গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে যেসব চলচ্চিত্রপ্রেমী তরুণ-তরুণী ছিলেন, তাঁদের কাছে রীনা ব্রাউন নামটা খুব পরিচিত। স্কার্ট পরে, পনিটেইল চুল নাচিয়ে পর্দায় এই নামে হাজির হয়েছিলেন সুচিত্রা সেন সপ্তপদী চলচ্চিত্রে। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মায়াবী সেই মেয়ে এখনো চোখে ভেসে আছে সেই প্রজন্মের মানুষের। রীনা ব্রাউনকে সম্প্রতি আবার পর্দায় ফিরিয়ে আনলেন চলচ্চিত্রকার শামীম আখতার এই নামেই তাঁর নতুন চলচ্চিত্রে। ফিরিয়ে আনলেন বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতির আলোয়, আনলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে।
চলচ্চিত্রটি নিয়ে তুলনামূলকভাবে কম আলোচনা হয়েছে বলেই মনে করি। নির্মাণশৈলীর দিক থেকে চলচ্চিত্রটি বিশেষত্বের দাবি না করলেও চলচ্চিত্রটির গুরুত্ব এর ব্যতিক্রমী বিষয়বস্তুর জন্য। বাংলাদেশে সীমিত সক্রিয় নারী চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে শামীম আখতার অন্যতম। আশির দশকে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র আন্দোলন যখন হয়ে উঠেছিল সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনেরই একটা ধারা, তখন শামীম আখতার ছিলেন তার পুরোভাগে। চলচ্চিত্রের ওপর সামরিক নানা কালাকানুন, সাম্প্রদায়িক আদর্শের সেন্সর বোর্ড, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীতে বাধা ইত্যাদির বিরুদ্ধে তখন সোচ্চার চলচ্চিত্র সংসদকর্মীরা। মিছিলে, পত্রিকার লেখায়, জনসভায় চলেছে এর প্রতিবাদ। শামীম আখতার তখন প্রবলভাবে সক্রিয় সেই আন্দোলনে।
তাঁর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে তখন বহু তরুণ-তরুণী পুরান ঢাকার ভিড় ঠেলে জড়ো হয়েছেন তাঁর কাপ্তানবাজারের বাড়িতে। পুরোনো বাড়ির লাল রঙের শীতল মেঝেতে অগণিত চড়ুই পাখির কোলাহলে শামীম আপার সঙ্গে আমারও বহুবার তুমুল আড্ডা হয়েছে সাহিত্য, চলচ্চিত্র, রাজনীতি নিয়ে। তাঁকে তখন দখল করে আছে মুক্তিযুদ্ধের ভাবনা। আমরা তখন এমন একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যখন দেখতে পাচ্ছি যে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ নামক দেশটার জন্ম হয়েছে সেই যুদ্ধ পর্বটাকে চোখের সামনে একটু একটু করে মুছে ফেলা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক নেতাদের নাম উচ্চারণ করা তখন বারণ, বইয়ের পাতায়, পত্রিকায় পাকিস্তানি বাহিনী কথাটা লেখা থাকে না, মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের পরিচয় দিতে লজ্জা পান। এমন একটা সময়ের প্রেক্ষাপটে মোরশেদুল ইসলামের আগামী কিংবা তানভীর মোকাম্মেলের হুলিয়া নামের চলচ্চিত্র নেহাত একটা নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণের গল্প নয়, সেটা একটা বিশেষ সময়ের বৈরী স্রোতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চিহ্ন। সেই ধারাবাহিকতাতেই শামীম আখতার একসময় নির্মাণ করলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী নারী সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র শিলালিপি, করলেন যুদ্ধশিশু নিয়ে চলচ্চিত্র ইতিহাসকন্যা এবং সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রীনা ব্রাউন। তাঁর রীনা ব্রাউন চলচ্চিত্রের এক চরিত্র বলে, ‘তুমি ওই এক মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই আটকে আছ।’ হয়তো তা–ই, শামীম আখতারও বুঝি ওই মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই আচ্ছন্ন, ঘোরগ্রস্ত আছেন।
কেউ কেউ তো এমন ঘোরগ্রস্ত থাকবেন। কারণ, তাঁরা জানেন বাংলাদেশ নামক মানচিত্রের রাজনীতি, শিল্পসাহিত্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নয়ন যে পথেই করতে চাই না কেন, আমাদের ফিরে ফিরে আসতে হবে এই রাষ্ট্রজন্মের গোড়ার কথায়। বর্তমানকে বুঝতে, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে আমাদের অতীতকে স্পর্শ করতেই হবে। কারণ, পথ চলতে চলতে আমরা প্রায়ই বিভ্রান্ত হই, অতীত বিস্মৃত হই। শামীম আখতার তাঁর রীনা ব্রাউন চলচ্চিত্রে আমাদের আবার নিয়ে গেছেন অতীতের সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে।
অভিনব কোনো কাহিনি নয়। একটি ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেম। সংকট এই যে তাদের ধর্মীয় পরিচয় ভিন্ন। মেয়েটি অ্যাংলো খ্রিষ্টান, ছেলেটি মুসলমান। দারা নামের মুসলমান ছেলেটি স্যান্ড্রা নামের অ্যাংলো খ্রিষ্টান মেয়েটিকে ডাকে রীনা ব্রাউন, সপ্তপদীর সেই সুচিত্রাকে স্মরণ করেই। তাদের ভালোবাসা, সম্পর্ক, পারিবারিক টানাপোড়েন যখন চলছে, তখন এ দেশেও একটা ক্রান্তিকাল। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধ। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ছেলেটি যুদ্ধে যায়। ওদিকে তছনছ হয়ে যায় মেয়েটির পরিবারও, পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের সবকিছু, পালিয়ে বেড়াতে হয় তাদের। একসময় শেষ হয় যুদ্ধ। যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নতুন করে যাত্রা শুরু করলেও রীনা ব্রাউনের পরিবারের জন্য সে যাত্রা সুখকর হয় না। সংখ্যালঘু হিসেবে নানা বাধার ভেতর পড়তে হয় তাদের। একসময় রীনা ব্রাউন দেশ ত্যাগ করে। তারপর পেরিয়ে যায় অনেক বছর। বহু বছর পর দেশে ফিরে এলে আবার দেখা হয় সেই মেয়ে আর ছেলেটির। প্রৌঢ়কালে তাদের সেই দেখার ভেতর দিয়ে শুরু হয় ছবি এবং ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমেই আমরা জানতে পাই মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই গল্প। এ ছবির একটা বাড়তি পাওয়া সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের দক্ষ অভিনেতা বরুণ চন্দের উপস্থিতি। তাঁর বিপরীতে তাঁর প্রেমিকার চরিত্রের বয়সের ব্যবধানের ব্যাপারটা প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে উঠতে পারত কিন্তু প্রমা পাবনী তাঁর চমৎকার অভিনয়ে সে সুযোগ দেননি।
বলছিলাম, চলচ্চিত্রটির গুরুত্ব এর ব্যতিক্রমী বিষয়বস্তুর জন্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে কিন্তু আমার জানামতে এই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ দেশের অনালোচিত এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অ্যাংলো খ্রিষ্টানদের গল্প চলচ্চিত্রে তুলে আনা হলো। অ্যাংলো খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অগণিত মানুষ একসময় আমাদের ভেতর মিশেছিলেন ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরে। ক্রমে হারিয়ে গেছেন তাঁরা। বাংলাদেশ নামের এই স্বাধীন দেশটি নির্মাণের জন্য তাঁদেরও আছে গভীর আত্মত্যাগের গল্প। সুযোগ ছিল যুদ্ধের ভেতর দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ নামের এই নতুন দেশ হয়ে উঠবে একটা উদার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নমুনা রাষ্ট্র। আশপাশের দেশ সফল হোক আর না হোক, সম্ভাবনা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে সমন্বয়বাদিতার যে ঐতিহ্য, তাকে আরও পুষ্ট করে তুলবে।
কিন্তু ক্রমে আমরা কেমন সংকীর্ণ মানসিকতার একটা দেশ হয়ে উঠলাম, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষের দেমাগে সংখ্যালঘু মানুষ থাকে অপমানে, ভয়ে। পালানোর পথ খোঁজে। এই চলচ্চিত্রের মুক্তিযোদ্ধা চরিত্র দারা বলে, ‘একটা কমিউনিটিকে দেশছাড়া করতে বাধ্য করতেই কি যুদ্ধ করেছিলাম?’
এই দেশের ঠিক পরিচয়টা কেমন হবে এই নিয়ে আমরা যখন তর্ক করছি, তখন শামীম আখতার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন আমাদের দেশে, আমাদের এই মাটিতেই রীনা ব্রাউন নামে আমাদের এক হারিয়ে যাওয়া বোন ছিল, যে এ দেশেরই ঘাসে পা ফেলে ফেলে বলত, ‘ভালোবাসা মানে স্বাধীনতা।’
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।