সম্প্রতি দেশে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা কিংবা আত্মহত্যাচেষ্টার একাধিক ঘটনা ঘটল। ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা নতুন ট্রেন্ড যেন না হয়ে ওঠে, এর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, তা নিয়ে এখন থেকেই সমাজ, মনোবিদ, রাষ্ট্র ও সরকারের সক্রিয় হওয়া উচিত। পৃথিবীব্যাপী মানুষের মৃত্যুর একটা বড় কারণ আত্মহত্যা। বিশ্বে প্রায় আট লাখ লোক প্রতিবছর আত্মঘাতী হয়। এই অপচয় রোধ করতে হবে; যতটা পারা যায়, মানুষকে বাঁচাতে হবে।
আত্মহত্যার খবর পরিবেশনের সময় গণমাধ্যমগুলোর সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। গণমাধ্যমে আত্মহত্যার খবর পরিবেশন বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনের চুম্বক অংশ আমি অনুবাদ করে দিচ্ছি:
১. আত্মহত্যা সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে সুযোগ গ্রহণ করুন।
২. আত্মহত্যাকে চাঞ্চল্যকর কিংবা স্বাভাবিক কিংবা সমস্যার সমাধান হিসেবে তুলে ধরে, এমন ভাষা পরিহার করুন।
৩. গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠায় বা অংশে আত্মহত্যার খবর প্রকাশ করবেন না। অকারণে আত্মহত্যার খবর পুনরাবৃত্তি করবেন না।
৪. আত্মহত্যা কিংবা আত্মহত্যাচেষ্টার পদ্ধতির বিশদ বর্ণনা দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৫. আত্মহত্যার স্থানের পরিপূর্ণ তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৬. শিরোনামের শব্দগুলো খুব সতর্কতার সঙ্গে বাছাই করুন।
৭. ছবি কিংবা ভিডিও ফুটেজ দেওয়ার ব্যাপারে খুবই সাবধান থাকুন।
৮. তারকাদের আত্মহত্যার খবর পরিবেশনের সময় অতিরিক্ত এবং বিশেষ রকম সতর্কতা অবলম্বন করুন।
৯. শোকগ্রস্ত পরিবারগুলোর কথা সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় রাখুন।
১০. কোথায় সাহায্য পাওয়া যাবে, সে তথ্য পরিবেশন করুন।
১১. মনে রাখবেন, গণমাধ্যমে কর্মরত মানুষও এ ধরনের খবর দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
(সূত্র: প্রিভেন্টিং সুইসাইড: আ রিসোর্স ফর মিডিয়া প্রফেশনালস)
বাংলাদেশে আত্মহত্যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আত্মহত্যা প্রতিরোধে সংগঠন গড়ে তুলে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের আয়োজিত একটা কর্মশালায় অংশ নিয়ে আমি এ বিষয় সম্পর্কে বেশ খানিকটা সবক পেয়েছিলাম। আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করে যে খবর পরিবেশন করতে হয় না, এ কথা তখনই আমার বিবেকে ভালো করে গেঁথে যায়, আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন বিষয়ে অবগত হই।
যে বয়স্বীদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকেন, তাঁদের মধ্যে একটা নিঃসঙ্গতার বোধ থাকে। যে বয়স্বীরা বিদেশে গিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকেন, তাঁদের মধ্যে আরেক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ তৈরি হয়! এই নতুন পরিস্থিতি কিংবা নতুন সমস্যাটা নিয়ে সমাজ-ভাবুকেরা একটু ভাববেন?
২.
এবার অন্য একটি সামাজিক বাস্তবতার বিষয় নিয়ে কথা বলব। তা হলো বয়স্বী মানুষদের নিঃসঙ্গতা এবং তার একটা বিশেষ রকম বা ধরন নিয়ে এই লেখা। আমাদের দেশে প্রায় এক কোটি মানুষ অভিবাসী বা প্রবাসী। তার মানে প্রায় দুটো পরিবারের একটায় কোনো কোনো সদস্য বিদেশে থাকেন। এখন ঢাকা শহরে (এবং অন্য জায়গাগুলোতেও) এ রকম দেখা যায় যে মা–বাবা দেশে একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে আছেন, তাঁদের সব সন্তানই থাকে বিদেশে। এর মধ্যে কেউবা আবার জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীকে হারিয়ে পুরোপুরি একলাই থাকেন।
এসব মানুষের অসুখে-বিসুখে, মৃত্যুশয্যায় কখনোবা কোনো আত্মীয়স্বজন থাকে, কখনোবা কেউ থাকে না, কখনোবা থাকে পারিশ্রমিক পাওয়া সেবক বা কর্মচারী বা পরিচারক। এঁরা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এঁদের কথা ভেবে বা নিজের এই পরিণতির কথা ভেবে নিজের বুক থেকেও একটা লম্বা শ্বাস বেরিয়ে আসে। আরেক ধরনের কেস আছে। ছেলে বা মেয়ে বিদেশে থাকেন। ভালো ‘জব’ করেন। তাঁদের সন্তান হবে। তখন তাঁরা আসন্ন সন্তানের দাদি বা নানিকে দেশ থেকে বিদেশে আনিয়ে নেন। দাদি বা নানি আনন্দের সঙ্গেই উন্নত দেশের কোনো এক জায়গায় ছেলে বা মেয়ের বাড়িতে যান। গিয়ে দেখেন সেখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। একেকটা বাড়ি যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। গাড়ি ছাড়া বাড়ি থেকে বের হওয়া যায় না। সবাই যার যার জীবন আর জীবিকা নিয়ে মহাব্যস্ত। ওই প্রবীণ বা প্রবীণা তখন নিজেকে বন্দী ভাবতে শুরু করেন। নাতি বা নাতনির জন্ম হয়। দাদি–নানি তার দেখাশোনা করেন। সে বড় হচ্ছে। কিন্তু প্রবীণের মন পড়ে আছে দেশে। শুধু এই রকম দাদি–নানি বা মা-বাবার কথাই-বা বলি কেন, প্রথম প্রজন্মের সব প্রবাসীরই মন পড়ে থাকে দেশে। তাঁরা টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ, শীতের সকালে খেজুরের রস, হলুদ শর্ষেখেতে কুয়াশা, বৈশাখী মেলা, বইমেলা, রিকশা—সবকিছুর জন্য হাহাকার করতে থাকেন। আচ্ছা, একটা নাতির বয়স না হয় দুই হলো, এবার আমাকে ছেড়ে দাও। তখন দেখা গেল, মেয়ে বা বউমা আবার গর্ভধারণ করে বসেছে। আবারও দুই বছর। আমি একটা কাহিনি জানি, এই ধরনের এক প্রবীণা যাতে দেশে ফিরতে না পারেন, সে জন্য তাঁর ছেলে-ছেলের বউ তাঁর পাসপোর্ট লুকিয়ে রেখেছিল। প্রবীণা নিজেকে আপন ছেলের বাসায় নিজেকে একজন কারাগারের বন্দী হিসেবেই বিবেচনা করতেন।
আমি আমার আম্মাকে দেখে তাঁর হৃদয়ের এই অনুভূতির কথা কিছুটা আঁচ করতে পারি। আমরা পাঁচ ভাইবোন ঢাকায় থাকি। আমাদের আম্মা রংপুর শহরে নিজের বাসা আর ছেলের বাসা দেখাশোনা করতেন। গ্রামের বাড়ির জমিতে ধান উঠত। আম্মা বছরে দুবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকতেন। ধান সেদ্ধ করা, শুকানো—নানা কাজে নেতৃত্ব দিতেন। একা। আমাদের আব্বা তো সেই কবেই মারা গেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে ঢাকায় এনে আমাদের কারও বাড়িতে দীর্ঘদিন রেখে দেওয়া যেত না। তিনি খাঁচার পাখির মতো ছটফট করতেন। এসব ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকা যায়! তাঁর নিজের যে সংসার আছে! রংপুরে বা গ্রামের বাড়িতে কতশত কর্তব্য আছে! আমাদের তালিকা দিতেন। কতজনকে বৃত্তি দিতে হবে, কতজনকে রিকশাভ্যান কিনে দিতে হবে!
যে বয়স্বীদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকেন, তাঁদের মধ্যে একটা নিঃসঙ্গতার বোধ থাকে। যে বয়স্বীরা বিদেশে গিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকেন, তাঁদের মধ্যে আরেক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ তৈরি হয়! এই নতুন পরিস্থিতি কিংবা নতুন সমস্যাটা নিয়ে সমাজ-ভাবুকেরা একটু ভাববেন?
বি. দ্র.: কারও কোনো বিপদে কিংবা কোনো জরুরি সেবা পেতে ৯৯৯-এ কল কিন্তু কাজে দেয়। যাঁরা ফোন করেছেন, তাঁরা সবাই উপকার পেয়েছেন। এটা বাংলাদেশ সরকারের জরুরি সেবার কল নম্বর। নম্বরটি মনে রাখি এবং বলি, ধন্যবাদ ৯৯৯।
●আনিসুলহক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক