ্ডায় অনুক্ত থেকে যায় সে। তাকে নিয়ে ভাবার, বলার কেউ নেই।
শারমিন আক্তার নামের মেয়েটি হেঁটে যাচ্ছিল রেললাইনের পাশ দিয়ে। অসতর্ক ছিল না সে। কোনো দ্রুতগামী ট্রেন তার মৃত্যুর কারণ নয়। তাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করেছে তথাকথিত প্রেমার্থী এক তরুণ। সোহেল নাম, তার একটাই পরিচয় জানা গেছে; বখাটে। এই পরিচয়ের আগে বা পরে কিছু নেই। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনায় অপরাধীর গায়ে সেঁটে দেওয়ার জন্য এ এক মোক্ষম শব্দ, যার কোনো ব্যাখ্যা লাগে না। ঘটনা নিরপেক্ষভাবে এই অভিধার কোনো মীমাংসাও কাউকে কখনো করতে দেখা যায়নি।
শারমিনের এসএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল আগামী বছর। আর মাত্র কয়েক মাস বাকি ছিল। তার হয়তো হাজারটা স্বপ্ন ছিল এ নিয়ে। সোহেলের দিকেও তাকাতে হয়। তারও নিশ্চয় স্বপ্ন ছিল। নাকি একরকম স্বপ্নহীনতাই তাকে তথাকথিত বখাটেতে পরিণত করেছে? এ প্রশ্নের মীমাংসা সমাজবিজ্ঞানীদের আওতাধীন। সাদা চোখে সোহেল একজন তরুণ, যার বয়স ২৫–এর কোঠায়। আর ১৬ বছরের শারমিনের স্বপ্নগুলো হয়তো তখনো আকার পায়নি। কিন্তু দুজনেরই পরিণতি টেনে দিল একটি ঘটনা, যেখানে একজন শিকার, আরেকজন হননকারীতে পরিণত হলো। অথচ সোহেল নাকি প্রেমে পড়েছিল শারমিনের। তাকে পেতে চাইত সে। সংবাদমাধ্যমে শারমিনের ভাইয়ের যে বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে, তাতে সোহেল অন্য কারও সঙ্গে শারমিনকে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার বক্তব্য ছিল, ‘আমার না হলে সে অন্য কারও হতে পারবে না।’ শারমিনের প্রত্যাখ্যানে সোহেল নিজের দিকে তাকায়নি। এমন কোনো প্রস্তুতিও তার ছিল না। এই একটি কথা, এই একটি মনোভঙ্গিই চিন্তিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
সোহেলের এই মনোভঙ্গি অনেকটা কি আমাদের তথাকথিত স্বঘোষিত দেশপ্রেমীদের সঙ্গে মিলে যায় না, যারা ভাবে ‘দেশকে আমিই সবচেয়ে ভালোবাসি’, তাই এর মঙ্গল–অমঙ্গল ভাবনার একমাত্র এখতিয়ার আমার। এই স্বঘোষিত প্রেমিকেরা ভাবে, দেশ ও জাতির মঙ্গল করার সোল এজেন্ট তারাই। এই ভাবনার বিপদ হচ্ছে, এটি জেঁকে বসতে বসতে একসময় অন্ধ হয়ে যায়। একসময় নিজেকে ছাড়া সে আর কিছুকে দেখতে পায় না। অন্য কারও মত ও পথের প্রতি তার সম্মানবোধ কমতে থাকে, যা একসময় অসহনশীলতায় পরিণত হয়। শীর্ষ স্থানটি ছাড়া আর সবকিছুই তখন তার কাছে অনুল্লেখযোগ্য মনে হয়। এরা নিজের দেশপ্রেমের নানা উদাহরণ সামনে টেনে অবিরাম স্তুতি চায়। চায় মানুষ শুধু তার কথাই বলুক। এটা একধরনের অসুস্থতা। এই অসুস্থতা মানুষকে দেয় একধরনের নিপীড়ক চরিত্র। পীড়ন বা নির্যাতন স্পৃহার মূলে রয়েছে এই অসুস্থতাজনিত মনস্তত্ত্বই। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই অসুস্থতাই এখন বাংলাদেশের একমাত্র সত্যে পরিণত হয়েছে।
সামনে নির্বাচন। আর একে উপলক্ষ করে মানুষ এক দারুণ বায়োস্কোপে ঢুকে পড়েছে। সেখানে নানা ধরনের খেলা চলছে। অভিনেতারা আসছেন, বলছেন, ফুঁসছেন, হাসছেন, ঝাড়ছেন এবং কাঁদছেনও। দুই জোটের এক অনিঃশেষ লীলায় ঢুকে পড়েছে দেশ। অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ইত্যাকার নানা শব্দের স্রোতে পড়ে নির্বিরোধী সাধারণ মানুষ সব মেনে নিয়েছে এক অমোঘ সম্মোহনে। মানুষ এখন নির্বাচন খাচ্ছে, নির্বাচনে ঘুমাচ্ছে। এই একটি বিষয়ের কাছে আর সবই পরাজিত যেন। জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনে যে নারী খেলোয়াড় নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক হাসপাতালকে গন্তব্য বানিয়েছে, তাকে নিয়ে ভাবার কেউ নেই। এমনকি ক্রীড়াসংশ্লিষ্টদের কাছেও এটি একটি নিছক খবর হয়েই থাকছে। থাকতে পারছে। কারণ নির্বাচন। কারণ ক্ষমতার সমীকরণ। এই সমীকরণ এতই প্রভাবশালী যে তা অজস্র মৃত্যুকে ঢেকে দিতে পারছে, অসংখ্য দুর্ঘটনাকে আস্তিনে লুকিয়ে বিস্তৃত হাসি হাসতে পারছে। অথচ এই একমুখী দৃষ্টিই হচ্ছে সেই অসুখ, যা তথাকথিত বখাটের নির্মাণ করছে, যা কোনো ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। কে না জানে জনগণ যেমন রাষ্ট্র নির্মাণ করে, রাষ্ট্রও তেমনি জনগণকে নির্মাণ করে।
একটা গণতান্ত্রিক দেশের জন্য নির্বাচন নিশ্চয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে মানুষ ভাববে, আলোচনা করবে এবং শেষ পর্যন্ত ভোটের দিন নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার চেষ্টা করবে—এটাই কাঙ্ক্ষিত এবং স্বাভাবিক। এসব নিয়ে একটা উত্তেজনা থাকাটাও স্বাভাবিক। কিন্তু এই উত্তেজনা কপাল কুঞ্চিত করে তখনই, যখন এটি আর সবকিছু ফেলে রেখে শুধু মার্কাকেই সামনে আনে। কোনো ইশতেহার, কোনো আদর্শ ও তা নিয়ে বিতর্কের বালাই নেই। অর্জন ও ব্যর্থতার কোনো সালতামামি নেই। সবাই বলছে, ‘আমিই একমাত্র দেশপ্রেমিক, তাই ক্ষমতায় আমারই থাকা বা যাওয়া উচিত।’ এখানেই থামছে না, আকারে–প্রকারে বুঝিয়ে দিচ্ছে, এ জন্য অনেক কিছু করতে তারা প্রস্তুত। অনেকটা শারমিনের হন্তারক সোহেলের মতো। এই যখন প্রবণতা, তখন স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠে, এই বাংলাদেশে প্রেম কী করে এতটা একচেটিয়াপনা, এতটা কট্টর, এতটা নির্যাতনস্পৃহা একসঙ্গে ধারণ করল?
প্রেমাকুল প্রেমাস্পদকে পেতে চাইবেই। না পেলে তার পীড়া হবে, ক্ষরণ হবে। শরৎচন্দ্রের দেবদাসের মতো প্রেমাকুল সত্তা এমনকি নিজেকে নিঃশেষ করার মতো কিছুও করতে পারে, যদিও তা কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু সে কখনো তার প্রেমাস্পদকে আঘাত করবে না। অথচ এই এখানে এখন এমনটাই দেখা যাচ্ছে। কি দেশ, কি সমাজ, কি প্রতিষ্ঠান—সব ক্ষেত্রেই এই একই বাস্তবতা। ক্ষমতায় যেতে যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত দলগুলো। একইভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতেও যেকোনো কিছু করতে চায় ক্ষমতাধারীরা। বাম জোটকে বাদ দিলে দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়ন তালিকা দেখলে অন্তত এ ক্ষেত্রে আর কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। অথচ সবাই দেশটাকে ভীষণ ভালোবাসে! ভালোবেসে তারা পেতে চায়। আর পেতে চায় বলেই তারা যথেচ্ছাচারে উদ্ধত। রাজনীতির ময়দানের এই উদ্ধত একচেটিয়া মনোভঙ্গিই এখন সমাজের সব স্তরে ছড়িয়ে আছে, যা জন্ম দিচ্ছে বখাটে ও তার নিরাপত্তার সম্বন্ধ। আর এই দুইয়ের মাঝে ঘুরপাক খাওয়াটাকেই একমাত্র নিয়তি মনে করে কোটি মানুষ চোখ রেখে বসে আছে সেই পুরোনো বায়োস্কোপে, যেখানে দর্শক পরিচয় ছাড়া আমাদের আর কোনো পরিচয় নেই যেন। অথচ প্রথম বিচারে জনগণই নাকি রাষ্ট্রের নির্মাতা।
রাষ্ট্র মানে তো কাঠামো, যেখানে শাসনব্যবস্থা ও পরম্পরা থাকে, থাকে ব্যক্তি থেকে সমাজ ও তাতে প্রোথিত সংস্কৃতি। সংস্কৃতির অভিমুখ তো দ্বিমুখী। এটি নিচ থেকে যেমন নির্মিত হয়, তেমনি ওপর থেকেও আরোপিত হয়। নির্মাণের দায়িত্বটি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে বলেই আরোপণ চেপে বসছে মানুষের ওপর, যে আরোপণের শিকার হয়ে শারমিন ও সোহেল নিজেদের স্বপ্ন হারিয়ে ফেলে একজন পরিণত হচ্ছে হন্তারকে, আরেকজন ভুক্তভোগীতে, জন্ম দিচ্ছে প্রেমেরও নৃশংস হয়ে ওঠার এক উদাহরণের। অথচ দর্শকের আসন ছেড়ে নির্মাণের দায়িত্বটি বুঝে নিয়ে ব্যবস্থার চোখে চোখ রেখে জরুরি প্রশ্নগুলো করতে পারলেই এই আরোপণ উবে যাওয়ার কথা। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে দৃশ্যমান একচেটিয়াপনা রুখতে হলে নিজেদের এই নির্মাতা সত্তাকে স্বীকার করে তার দিকে ফেরা ছাড়া আর কোনো বিকল্প তো জনগণের সামনে নেই।
ফজলুল কবির: সহসম্পাদক, প্রথম আলো