সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সন্তান হিসেবে লন্ডনের রাস্তায় শৈশবে আমাকে বহুবার বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতে হয়েছে। নানাজন নানা কথা বলেছে। সবচেয়ে অপমানকর যে কথাটি আমাকে শুনতে হয়েছে সেটি হলো, ‘যে দেশ থেকে এসেছ, সে দেশে চলে যাও।’ এই অপমানের ঝাঁজ আমার ভেতর থেকে মুছে যায়নি। কারণ, এই শহরেই আমি জন্মেছি, এই শহরেই আমি আমার সন্তানের জন্ম দিয়েছি। আজ বহু বছর পর আমার শৈশবে শোনা সেই অপমানজনক কথা এই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে।
সিরিয়ায় আইএসের সঙ্গে যোগ দিয়ে ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্য সরকার শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব বাতিল করার পর যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে তা হলো, জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মতোই ব্রিটিশ সরকার তার কিছু নাগরিককে অন্য নাগরিকদের চেয়ে একটু বেশি ‘ব্রিটিশ’ বলে মনে করে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির নাগরিকত্ব শুধু তখনই বাতিল করা যাবে, যখন সেই নাগরিকত্ব বাতিল ব্যক্তিকে রাষ্ট্রহীন করে না।
২০১৫ সালে শামীমা যখন পূর্ব লন্ডন ছেড়ে সিরিয়ায় যান, তখন তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। তাঁর কস্মিনকালেও দ্বিতীয় কোনো দেশের নাগরিকত্ব ছিল না। যুক্তরাজ্য এই অবস্থায় তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করেছে এবং এর ফলে তিনি রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত হয়েছেন। ফলে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিলকে তর্কাতীতভাবে অবৈধ বলা যায়।
কূটাভাষ হলো, যুক্তরাজ্যের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ নিজে একজন অভিবাসী বংশোদ্ভূত হয়েও শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব বাতিলের পক্ষে সাফাই দিয়ে বলেছেন, শামীমা তাঁর বাবা-মায়ের দেশ বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারেন। জাভিদ ভালো করেই জানেন, শামীমা বেগম কখনোই বাংলাদেশে যাননি এবং তাঁর বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেই। এরপরও তিনি শামীমার বাংলাদেশে যাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন।
তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, শামীমা বাংলাদেশি নাগরিক নন। তিনি জন্মগতভাবে ব্রিটিশ নাগরিক এবং তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য কখনো আবেদনও করেননি। সে কারণে তাঁকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। জাভিদ তাঁর বিতর্কিত সিদ্ধান্তের সাফাই দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘নিরাপত্তার কারণে’ শামীমার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে।
গত কয়েক বছরে শত শত সাবেক আইএস যোদ্ধা এবং আইএস সমর্থক যুক্তরাজ্যে গেছেন। তাঁদের বিষয়ে সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, শামীমার বিষয়েও একই পদক্ষেপ নেওয়া যেত। কিন্তু শামীমার ক্ষেত্রে তা নেওয়া হয়নি। এর পেছনে তাঁর অভিবাসী পরিচয় এবং তাঁর অশ্বেতাঙ্গ গাত্রবর্ণ কাজ করেছে বলে ধারণা করা যায়। শামীমার বাবা-মায়ের জন্মস্থান ও তাঁর গাত্রবর্ণের বিষয়টি যে দ্রুততার সঙ্গে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিলে কাজ করেছে, তা জ্যাক লেটস ওরফে ‘জিহাদি জ্যাক’-এর সঙ্গে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের অপেক্ষাকৃত নমনীয় আচরণ দেখে আন্দাজ করা যায়। জিহাদি জ্যাকের জন্ম অক্সফোর্ডে। তাঁর মা-বাবা কানাডিয়ান শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান। জ্যাক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সিরিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি আইএসে যোগ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। তাঁর শুধু ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকলেও তাঁর বাবার সুবাদে তিনি কানাডার নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য। জাভিদ তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করেন ২০১৯ সালের শেষে।
গত কয়েক বছরে শত শত সাবেক আইএস যোদ্ধা এবং আইএস সমর্থক যুক্তরাজ্যে গেছেন। তাঁদের বিষয়ে সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, শামীমার বিষয়েও একই পদক্ষেপ নেওয়া যেত। কিন্তু শামীমার ক্ষেত্রে তা নেওয়া হয়নি। এর পেছনে তাঁর অভিবাসী পরিচয় এবং তাঁর অশ্বেতাঙ্গ গাত্রবর্ণ কাজ করেছে বলে ধারণা করা যায়।
জ্যাক ও শামীমার বিষয় প্রায় একই ধরনের। কিন্তু জ্যাকের তুলনায় শামীমাকে নিয়ে বিশ্বগণমাধ্যমে হইচই হয়েছে অনেক বেশি। শামীমার এক বছর আগে ২০১৪ সালে জ্যাক সিরিয়ায় যান। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে শামীমা বেগম সিরিয়ার শরণার্থীশিবির থেকে একটি টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পরদিনই তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। আর জ্যাকের নাগরিকত্ব বাতিলে সময় নেওয়া হয়েছিল পুরো ছয় মাস। শামীমার বিষয়ে জাভিদের সিদ্ধান্ত নিতে এক দিন লেগেছিল আর জ্যাকের বিষয়ে লেগেছিল ছয় মাস।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আইনজ্ঞ ও ‘জাস্টিস অন ট্রায়াল’ গ্রন্থের রচয়িতা ক্রিস ডো মনে করেন, শামীমার নাগরিকত্ব বাতিল করার বিষয়ে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি কাজ করেছে। শামীমার সাক্ষাৎকার টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ায় এবং সে সাক্ষাৎকারে তাঁকে অনুতপ্ত মনে না হওয়ায় যুক্তরাজ্যের নাগরিকেরা তাঁকে নেতিবাচকভাবে নিয়েছিল। সেদিকে নজর রেখেই সাজিদ জাভিদ হুট করে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন। অর্থাৎ, এ বিষয়ে আইনের চেয়ে রাজনীতির দিকেই বেশি খেয়াল রেখেছিলেন তিনি। ক্রিস ডো বলেছেন, মাত্র ১৫ বছর বয়সী একটা মেয়েকে অনলাইনে মগজ ধোলাই করা হয়েছিল। তাঁর মতো আরও অনেক কমবয়সী ছেলেমেয়েকে মগজধোলাই করেছে আইএস। অথচ আমরা তাদের সেই সর্বনাশের পথে যাওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে পারিনি। তারা সরাসরি মানব পাচারের শিকার হয়েছে। ক্রিস ডো বলেছেন, যেহেতু শামীমার গায়ের রং বাদামি এবং বাংলাদেশে সে কোনো দিন না গিয়ে থাকলেও তাঁর বাবা-মায়ের আদি বাড়ি সেখানে, এই কারণে তাঁর প্রতি বেশি ঘৃণা ব্রিটিশরা উগরেছে।
ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী সানি হুন্ডাল বলেছেন, শামীমার নাগরিকত্ব বাতিলে স্পষ্টতই বর্ণবাদী আচরণ ধরা পড়েছে। শামীমার মতো আমার শিকড়ও বাংলাদেশে। ‘যেখান থেকে এসেছ, সেখানে ফিরে যাও’, বর্ণবাদী লোকজনের এই কথামতো শামীমা যেমন বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন না, আমিও তেমনি পারব না। আমরা ব্রিটেনকেই নিজের দেশ মনে করি। আমাদের এই দেশ ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু আমাদের প্রতি আচরণ দেখে বুঝতে পারি, ব্রিটেনের অন্য নাগরিকদের চেয়ে আমাকেও ভিন্নভাবে দেখা হয়। শামীমার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে তাঁকে যথাযথ আইনের আওতায় বিচার করলে তখনই হয়তো আমার সে অনুভূতি থাকবে না।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
শামীম চৌধুরী লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিক ও লেখক