শক্তিশালী জন-আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন
বিশ্বব্যাংক সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা বা পাবলিক ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্টকে বর্ণনা করেছে আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, সরকারের নীতি-লক্ষ্য পূরণে সম্পদের বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ এবং তহবিলের দক্ষ, সময়ানুযায়ী ও জবাবদিহির নির্ণায়ক হিসেবে। একটি সুষ্ঠু জন-অর্থ ব্যবস্থাপনা নিরপেক্ষ শাসন ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যেমন অন্যতম বড় সহায়ক, তেমনি বিশ্বাসযোগ্য নির্দেশকও। যেসব দেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে উচ্চ অঙ্কের সাহায্য পায়, বিশেষ করে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোতে জন-অর্থ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্ত সাহায্যের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এখানে খুব প্রয়োজনীয়। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক কম্বোডিয়ার প্রশংসা করেছে নিজেদের জন-অর্থ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জনের জন্য। উল্লেখযোগ্য সংস্কারের এমন ঘটনাকে বাংলাদেশসহ একই ধরনের অর্থনীতিগুলোর জন্য বেঞ্চমার্ক হিসেবে দাঁড় করানো যেতে পারে।
বাংলাদেশের সরকারি অর্থায়ন শক্তিশালীকরণকে সংক্ষিপ্তভাবে বলা যেতে পারে অসংখ্য গর্তে ভরা একটি ঊর্ধ্বগামী পথ। ২০১৭ সালের ওপেন বাজেট ইনডেক্সে (ওবিআই) বাংলাদেশের স্কোর ১০০–তে ৪১। যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার ৮৯, উগান্ডার ৬০, নেপালের ৫২, ভারতের ৪৮ ও শ্রীলঙ্কার স্কোর ৪৪। ওবিআই অনুযায়ী, এই স্কোর নির্দেশ করছে যে বাজেটের কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ব্যাপক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য অনুপস্থিত এবং সার্বিকভাবে জন–বিতর্কের জন্য পর্যাপ্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফিসকাল ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট ২০১৯–তে বিষয়টি আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ আর্থিক স্বচ্ছতার জন্য মৌলিক মানদণ্ড তৈরি করতে পারেনি, অন্যদিকে উল্লিখিত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়ারও চেষ্টা করেনি। বাংলাদেশের সরকারি অর্থায়নের বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে ভেতরে-বাইরে একটি সম্পূর্ণ পরীক্ষা চালানোর প্রয়োজন রয়েছে।
ভূমিকা ও দায়িত্বের স্বচ্ছতা এবং গঠনপ্রণালি বজায় রাখার পাশাপাশি একই সঙ্গে বিভিন্ন বাজেট অংশের পরিষ্কার ফ্রেমওয়ার্ক সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হওয়া উচিত। সরকারি অ-আর্থিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটের মধ্যকার আর্থিক সম্পর্কের প্রকৃতি অনেকটা অস্পষ্ট এবং এই সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে গেলে একীকৃত ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট নেই বললেই চলে। এটি স্থানীয় আর্থিক কর্তৃপক্ষকে আর্থিক পদক্ষেপ ঘোষণা দেওয়ার মুক্ত পথ করে দিচ্ছে। প্রায়ই সম্পূরক বাজেটের প্রস্তাব দেওয়া হয়, যার বেশির ভাগই ওই কর্তৃপক্ষের রাজস্ব হিসেবে প্রতিফলিত হয় না। একই ব্যবস্থা অনুসরণ করছে বিভিন্ন বাজারবহির্ভূত অলাভজনক সংস্থা (এনপিআই), যেমন সেনাকল্যাণ সংস্থা তহবিল, মেডিকেল কলেজ, একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই ঋণের ক্ষেত্রে দেওয়া ছাড়। এসব প্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্পাদিত বিভিন্ন আধা আর্থিক কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক বাজেটারি দলিল অনুসারে হয় না, যেটি অ-জবাবদিহি ও অস্বচ্ছতাকে আরও উসকে দেয়। সরকারি ভূমিকা পদ্ধতির এ অস্পষ্ট অবস্থা, যেকোনো নতুন ট্রেন্ড ফ্রেমওয়ার্ক স্বচ্ছতা টেকসই করাতে ব্যর্থ হচ্ছে। যেমন চুক্তির আর্থিক তথ্য, ইজারা ও আমানতকরণ প্রভৃতি স্পষ্টভাবে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপকে (পিপিপি) সঠিকভাবে বর্ণনা করে না।
বাংলাদেশের আর্থিক কর্তৃপক্ষ কঠোর বাজেটরি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা করছে, যেমন বছরের ব্যয় বরাদ্দের হিসাব রাখার জন্য একীভূত বাজেট ও অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম (আইবিএএস++) বাস্তবায়ন। তবু বাদবাকি বাজেটিং ও রিপোর্টিং সংস্থা যেমন অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সবাই প্রায়ই ঠিক সময়ে ও প্রাসঙ্গিক আর্থিক তথ্য প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। এরপরও নির্ধারিত আর্থিক দায়বদ্ধতা আইনের ঘাটতি বিভিন্ন সরকারি হিসাব অডিট করাকে রেহাই দিচ্ছে এবং অ্যাডহক ভিত্তিতে রাজস্ব অনুমান করা হচ্ছে, যেখানে আর্থিক পদক্ষেপ ও এদের সামষ্টিক ফলাফলের প্রভাব মূল্যায়ন ও বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয় না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশিকা অনুসারে, অধিকাংশ নথিই সময়মতো আসে না, এমনকি তারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডও পূরণ করতে পারে না। ২০১৭ সালের ওপেন বাজেট সার্ভে আরও বলছে যে মূল বাজেট প্রতিবেদনের তিনটি বাদে, মধ্য বছর ও অডিট রিপোর্টসহ বাকি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জনগণ পায় না, এমনকি সময়মতো প্রকাশও করা হয় না। এ অস্বচ্ছতা আরও জোরালো হয়: হিসাবহীন সরকারি গ্যারান্টির কারণে তৈরি হওয়া ঋণবহির্ভূত এবং অনিশ্চিত দায়, পেট্রোবাংলার মতো বড় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বণ্টন চুক্তির অস্পষ্ট প্রচার এবং বিভিন্ন বরাদ্দকৃত আধা আর্থিক ভর্তুকির ওপর দুর্বল নজরদারির কারণে। সামরিক ব্যয় ও আগে উল্লেখ করা পিপিপি লেনদেনের স্পষ্টতাও বিভ্রান্তিকর। যদিও প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরিচালন কাঠামো পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকে, তবু এর মূল অখণ্ডতা ও নির্ভরযোগ্যতা জন-আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নির্ধারণ, যথার্থ ও টেকসই রাজস্ব কার্যকলাপের সম্পূর্ণতার জন্য বাধ্যতামূলক হচ্ছে আন্তরিক এবং অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক তত্ত্বাবধান প্রক্রিয়া।
রাজস্বকাঠামোর আমূল পরিবর্তন আনতে চাইলে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করতে হবে। কুইক উইন বা ‘দ্রুত জয়’ হলো স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ, এটি এমন একটি কার্যকর উদ্যোগ, যেটি নিলে এক থেকে দুই বছরের মধ্যে বড় ধরনের উন্নতি দেখা যাবে। প্রাক্-বাজেট আলোচনার সময় সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, আধা রাজস্ব কার্যকলাপের জন্য কঠোর দায়বদ্ধতার প্রবিধান মেনে চলার অনুশীলন, পিপিপি প্রকল্প (মেগা অবকাঠামো চুক্তিসহ) এবং সম্পূরক বাজেটের প্রাক্-পরীক্ষা সংস্কারের টেকসই তা নিশ্চিত করতে পারে। মধ্যমমেয়াদি সংস্কার, ৫-১০ বছরের মধ্যে রাজস্ব সফলতার উন্নতির ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। এটি অর্জনের জন্য একটি কঠোর ও শক্তিশালী তত্ত্বাবধান সুসংহত প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে হবে।
কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংক কিরগিজ প্রজাতন্ত্রের জন্য একটি জন-অর্থ ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প পরিচালনা করেছিল। ওই প্রকল্পের কয়েকটি উপাদান ছিল মানুষের ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা পুনর্বাসন, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ অডিট ও নিয়ন্ত্রণ, একই সঙ্গে বাজেট প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণ। দক্ষতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার জবাবদিহি নিশ্চিতে বাংলাদেশ যদি আন্তরিকতা ও সংকল্প নিয়ে একই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে দৃশ্যমান উন্নতি অবশ্যই সম্ভব।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক