‘আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই’—অপরাধ ঘটলে, বিশেষ করে, সেটা যদি হয় হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়ংকর কিছু, তাহলে গত এক যুগে ভুক্তভোগীর স্বজনদের এই কথাটি বলা একরকম নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফৌজদারি অপরাধ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ আর তাই এর বিচার হওয়ার কথা একেবারেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিন্তু এই দেশে ভয়ংকরতম ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রেও হয় না সেটা, বিচার চাইতে হয়। আর সেটা চাইতে হয় এমন একজনের কাছে যিনি নির্বাহী বিভাগের প্রধান। এ দেশে আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিংবা ক্ষমতার পৃথক্করণ বলে যে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণই যে নির্বাহী বিভাগের হাতে, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাওয়া।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাওয়ার মতো পরিস্থিতি সবার হয় না। এই দেশের আনাচকানাচে প্রতিদিন কত খুন হয় কিন্তু কজন সেটার খবর রাখে? কটি খুনই-বা মূল ধারার কিংবা নিদেনপক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে? ভুক্তভোগী ‘ভাগ্যবান’ হলেই কেবল সেটা নিয়ে শোরগোল হয় আর তখনই হত্যাকাণ্ডের শিকার কোনো মানুষের পরিবার-পরিজনের পক্ষে গণমাধ্যমের সামনে বিচার চাওয়া সম্ভব হয়। সাগর-রুনি সেই মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। এটি ছিল বাংলাদেশের আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে একটি।
ঢাকায় নিজ বাসায় দম্পতি খুন হওয়া এমনিতেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করার মতো ঘটনা কিন্তু দুজনই স্বনামধন্য সাংবাদিক হওয়ায় বিষয়টি মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। সহকর্মী হারানো সাংবাদিকেরা তাঁদের যাবতীয় শোক ও সমবেদনাকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাটির সংবাদ ক্রমাগত প্রকাশ করেছেন, ফলে দারুণ চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল। ঘটনাটি সরকারের ওপর এতটাই চাপ তৈরি করেছিল যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঘোষণা দিতে হয়েছিল, এই হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করা হবে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। তারপর সেই ‘ঐতিহাসিক’ ৪৮ ঘণ্টা শেষ হয়ে ৮৭ হাজার ৬০০ ঘণ্টার মাইলফলক পেরিয়ে এলাম আমরা কিছুদিন আগেই।
বাংলাদেশে ঘটনার ঘনঘটা চলে। একটার পর একটা নতুন ঘটনা আসে আর চাপা পড়তে থাকে আগের ঘটনা। কিন্তু সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি আমাদের সামনে নিয়মিত বিরতিতে আসে। কিছুদিন পরপরই আমরা মিডিয়ায় দেখি, হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দিয়ে পুলিশ আদালতে গিয়ে সময় চাইছে। গত মাসেই ৮৫তম বার সেটা হয়েছে। আর তাই এই অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না যে এই তদন্ত প্রতিবেদন পেছানোর ‘খেলা’ শতক পূর্ণ করে আরও এগিয়ে যাবে।
দেশ তোলপাড় করা আরেকটি হত্যাকাণ্ড তার দশক পূর্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আসছে ৬ মার্চ ৯ বছর পূর্ণ করবে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা। বীভৎস অত্যাচার করে একজন কিশোরকে হত্যা করাটা আমাদের কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ঘটনার পরপরই পত্রিকায় সংবাদ এসেছিল, এই হত্যাকাণ্ডে নারায়ণগঞ্জের এক অতি প্রভাবশালী পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ। শুধু গণমাধ্যম অভিযোগই নয়, তদন্তকারী সংস্থাও সেটা জানিয়েছিল স্পষ্টভাবে।
দেশ তোলপাড় করা আরেকটি হত্যাকাণ্ড তার দশক পূর্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আসছে ৬ মার্চ ৯ বছর পূর্ণ করবে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা। বীভৎস অত্যাচার করে একজন কিশোরকে হত্যা করাটা আমাদের কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ঘটনার পরপরই পত্রিকায় সংবাদ এসেছিল, এই হত্যাকাণ্ডে নারায়ণগঞ্জের এক অতি প্রভাবশালী পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ। শুধু গণমাধ্যম অভিযোগই নয়, তদন্তকারী সংস্থাও সেটা জানিয়েছিল স্পষ্টভাবে। গত বছর সন্তান হত্যার ১০০ মাস পূর্তিতে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বির লেখা একটি নিবন্ধ থেকে নেওয়া নিচের অনুচ্ছেদটি পড়লেই সেটা বোঝা যাবে।
‘ত্বকী হত্যার এক বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল হাসান র্যাবের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমকে ত্বকী হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি জানান। তাঁরা কখন, কোথায়, কীভাবে, কেন এবং কে কে ত্বকীকে হত্যায় অংশ নিয়েছেন, তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে তৈরি করা একটি অভিযোগপত্র উপস্থিত সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন। তাঁরা জানান, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে তাঁরই উইনার ফ্যাশনে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছেন। সংবাদ সম্মেলনের সে সংবাদ সেদিন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল প্রচার করে এবং পরদিন তা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। র্যাব তখন অচিরেই এ অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করা হবে বলে জানায় কিন্তু তা আর হয়নি। তৈরি করে রাখা সে অভিযোগপত্র আজ পর্যন্ত আদালতে পেশ করা হয়নি।’
নবম বছর পূর্ণ করতে যাওয়া ত্বকী হত্যার প্রাথমিক বিচার শুরু হওয়া দূরে থাকুক, অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়নি। তদন্তকারী সংস্থার হাতে সব তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও সেই অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়নি, এটা একটা ন্যূনতম সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে অকল্পনীয় হলেও এটাই বর্তমানের বাংলাদেশ। শুধু কি তা-ই? হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে লেখাও ভীষণ বিপজ্জনক।
নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় সংবাদপত্র ‘সময়ের নারায়ণগঞ্জ’ ত্বকী হত্যা নিয়ে সংবাদ করে পড়েছে ভয়ংকর বিপদে। কয়েক দিন আগে পত্রিকাটির প্রধান সংবাদ ছিল, ‘যা ছিল খসড়া চার্জশিটে’। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এরপর আজমেরী ওসমানের অনুসারী নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে অনেক লোকজন গিয়ে হামলা করেন পত্রিকা অফিসটিতে। সংবাদটি কেন প্রকাশ করা হয়েছে, তার কৈফিয়ত জানতে চান হামলাকারীরা। তাঁরা বলেন, ‘তোরা আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে নিউজ করস। কালকের মধ্যে পত্রিকায় ক্ষমা না চাইলে পত্রিকা অফিস জ্বালিয়ে দেব ও সম্পাদককে গুলি করে মেরে ফেলব।’ হামলাকারীরা প্রায় ১৫ মিনিট কার্যালয়ে অবস্থান করে হুমকি দিয়ে চলে যান। এ সময় বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেন, সিসি টিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করেন, একটি কম্পিউটারের হার্ডডিস্কও খুলে নিয়ে গেছেন। কিছুদিন আগে শামীম ওসমান অবশ্য বলেছেন, তিনি ত্বকী হত্যার আদ্যোপান্ত প্রকাশ করবেন কিন্তু সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
মার্চেই আরেক অতি আলোচিত সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর পূর্ণ হবে। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত আদৌ এগোচ্ছে বলে মনে হয় না। এর তদন্ত যে ধামাচাপা পড়ে যাবে, সেটা অবশ্য বোঝা গিয়েছিল ঘটনাটি যখন ঘটে ঠিক তখনই। একটি সেনানিবাসের ভেতরে তনুর লাশ পাওয়া যাওয়ার সংবাদ প্রথমে দেশের মূল ধারার কোনো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চরম শোরগোল শুরুর পর মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সংবাদ হয়। সে ঘটনায় নতুন মিডিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুব বড়ভাবে আমাদের তার শক্তি প্রদর্শন করেছিল। অবশ্য সেই শক্তির দৌড়ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি পর্যন্তই, বাকি কিছু করার ক্ষমতা তো আর তাদের নেই, তাই কিছুই হয়নি। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি ঘটনার কথা বললাম। এ রকম ঘটনা আছে ভূরি ভূরি।
ন্যূনতম সভ্য রাষ্ট্রে যেকোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত হওয়ার কথা, অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার কথা, সুষ্ঠু বিচারের মধ্য দিয়ে শাস্তি নিশ্চিত করার কথা। এর জন্য ভুক্তভোগীর বিচার চাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে তৈরি হয়েছে ভিন্ন সংস্কৃতি। এখানে বিচার চাইতে হয়। বিচার কেবল চাইলেই হয় না, ঘটনাটিকে হতে হয় অতি আলোচিত। আবার সব আলোচিত ঘটনার যে বিচার হয়, তা-ও নয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি সামাজিক, রাজনৈতিক বা আর্থিকভাবে শক্তিশালী কেউ হন, তখন যত আলোচিতই হোক না কেন, সেই ঘটনার কোনো সুরাহা হয় না। যেমন হয়নি সাগর-রুনি, ত্বকী, মুনিয়া কিংবা তনু হত্যাকাণ্ডের। আর ‘চাঞ্চল্যকর’ হয়ে ওঠেনি বলে আমাদের সামনে আলোচনায় আসেনি, এমন হত্যাকাণ্ড তো অসংখ্য। সেগুলোর বিচারের পরিস্থিতির খবর কে রাখে?
এ ধরনের ঘটনা কেবল একজন ব্যক্তি বা পরিবারের ওপর আঘাত নয় বরং এগুলো রাষ্ট্রে আইনের শাসন বা বিচারব্যবস্থার দিকে আঙুল তোলে। অবশ্য এই আঙুল তোলায় ক্ষমতাসীনদের কীই-বা যায়-আসে? যেকোনো মূল্যে জনগণের ম্যান্ডেটহীন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে এসবই বরং ক্ষমতাসীনদের প্রধান অস্ত্র।
রিপাবলিক শব্দটির মানে আমাদের পূর্বসূরীরা করেছিলেন গণপ্রজাতন্ত্র। এখন আমার মতো অনেকেই বিশ্বাস করেন, এটা ভুল পরিভাষা। তবে এই পরিভাষা গ্রহণকারীরা নিশ্চয়ই এই রাষ্ট্রের মানুষের ‘প্রজা’ মনে করেননি, নাগরিকই মনে করেছিলেন। তাই তাঁরা সংবিধানে ঘোষণা করেছিলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে বর্তমান বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রজায় পরিণত করা হয়েছে। তাই তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিচার পান না, বিচার চান, বিচারের জন্য কান্নাকাটি করেন, রাস্তায় নেমে দাবি জানান।
আমি এখনো ভাগ্যবান, এই দেশে আমাকে এখনো কোনো প্রিয়জনের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে হয়নি। চাইলেও কী হতো, তা চারপাশে তাকালেই পরিষ্কার। বীভৎস হত্যাকাণ্ডের শিকার সাগর-রুনির মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের আলমের বক্তব্যই প্রমাণ করে, এই রাষ্ট্রের ক্ষমতার মালিকানা থাকা দূরেই থাকুক, ন্যূনতম প্রজাবৎসল রাজাশাসিত রাজ্যেও বসবাস নয় আমাদের। সেটা হলে কি নওশেরকে বলতে হতো, ‘তদন্ত সংস্থার সদিচ্ছা নেই, বিচার চেয়ে চেয়ে আমরাই এখন লজ্জিত। তাই আর বিচার চাই না’।
● রুমিন ফারহানা, বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।