লি কুয়ান, শেখ হাসিনা ও শুদ্ধি অভিযান
একটানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের ও সরকারের মধ্যে যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন, তা নিয়ে এখন রাজনৈতিক মহলে সরগরম আলোচনা। সবার প্রশ্ন, কত দিন ও কত দূর পর্যন্ত এই অভিযান চলবে? যদিও প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কে কোন দল করেন, সেটি দেখা হবে না।
এবার শুদ্ধি অভিযান কার্যত শুরু হয়েছিল চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে সরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। তাঁরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেছিলেন। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালানো হলে দেশবাসী অন্দরমহলের অনেক কিছুই জানতে পারেন। নড়েচড়ে ওঠে এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। এরই মধ্যে তিন সাংসদসহ ২৩ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন বিতর্কিত ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল আলম (ফিরোজ), অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান (মিজান), তারেকুজ্জামান রাজীব প্রমুখ। তিন সাংসদসহ অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। নজরদারিতে আছেন শতাধিক নেতা।
অনেকের কাছে সরকারের শুদ্ধি অভিযানটি আকস্মিক মনে হলেও এর ধরন ও মাত্রা দেখে মনে হয়, বেশ প্রস্তুতি নিয়েই এটি চালানো হয়েছে। না হলে এত দিন আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে থাকা ‘সম্রাটদের’ পাকড়াও করা, তাঁদের বাড়ি ও অফিস থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হতো না। এই অভিযানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের যেসব শীর্ষ নেতা দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িত কিংবা যাঁরা ‘দলের ভেতরে দল ও রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’ তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদেরও ছাড় না দেওয়া। ক্ষমতাসীন দলে তিনটি সহযোগী সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অব্যাহতি দেওয়া কিংবা পদত্যাগে বাধ্য করার কাজটি মোটেই সহজ ছিল না।
সমালোচকদের কেউ কেউ বলেছেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কারও কারও দৌরাত্ম্য এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে এই অভিযান চালানো ছাড়া সরকারের উপায় ছিল না। কিন্তু এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে যাঁরা এত দিন অর্থ ও মাস্তানির জোরে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভেবেছেন, শেখ হাসিনা তাঁদের আইনের আওতায় এনেছেন। এ অভিযানে দেশের মানুষ তো বটেই, আওয়ামী লীগের পোড়খাওয়া নেতা-কর্মীরাও স্বস্তিবোধ করছেন।
এরশাদ, খালেদা জিয়া ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পরিচালিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সঙ্গে এই অভিযানের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। আগের অভিযানের লক্ষ্য ছিল সরকারের প্রতিপক্ষ, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি কিংবা ব্যবসায়ী। স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে দেখেছি, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে যাঁদের ধরা হতো, কিছুদিন পর তাঁরাই জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেতেন। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় নিজ দলের সন্ত্রাসী নেতা-কর্মীদের ধরলেও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানটি ছিল সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক ও বাছাইকৃত। কাকে ধরা হবে কাকে ধরা হবে না, সেটি আগেই ঠিক করা থাকত। এনবিআর ও দুদক ছিল সাক্ষিগোপাল।
এবারের অভিযানের ইতিবাচক দিক হলো এটি শুরু হয়েছে ‘নিজের ঘর’ থেকেই। নেতিবাচক হলো ক্ষমতার ১১ বছরের মাথায় এটি শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, তা উদ্ধার করা কঠিন হবে। তারপরও জঙ্গি দমনের মতো দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী যে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন, তার প্রতি বেশির ভাগ মানুষ আস্থা রাখতে চায়।
দুর্নীতি রোধ নিয়ে কাজ করেন এমন একটি সংস্থার প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, দেরি হলেও সরকার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছে, এটি ইতিবাচক এবং এই অভিযান যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যেতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। সিঙ্গাপুরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা যেতে পারে। গত শতকের ষাটের দশকে সিঙ্গাপুরও একটি অনুন্নত ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল। কিন্তু লি কুয়ান ইউ প্রধানমন্ত্রী হয়ে দুর্নীতিকে দেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। প্রথমেই তিনি দুর্নীতির ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করতে ব্রিটিশ প্রবর্তিত আইনগুলোর ব্যাপক সংস্কার করেন (আমরাও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনের উত্তরাধিকার বহন করছি)। এরপর তিনি করাপ্ট প্র্যাকটিসেস ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো বা সিপিআইবিকে শক্তিশালী করেন। তিনি সঠিক কাজের জন্য সঠিক লোককে নিয়োগ দেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দেন; যাতে কেউ আর্থিক অসচ্ছলতার অজুহাত দেখিয়ে দুর্নীতি না করেন। আমাদের দেশেও সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা অনেক বেড়েছে। এখন দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। সব ক্ষেত্রে আইনের গতি সমান হতে হবে। কোনো ক্ষেত্রে আইন অতিশয় গতিশীল ও কোনো ক্ষেত্রে মন্থর হলে চলবে না।
তবে এই অভিযান নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বও আছে। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কতিপয় দুর্নীতিবাজ ধরা পড়েছেন। এটি আশাব্যঞ্জক। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে যেসব দুর্নীতিবাজ আছেন, তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা না হলে অভিযান সফল হবে না।
লি কুয়ান সিঙ্গাপুরকে কেবল দুর্নীতিমুক্ত করেননি, উন্নত দেশ হিসেবেও গড়ে তুলেছেন। তাঁর সময়ে দেশটিতে গণতান্ত্রিক অধিকার সীমিত থাকলেও সংবাদমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। লি কুয়ান দুর্নীতিবাজদের ধরতে সংবাদমাধ্যমের সহায়তা নিয়েছেন। মন্ত্রী, নেতা, সরকারি কর্মকর্তা যিনিই দুর্নীতি করুন না কেন, তিনি কাউকে ছাড় দেননি। এখানে দুটি উদাহরণ দিই। লি কুয়ানের পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন উই তুন বুন। তিনি ঠিকাদারের খরচে একবার সপরিবার ইন্দোনেশিয়া সফর করেন। এ ছাড়া তিনি ৫০ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার দিয়ে একটি বাড়ি কিনেছিলেন, যার জিম্মাদার ছিলেন ওই ঠিকাদার। এই অভিযোগে উই তুনের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তাঁকে সাড়ে চার বছর জেল খাটতে হয়।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও মর্মান্তিক। লি কুয়ানের জাতীয় উন্নয়নমন্ত্রী তেহ চিং ওয়ানের বিরুদ্ধে পাঁচ লাখ সিঙ্গাপুরি ডলার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ছিল। এটি সিপিআইবি তদন্ত করার দায়িত্ব পায়। মন্ত্রী তখন লি কুয়ানকে অনুরোধ করেন তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যেন সংস্থাটির প্রধানকে তাঁর বিষয়টি সদয় দৃষ্টিতে দেখতে বলেন। উত্তর প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি যোগ্য লোককেই ওই কাজের দায়িত্ব দিয়েছি, আমি তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারি না।’ ওই মামলার চার্জশিট দেওয়ার আগেই মন্ত্রী আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার আগে তিনি দায় স্বীকার করে একটি নোটও লিখে রেখে যান।
বাংলাদেশে প্রশাসনে যে পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে, তাতে সিঙ্গাপুরের ওই দুই মন্ত্রীর দুর্নীতিকে খুব গুরুতর বলা যায় না। তারপরও তাঁরা শাস্তি পেয়েছেন। আমাদের দেশে সব সময় সাবেক মন্ত্রী-সাংসদেরা শাস্তি পান। এর অর্থ হলো ক্ষমতাসীনেরা ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থাকেন। পাশের দেশ ভারতেও মন্ত্রী-সাংসদেরা জেল খেটেছেন। আমরা কবে আইনের শাসনকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারব?
লি কুয়ানের সততার আরেকটি উদাহরণ দিই। ১৯৮৫ সালে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে লি কুয়ান ও ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী লি হিসেন লং বাড়ি কেনার সময় আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বা ডেভেলপারের কাছ থেকে অতিরিক্ত ছাড় বা কমিশন নিয়েছেন। তিনি বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তে দেখা যায়, লি কুয়ান বেআইনি কিছু করেননি। ডেভেলপার ক্রেতাকে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ছাড় দিতে পারেন। এরপর লি কুয়ান আরও স্বচ্ছতার জন্য বিষয়টি সংসদে আলোচনা করতে বলেন এবং বিতর্কে বিরোধী দলের নেতাসহ সব সদস্য এই অভিমত দিয়েছিলেন যে এই ছাড় আইনসম্মত।
আমরা বাংলাদেশেও কি এ রকম একজন রাষ্ট্রনেতার কথা ভাবতে পারি, যিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেবেন এবং তা নিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্কের অনুরোধ জানাবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি বাংলাদেশের লি কুয়ান হতে পারবেন?
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]