শরণার্থী নিয়ে শোর তুলে দুর্দান্ত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে নিচ্ছে ইউরোপের ডানপন্থীরা। নরম ডান থেকে চরম ডান—সবারই দারুণ সুদিন এখন। শরণার্থীতে দেশ ভরে যাচ্ছে কিংবা শরণার্থীরা সব সর খেয়ে নিচ্ছে বলামাত্রই চিলে কান নেওয়ার অবস্থা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে শরণার্থী ইস্যুটি এক্ষণে ডানপন্থীদের রাজনীতিতে সেরা বরকত দিলেও রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের এই তরিকায় শরণার্থীই প্রথম ইস্যু নয়। অনেক দিন থেকেই ইউরোপের ডানদের রাজনীতির একটি ভালো হাতিয়ার হচ্ছে বৈধ-অবৈধ অভিবাসীবিরোধিতা। ২০০৮ সালের দিকে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হওয়ার পরে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে পুঁজি করে এই প্রবণতা চরমে পৌঁছায়। আর বছর দুয়েক ধরে মূলত সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধজনিত কারণে ইউরোপে আশ্রয়-উন্মুখ মানুষের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে বাড়তে থাকাকে পুঁজি করে শরণার্থী ইস্যুটিকে এত দিনকার অভিবাসীবিরোধী প্রপাগান্ডা বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে কাজে নেমেছে ডানেরা।
আতঙ্ক নম্বর ওয়ান হিসেবে শরণার্থীর বোঝা পুরোটাই ইউরোপের ঘাড়ে চাপার মতো ভাব নেওয়া শুরু হয়। অথচ এটা একটা ডাহা মিথ্যা। ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাওয়া হিসাবমতে, সারা দুনিয়ার মোট ২ কোটি ১০ লাখ শরণার্থীর মাত্র ৬ শতাংশ ইউরোপে আছে। মাত্র ৬ শতাংশ! সিরিয়া, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদানের মতো দেশগুলো থেকেই সাম্প্রতিক সময়ে বেশির ভাগ শরণার্থীর আগমন। এদের সংখ্যাগরিষ্ঠেরই ঠাঁই হয় প্রতিবেশী দেশগুলোতে। যেমন দুই প্রতিবেশী জর্ডান ও তুরস্কে যথাক্রমে পৌনে ৭ লাখ ও ২৭ লাখ সিরীয় শরণার্থীর জায়গা হয়েছে। ক্ষুদ্র প্রতিবেশী লেবাননেও আছে ১০ লাখ। ইরানে আছে সিরিয়া ও ইরাক থেকে আসা প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী। ইথিওপিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো—এই চার দেশ গৃহযুদ্ধ আক্রান্ত দক্ষিণ সুদানের প্রতিবেশী। এদের প্রতিটিই কয়েক লাখ করে দক্ষিণ সুদানিকে ঠাঁই দিয়েছে। এর মধ্যে এক ইথিওপিয়াতেই আছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ। সিরীয় শরণার্থী ঠাঁই দেওয়া দেশগুলো যেমন-তেমন; দক্ষিণ সুদানিদের ঠাঁই দেওয়া দেশগুলো তো হদ্দ গরিব। এর বিপরীতে ইউরোপের দেশগুলোর অবস্থাটা কী রকম?
>শরণার্থীরা আসলে জান বাঁচাতে নয়, বরং নিজ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে ইউরোপে অভিবাসী হয়ে পড়ার সুযোগ নিতে চাইছে—এই প্রচারণার বাজার ইউরোপে ভীষণ ভালো
হিসাব মোতাবেক, ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি শরণার্থীর ঠাঁই হয়েছে জার্মানিতে। এবং এই সংখ্যাটা সর্বোচ্চ তিন লাখ। ২০১৫ সালে শরণার্থীদের জন্য জার্মানির ‘খোলা দ্বারা’ নীতিকে নিতান্ত এক ব্যতিক্রম হিসেবেই দেখতে হবে। এ নীতির আওতায় প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী আশ্রয় দেওয়ার সাজাস্বরূপ চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের রাজনীতি নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ের প্রাদেশিক নির্বাচনগুলোতে ম্যার্কেলের দল বেশ খারাপ ফল করেছে। আসন্ন নির্বাচন মাথায় রেখে তাঁকে এখন উল্টোপথে হাঁটতেই হচ্ছে। ব্রিটেন শরণার্থীর সমস্যা শুরুর সময় থেকেই রাখঢাকা ছাড়াই শরণার্থী গ্রহণে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে রেখেছে। ফ্রান্স, ইতালির মতো বড় দেশগুলোর ভূমিকাও খুব একটা আলাদা নয় এ ক্ষেত্রে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রবেশদ্বার ধরে নিয়ে গ্রিস কিংবা হাঙ্গেরির মতো দেশগুলোতে ঢুকতে চাওয়া শরণার্থীদের ঠেকাতে কত ক্রূর, কত হিংস্র পদ্ধতিই না ব্যবহার করা হয়েছে। শিশু আয়লানের মৃত শরীর কিছু সময়ের জন্য বিবেকে নাড়া দিলেও শরণার্থী নিয়ে আতঙ্কই মূলধারা হিসেবে থেকে গেছে। বিদ্বেষবাদী রাজনীতির প্রভাবে জাতিসংঘের ১৯৫১ সালের কনভেনশন ও ১৯৬৭ সালের প্রটোকলে স্বাক্ষরকারী ইউরোপের দেশগুলো শরণার্থী গ্রহণ এবং শরণার্থীর অধিকারবিষয়ক বাধ্যবাধকতা একেবারেই মাথায় রাখেনি; বরং শরণার্থী ঠেকানো আর তাড়ানোর কায়দাই প্রধান
হয়ে উঠেছে।
শরণার্থীরা আসলে জান বাঁচাতে নয়, বরং নিজ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে ইউরোপে অভিবাসী হয়ে পড়ার সুযোগ নিতে চাইছে—এই প্রচারণার বাজার ইউরোপে ভীষণ ভালো। এই প্রচারণায় তিলার্ধ-সত্য থাকতেই পারে। আমরা কি সিরীয়-আফগানদের পাশাপাশি নিরাপদ দেশ থেকে যাওয়া সুযোগসন্ধানীদেরও ইউরোপের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি? কিন্তু এই সুযোগসন্ধানীদের সঙ্গে বিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে আসা শরণার্থীকে গুলিয়ে দেওয়া অন্যায়। উদাহরণস্বরূপ, সিরিয়া থেকে ইউরোপে আসা শরণার্থীদের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে নারী ও শিশু। এই হিসাব জুলাই মাসে ইউনিসেফের দেওয়া। এই নারী ও শিশুরা কোথাও উত্তাল সাগর, কোথাও দুর্গম পাহাড়, কোথাও মরুভূমির তাপ, কোথাও হিম-শীতল পথ পেরিয়ে, দেশে-দেশে সীমান্তরক্ষীদের বন্দুকের নল পাশ কাটিয়ে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দালালকে হাজার হাজার ডলার দিয়েছে শুধুই অভিবাসী হওয়ার তাড়নায়? সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধকারীরা তাহলে খেজুরগাছের নিচে বসে তোয়ালে পেতে তাস খেলছে? দক্ষিণ সুদানে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা চলছে। প্রশ্ন হতে পারে, শরণার্থীরা প্রতিবেশী দেশে থাকলেই তো পারে। ইউরোপের দিকে হাঁটে কেন? এটা কূট প্রশ্নটা আসলে কোনো প্রশ্ন নয়। জর্জ ডব্লিউ বুশকেও বামপন্থী মনে হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই জমানায় এই সত্যটা চাপা পড়ে গেছে যে জাতিসংঘের কনভেনশন ও প্রটোকলে স্বাক্ষরকারী যেকোনো দেশে শরণার্থী হওয়াটা কোনো সুযোগ নয়, অধিকার। একজন ব্যক্তি শরণার্থী মর্যাদা পাওয়ার জন্য স্বাক্ষরকারী যেকোনো দেশকেই বেছে নিতে পারেন। এখানেই শেষ নয়, মত প্রকাশের অধিকার থেকে শুরু করে একজন বৈধ বিদেশি নাগরিকের যত রকমের অধিকার থাকে, একজন শরণার্থীর সেগুলোর সবই পাওনা। ইউরোপে এসব এখন আজগুবি কথা।
এই যে শরণার্থী নিয়ে এত এত সত্য পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে, এর একমাত্র কারণ কি ডানপন্থীদের বিদ্বেষবাদী রাজনীতি? হড়হড় করে এ রকম সিদ্ধান্ত দিয়ে ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকার আরাম পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এতে উদ্ভূত পরিস্থিতির সার্থক ব্যাখ্যা পাওয়া হয়ে ওঠে না। অভিবাসীবিদ্বেষের ধারাবাহিকতা হিসেবে শরণার্থী রাজনীতিকে বুঝলে বরং বিদ্যমান পরিস্থিতির একটা ব্যাখ্যা দাঁড়াবে। মন্দা শুরুর আগে পর্যন্ত অভিবাসী বনাম মূলধারার কম-আয়ের মানুষজনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব কখনো একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়নি। অদক্ষ বা কম-দক্ষ শ্রম নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে খুব একটা টানাটানি হয়নি। মন্দা এসব জায়গাগুলোকে ভীষণ মন্দ করে দিয়েছে। মন্দার কোপে কম-আয়ের মানুষদের আয়-রোজগারে টানাটানি, চাকরিতে অনিশ্চয়তা, জীবনযাপনের ব্যয় সবকিছু বেড়েছে। বাড়েনি আয়, বাড়েনি কর্মসংস্থান। ইউরোপের প্রতিটি দেশের নরম-গরম ডানপন্থীরা নিম্নবিত্তের সামনে সব টানাটানির পেছনের কারণ হিসেবে অভিবাসীদের টেনে এনেছে। জীবন-জ্বালায় অতিষ্ঠ নিম্নবিত্ত এই বাখোয়াজিটা পাতে নিচ্ছে।
কেন এমন হচ্ছে? আসলে নিম্নবিত্ত দেখছে, অতি বড়লোকের জন্য খোদ রাষ্ট্র আছে, বড়লোকের জন্য ব্যাংকগুলো আছে, উচ্চ–মধ্যবিত্তের জন্য সম্মানজনক আয়ের উৎস আছে, মধ্যবিত্তের টানাটানি থাকলেও চলে যাচ্ছে। নিম্নবিত্ত ভাবছে তার নাভিশ্বাস একটু কমিয়ে দেওয়ার জন্য কে আছে? যেসব কাজ আগে সে ছুঁয়ে দেখত না, এখন সেসব কাজ করতে চেয়েও অনেক সময় পায় না। সরকারি আবাসনের ক্ষেত্রেও বেশ একটা টানাটানি চলছে। তাকে মনে করা হচ্ছে, তার দেশের অনেক কিছু অভিবাসীদের দখলে। তার লাইফের ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে, এখন সে সস্তা শ্রম ও মুনাফার খেলা বুঝতে চায় না। গরিব দেশের অভিবাসী সস্তায় শ্রম বিকোতে প্রস্তুত; শিথিল শর্তে। এই চিরায়ত বাস্তবতা পশ্চিমের মূলধারার নিম্নবিত্তকে নিজের দেশে নিজের হটে যাওয়ার অনুভূতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এরা অভিমানহত হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে একধরনের নিপীড়িতের বোধ সঞ্চার হয়েছে। এদের মনে হচ্ছে, যদিও এই মনে হওয়াটা ভুল, অভিবাসী, অবৈধ অভিবাসী, শরণার্থীর জন্য কাজ হোক না হোক আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ আছে। এরা ভাবছে, এদের জন্য কেউ কোথাও নেই। ঠিক হোক আর বেঠিক হোক, এই যে বঞ্চনার বোধ, এই বোধটাকে ডানপন্থীরা শরণার্থী পর্বে আগুন করে তুলেছে। ইউরোপের উদার গণতন্ত্রী, মধ্যপন্থী আর বামপন্থীরা এই জায়গায় ভয়াবহ মার খেয়ে গেছে। মন্দা চলতে থাকলে ইউরোপের নিম্নবিত্ত আগামী দিনগুলোতে ডানপন্থী প্রচারণার দিকেই ঝুঁকে থাকবে। এমতাবস্থায় মহাদেশটিতে নতুন বছরের নির্বাচনগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডানপন্থীরাই ক্ষমতার পালাবদলের নিয়ামক হবে।
এই চাপের মধ্যে মধ্যপন্থীরা, বামপন্থীরা কেমন করে তাদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখে, তা-ও দেখার বিষয় হবে।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।