বরিশাল বিভাগজুড়ে ডায়রিয়া বাড়ছে। ডায়রিয়ার এই প্রকোপের একটা কারণ খাল-বিলের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া। তারচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কার কথাও কোনো কোনো দৈনিকে আছে, বরিশাল বিভাগের নদী-খাল-বিলের পানিতে কলেরার জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও সব হাসপাতালেই ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা, তারপরও বলতে হবে পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ই আছে। বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের মূল ভবনে ডায়রিয়া রোগীদের জায়গা দিতে না পেরে কর্তৃপক্ষ ভবনের বাইরে খোলা মাঠে শামিয়ানা টাঙিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে।
ডায়রিয়া ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার প্রথম খবর আসে উপকূলীয় জেলা বরগুনা থেকে। এরপর পুরো বিভাগের ছয় জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে দ্বীপ জেলা ভোলা। সেখানে ৬ মে পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ১১ হাজার ৭০২ জন। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত (৭ মে) এই বিভাগের বিভিন্ন স্থানে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। হাসপাতালে না আসা রোগীর হিসাব এই তালিকায় নেই।
সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাসের তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগে চলতি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ৭ হাজার ৭৭ জন এবং গত এক মাসে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ২৭ হাজার ৭০৯ জন। বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৪৬ হাজার ৮১২ জন। ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, এত অল্প সময়ে এত বেশি রোগী গত ২৫ বছরের মধ্যে আর দেখা যায়নি।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে মাঠপর্যায়ের নানা সূত্র, ভুক্তভোগী আর স্বাস্থ্যব্যবস্থাযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে অভিজ্ঞতার আলোকে ৪ মে ২০২১ প্রথম আলো পাঁচের পাতায় ডায়রিয়া সংকট নিয়ে একটা লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাটি অনেকের পছন্দ হলেও কয়েকজন (তাঁরা নিজেদের নাম বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় উল্লেখ করেননি) এ দেশের চিকিৎসকদের প্রতিনিধি সেজে খুবই অরুচিকর ভাষায় তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করে ই-মেইল পাঠান। ই-মেইল লেখক বা লেখকদের মূল অভিযোগ ৪ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনের লেখক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র মানে ডাক্তার না হয়ে কেন ডায়রিয়া নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন? দেশে এ জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠান আছে, আছেন তাদের বেতনভুক্ত বিজ্ঞানী কর্মচারী, তাঁরা কথা বলবেন। বলা বাহুল্য, এসব ট্যাড়া কথা নিয়ে বাহাস করার জন্য এই লেখা নয়। তবে এটা মনে রাখা দরকার, ডায়রিয়া চিকিৎসা আর প্রতিরোধ এক জিনিস নয়। চিকিৎসা সার্বিক ডায়রিয়া প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় একটি অংশমাত্র। সব কাজে নিরাপদ পানি ব্যবহারের সুযোগ ও সুস্থ পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ডায়রিয়া প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি। আবার চিকিৎসা ক্ষেত্রেও নিত্যনতুন কৌশলের প্রয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া। একবার চিকিৎসার সনদ পেলেই তিনি চিরকালের চিকিৎসক হয়ে যান না।
ডায়রিয়ার ধরন এবং কারণের সঙ্গে তার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার রকমফের হয়। আবার বারবার পায়খানা হওয়া কোভিডের একটা লক্ষণ হওয়ায় জটিলতা আরও বেড়েছে। অনেকেই পায়খানার চেয়ে বমি করছেন বেশি। ফলে শরীরে পানিশূন্যতার পাশাপাশি ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে রোগী শকে চলে যাচ্ছে। এই সবই রোগী, রোগীর সাথি ও মাঠপর্যায়ের চিকিৎসকদের কাছ থেকে শোনা। সংকটকালে মাঠপর্যায়ের চিকিৎসকদের নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা এবং উদ্ভাবনের সফলতা–ব্যর্থতা নথিবদ্ধ করা ও চিকিৎসক–স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া জরুরি। প্রয়োজন ডায়রিয়া চিকিৎসার ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা প্রটোকল হালনাগাদ করা আর সেটা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া। চিকিৎসার পাশাপাশি এর কারণকেও আমাদের আমলে নিতে হবে। না হলে রোগীর স্রোত বন্ধ হবে না। সেবা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া রোগী আবার ডায়রিয়ার উপসর্গ নিয়ে ফিরে এসেছে পাথরঘাটায়, ভোলায়, বরগুনায় এমনকি গোপালগঞ্জেও।
গোপালগঞ্জে মে মাসের প্রথম পাঁচ দিনে ডায়রিয়াসহ পেটের অসুখে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অন্তত দুই শ রোগী। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন করে ভর্তি হয়েছেন। ডায়রিয়ার জন্য নির্ধারিত এক-একটি বেডের বিপরীতে রোগী প্রায় তিনজন। জেলায় হঠাৎ করে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে পানির লবণাক্ততাকে দায়ী করছে চিকিৎসকসহ পৌর কর্তৃপক্ষ। সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এবারের ডায়রিয়া সংকটের মূল কারণই হচ্ছে অতিরিক্ত আর দীর্ঘস্থায়ী লবণাক্ততা।
গোপালগঞ্জে মিষ্টি পানির অভাব অনেক দিনের। আগে সেখানকার নলকূপে সুপেয় পানি মিলত না, নিরাপদ পানি তো নয়ই। ফলে মানুষ গভীর নলকূপে যেতে থাকে। অপরিকল্পিতভাবে বাড়তে থাকে গভীর নলকূপ। গোপালগঞ্জ পৌরসভার পানি বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক জাকারিয়া আলম সাংবাদিকদের কাছে সেদিন অকপটে বলেছেন, ‘গোপালগঞ্জ শহর এলাকাতে ১ হাজার ৩০০ ফিট পর্যন্ত চেষ্টা করেছি কোনো এলাকাতেই ডিপ টিউবওয়েল সফল হয় না। এখানে আর্সেনিক ও লবণাক্ততার পরিমাণ এতটাই বেশি যে মানুষ এটা ব্যবহার করতে পারে না।’ আর্সেনিক ও লবণাক্ততাসহ নানা কারণে ২০০২ সালে গোপালগঞ্জ পৌর এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাটির নিচের পানির বদলে মাটির ওপরের পানি মানে মধুমতী নদীর পানি শোধন করে (সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) সরবরাহ করতে থাকে। সম্ভবত ঢাকার বাইরে কোনো জেলা শহরে সেটাই ছিল প্রথম বড় মাপের কোনো সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। তবে গত এক দশকে মধুমতীতেও লবণাক্ততা বেড়েছে অসহনীয় মাত্রায়।
এখন হয় পানির লবণাক্ততা দূর করার প্ল্যান্ট (রিভার্স অস্মসিস) বসাতে হবে, নয়তো মধুমতীর উত্তরে গড়াই-পদ্মায় পানির হিস্যা বুঝে নিতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে অথবা আধুনিক প্রক্রিয়ায় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সেটা ব্যবহারে মন দিতে হবে। গোপালগঞ্জ পৌরসভা এমন একটি প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। হয়তো অগ্রাধিকার জেলা হিসেবে অনুমতি অনুদানও মিলে যাবে। তবে কি শেষ পর্যন্ত জেলায় জেলায় আমরা সৌদি আরবের মতো পানির লবণাক্ততা দূর করার প্ল্যান্ট (রিভার্স অস্মসিস) বসিয়ে ডায়রিয়া সমস্যার সমাধান খুঁজব, না পদ্মার পানির হিস্যা আর বৃষ্টির পানি ব্যবস্থাপনার মতো টেকসই বিবেচনার কথা ভাবব?
ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনার জন্য লবণাক্ত এলাকায় চালের গুঁড়ার স্যালাইন কাজ করবে আমরা জানি। ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা শুরু হলে শরীরের পানিশূন্যতা পূরণের জন্য ওআরএস বা খাওয়ার স্যালাইন খেতে হয়। কিন্তু যেসব অঞ্চলে সব উৎসের পানি লবণাক্ত হয়ে গেছে, সেখানে খাবার স্যালাইন ঠিকমতো কাজ করে না। ওআরএসের প্যাকেটে থাকা লবণ আর লবণাক্ত পানির লবণ মিশে পানিতে গোলা ওআরএসে লবণ প্রয়োজনীয় মাত্রার থেকে বেশি হয়ে যায়, ফলে হিতে বিপরীত ফল হয়। এই পরিস্থিতিতে বাড়িতে তৈরি চালের গুঁড়ার স্যালাইন ভালো কাজ করে। আন্তর্জাতিক উদরাময় কেন্দ্র উদ্ভাবিত এই স্যালাইন বাড়িতে বানানো অনেক সহজ ও নিরাপদ।
চালের গুঁড়ার স্যালাইন বানাতে প্রথমে একটি পরিষ্কার পাত্রে আধা সেরের কিছু বেশি বিশুদ্ধ পানি নিতে হবে। এবার এতে পাঁচ চা-চামচ চালের গুঁড়া মিশাতে হবে। এরপর মিশ্রণটি ৩ থেকে ৫ মিনিট চুলায় জ্বাল দিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। সেদ্ধ করার সময় একটি পরিষ্কার চামচ দিয়ে বারবার নাড়াতে হবে। না নাড়ালে চালের গুঁড়া জমে যাবে। মিশ্রণটি চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করে রোগীকে খাওয়ানো যায়। যেখানকার পানি লবণাক্ত নয়, সেখানে মিশ্রণটি চুলা থেকে নামিয়ে এক চিমটি লবণ মিশিয়ে দিতে হবে। এটাই চালের গুঁড়ার স্যালাইন। তৈরির পর কোনো স্যালাইন ১২ ঘণ্টার বেশি রাখা উচিত নয়, ১২ ঘণ্টা পর প্রয়োজনে আবার নতুন করে স্যালাইন তৈরি করে নিতে হবে। তবে গরম বেশি পড়লে ৫ থকে ৭ ঘণ্টার বেশি সংরক্ষণ করা ঠিক হবে না। আজকাল চালের গুঁড়ার স্যালাইন বাজারেও কিনতে পাওয়া যায়, তবে তাতে লবণ মেশানো থাকায় লবণাক্ত এলাকায় সেটা তেমন কার্যকরী হবে না। গণমাধ্যমকে এসব তথ্য প্রচারে আরও অগ্রণী হতে হবে।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক গবেষক
nayeem 5508 @gmail. com