প্রথম আলোসহ সব গণমাধ্যমেই ফলাও করে খবরটি এসেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পটুয়াখালী কার্যালয়ে কর্মরত উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দীনকে কোনো রূপ কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর অনুসারে তিনি চট্টগ্রাম কার্যালয়ে কর্তব্যরত থাকাকালে কক্সবাজারের ভূমি অধিগ্রহণের দুর্নীতি তদন্তে নেমে বিপদে পড়েছেন। কক্সবাজারের তিনটি প্রকল্পের হুকুমদখল করতে গিয়ে সাবেক ডিসি ও পিবিআইয়ের এসপিসহ মাঠপর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তা এবং স্থানীয় মেয়র, ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে খবর রয়েছে। এ–সংক্রান্ত অভিযোগ অনুসন্ধান করে শরীফ উদ্দিন প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে প্রতিবেদন জমা দেন গত জুনে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
অন্যদিকে তিনি যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছেন, তাঁরা তাঁকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। কক্সবাজারের এ অভিযোগগুলো ছাড়াও তাঁর আওতায় আরও অভিযোগের তদন্ত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের এনআইডি কার্ড দেওয়াসহ গ্যাসক্ষেত্রের কিছু দুর্নীতির তদন্তও করেন তিনি। এসবের ফলে তাঁর চট্টগ্রামের ভাড়া বাসায় গিয়ে সপ্তাহ দুই আগে একটি গ্যাস কোম্পানির দুজন কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন এবং হুমকি দেন জীবন নষ্ট করার। এ ঘটনার পর চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় তিনি একটি জিডি করেন। পাশাপাশি অবগত করেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। তারা এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে আকস্মিকভাবে দুদক চাকরি বিধিমালার ৫৪(২) বিধি অনুসরণ করে তাঁকে কোনো কারণ দর্শানোর সুযোগ না দিয়ে চাকরিচ্যুত করে। তাঁকে কোনো কারণ জানানো হয়নি, ফলে পাননি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ।
এ আদেশের পরপরই দেশের গণমাধ্যমগুলো ব্যাপকভাবে এটা ন্যায়সংগত হয়নি বলে বিভিন্ন খবর ও মতামত প্রচার করতে থাকে। তাঁর সহকর্মীরাও ক্ষোভ জানাতে থাকেন। সাক্ষাৎকারগুলোর একটিতে দুদক সচিব বলেছেন, শরীফ উদ্দিন দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন গুরুতরভাবে। তাঁর বিরুদ্ধে চলমান রয়েছে একাধিক বিভাগীয় মামলা। তবে সেসব বিভাগীয় মামলার নিষ্পত্তি না করে এ ধরনের একতরফা ব্যবস্থার কোনো ব্যাখ্যা দেননি সচিব। কীভাবে শরীফ উদ্দিন সংস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করলেন, সক্ষম হননি এটা বলতে।
উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট বিধিমালায় কারণ দর্শানোর সুযোগ ব্যতিরেকেই চাকরিচ্যুতির বিধানটি আদালতে বিচারাধীন। আর এখন পর্যন্ত আমরা যেটুকু জানতে পেরেছি, শরীফ উদ্দিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন একজন কর্মকর্তা। তবে তিনিও আইনের ঊর্ধ্বে নন। অভিযোগ রয়েছে, কক্সবাজারে একটি ব্যাংকে জনৈক ব্যক্তির হিসাব জব্দের নির্দেশ তিনি দেন আদালতের অনুমতি ছাড়া। তদুপরি কক্সবাজারের ভূমি হুকুমদখল প্রক্রিয়ার ঘুষ হিসেবে গৃহীত উদ্ধার করা টাকা যথাযথ খাতে জমা না করে দীর্ঘদিন নিজ হেফাজতে রাখেন। এসব বিষয় তদন্ত করে অপরাধ প্রমাণিত হলে তাঁকে শাস্তি দেওয়া যায়। কিন্তু সূচনায় আলোচিত তদন্ত বিবরণীগুলো অনিষ্পন্ন রেখে কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই গ্রহণ না করে এ ধরনের একটি ব্যবস্থা সংস্থাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করল।
প্রকৃতপক্ষে দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান খুবই দুর্বল। অভিযোগ এলেও এসব দুর্ভেদ্য প্রক্রিয়া শেষ করে বিচার আদালত পর্যন্ত নিয়ে যেতেই হিমশিম খেয়ে যান তদন্তকারীরা। এরপর আবার দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপার সবারই জানা। এ ক্ষেত্রে দুদক কর্মকর্তারা সব সময় সদাচরণ করেন এমনও নয়। সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ আছে। নগণ্য দু–একটি ধরা পড়েছে। আদালতের প্রসিকিউশন টিমেও ক্ষেত্রবিশেষে অদক্ষতা ও পক্ষপাত সম্পর্কে জানা যায়। এত কিছুর মধ্যেও গুটিকয় নির্ভীক কর্মকর্তা যখন সামনের দিকে যেতে চান, তখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, বিশেষ করে কমিশনকে তাঁদের সমর্থন দেওয়া উচিত।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রাপ্ত অভিযোগগুলো বাছাই করে অনুসন্ধানের অনুমতি দেয় একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি। সময়ে সময়ে কোনো কমিশনারও সরাসরি অনুমতি দিতে পারেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ অনুসন্ধান সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দিলে কমিশন সভায় ওঠে। কমিশন তখন সন্তুষ্ট হলে এজাহার দায়ের ও আনুষ্ঠানিক তদন্তের অনুমোদন দেয়। সে অনুসন্ধান প্রতিবেদন আবার কমিশন সভায় অনুমোদিত হলে অভিযোগপত্র কিংবা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তারপর বিচারের দায়িত্ব আদালতের। সাক্ষ্য–প্রমাণ হাজির করানোর দায়িত্ব অবশ্যই দুদকের। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলছি। অন্যদিকে দেখছি ও শুনছি দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাস নৃত্যগীত।
প্রকৃতপক্ষে দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান খুবই দুর্বল। অভিযোগ এলেও এসব দুর্ভেদ্য প্রক্রিয়া শেষ করে বিচার আদালত পর্যন্ত নিয়ে যেতেই হিমশিম খেয়ে যান তদন্তকারীরা। এরপর আবার দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপার সবারই জানা। এ ক্ষেত্রে দুদক কর্মকর্তারা সব সময় সদাচরণ করেন এমনও নয়। সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ আছে। নগণ্য দু–একটি ধরা পড়েছে। আদালতের প্রসিকিউশন টিমেও ক্ষেত্রবিশেষে অদক্ষতা ও পক্ষপাত সম্পর্কে জানা যায়। এত কিছুর মধ্যেও গুটিকয় নির্ভীক কর্মকর্তা যখন সামনের দিকে যেতে চান, তখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, বিশেষ করে কমিশনকে তাঁদের সমর্থন দেওয়া উচিত। অবশ্যই সে সমর্থন প্রশ্নাতীত হবে না। অনুসন্ধান কিংবা তদন্ত প্রতিবেদনগুলো অসম্পূর্ণ, আইনের চোখে ত্রুটিযুক্ত বা কোনো পক্ষপাতের নমুনা লক্ষ করলে কমিশন অন্য কোনো কর্মকর্তাকে দ্রুত নতুন অনুসন্ধান বা তদন্তের আদেশ দিতে পারেন। তা না করে সেগুলো ফেলে রাখা আর যে বা যাঁরা এ ধরনের তদন্ত করেন, তাঁদের হয়রানিমূলক বদলি কিংবা চাকরিচ্যুতি অযাচিত ও কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। উল্লেখ্য, এই কর্মকর্তাকে কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়েছিল। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় যে সে বদলির সঙ্গেও এসব অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট। সে ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া অসংগত হবে না যে শরীফ উদ্দিনকে শায়েস্তা করতে একটি প্রভাবশালী মহল তৎপর এবং অন্তত এখনকার মতো সফল হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পাস হয় ২০০৪ সালে। এর পেছনে আমাদের নিজস্ব প্রেরণার চেয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের তাগিদ বেশি ছিল, এটা অনেকেই জানেন। তবে আইনে প্রাপ্ত তঁাদের ক্ষমতা পক্ষপাতহীনভাবে প্রয়োগে দৃঢ়চিত্ত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কোনো কমিশন আমাদের কপালে জোটেনি। অথচ কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের ক্ষমতা প্রভূত। রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও অনেক ঊর্ধ্বে। বেতন–ভাতাসহ সুবিধাদি আকর্ষণীয়। চাকরির শর্তাবলি কর্ম সম্পাদনের জন্য সহায়ক। সুপ্রিম কোর্টের বিচারককে অপসারণের জন্য সংবিধানে উল্লেখিত নিয়ম দুদক কমিশনারদের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং আশা করা হয়েছিল দৃঢ় সুরক্ষার বলয়ে তঁারা এ দেশে দুর্নীতির প্রতিরোধ কার্যক্রমকে উত্তরোত্তর জোরদার করবেন। আমাদের দুর্ভাগ্য এমনটা হচ্ছে না।
দুর্নীতিপরায়ণ বলে বিভিন্ন মহলে সুপরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি কোনো ভীতি সৃষ্টি করতে পেরেছে, এমনটাও মনে হয় না। বরং কিছুদিন পরপর বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি দুর্নীতির দায়ে আনীত অভিযোগ থেকে প্রাথমিক তদন্তে ‘দায়মুক্তি’ পাচ্ছেন, এমনটাই লক্ষণীয়। এটা হতেই পারে। যেকোনো ব্যক্তিকে হেনস্তা করা এ আইনের উদ্দেশ্য নয়। কমিশনের কাজও নয় তা। তবে তাঁরা এ ক্ষেত্রে ঈপ্সিত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছেন এমনটা বলা যাবে না। আর শরীফ উদ্দিনের ঘটনা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক তাঁরা অন্তত এ ক্ষেত্রে হাল বাইছেন বিপরীতমুখী।
দুর্নীতি দমন কার্যক্রমের জন্য আমাদের একটিই প্রতিষ্ঠান এ কমিশন। অনেক প্রত্যাশা ছিল এটি ঘিরে। ধারণা করা হয়েছিল তারা অন্তত দুর্নীতিপরায়ণদের লাল সংকেত দেখাতে পারবে। বিচারহীনতার যে সংস্কৃতিতে তারা বিচরণ করছে, তা বন্ধ না হোক, কমানো যাবে। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা পূরণ তেমন কিছুই হয়নি। সহসা হবে, এমনটাও মনে হয় না। সারা বিশ্বে ও দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতির সূচকে আমাদের অবস্থান কোথায়, সেটাও অনেকেই জানেন। জাতি হিসেবে আমরা এ লজ্জার দায় কেন নিয়ে চলেছি, তা বোধগম্য নয়। অবশ্য সবকিছু দুদক ঠিক করে দেবে, এমন আশা করাও সংগত নয়। তবে যেগুলো ধরাছোঁয়ায় এল, সেখানে ‘কিসের শঙ্কা, কিসের ভয়’। অনুসন্ধান প্রতিবেদনগুলো ফেলে না রেখে বিবেচনায় নিলে এত কথা আসত না বরং এ তালগোলের মধ্যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে কমিশনের। আর এর দায় শরীফ উদ্দিনের নয়, বরং কমিশন যাঁরা চালান তাঁদের।
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব