হাডুডু সম্ভবত বাংলাদেশের প্রাচীনতম খেলা। খেলাটি অবশ্য বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব, সে কথা বলা যাবে না। এটা আমাদের উপমহাদেশের খেলা এবং এর পোশাকি নাম কাবাডি। প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী, বৈদিক বিদ্যালয়গুলোর ছাত্রদের শারীরিক কসরতের অংশ হিসেবেই ভারতবর্ষে এই খেলার প্রচলন হয়েছিল। ছাত্র বা তরুণদের দৈহিক শক্তিনির্ভর এ রকম আরেকটি খেলার প্রচলন রয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকায়, যার নাম রাগবি অথবা আমেরিকান ফুটবল। রাগবির জন্ম ইংল্যান্ডের রাগবি শহরের একটি খ্রিষ্টান স্কুলে। ওই খেলাটিতেও প্রয়োজন হয় প্রচণ্ড দৈহিক শক্তি। এগুলো দুর্বলের খেলা নয়। কিশোর-তরুণদের বেড়ে ওঠার বয়সটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের যদি দৌড়ঝাঁপের সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে তাদের বেড়ে ওঠাটা স্বাভাবিক না হয়ে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব অনুশীলনে আবেগ ও ক্রোধের মতো বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা গড়ে ওঠে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে তাই খেলাধুলার বিশেষ ব্যবস্থা, মাঠ, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি ছাড়া কোনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ভাবাই যায় না। তরুণদের মাদক কিংবা অপরাধজগৎ থেকে দূরে রাখার কৌশল হিসেবেও শারীরিক কসরতওয়ালা খেলাধুলাকে দেওয়া হয় আলাদা গুরুত্ব। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে মুষ্টিযুদ্ধের (বক্সিং) প্রসার ঘটারও অন্যতম কারণ এটি।
এ ধরনের দৈহিক শক্তির কসরতওয়ালা খেলাধুলা সব দেশেরই সামরিক বাহিনী বা অন্যান্য সুশৃঙ্খল বাহিনীর ব্যারাকগুলোতে নিয়মিত অনুশীলনের একটি আবশ্যিক অংশ। আমাদের দেশে যেহেতু রাগবির প্রচলন নেই এবং ফুটবলের জন্য সব জায়গায় বড় আকারের মাঠও নেই, সে কারণে অল্প জায়গায় খেলা যায় এমন একটি প্রতিযোগিতা হিসেবে হাডুডুর চেয়ে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য খেলা আর কী হতে পারে? অথচ, আমাদের একটি নিরাপত্তা বাহিনীর নবনিযুক্ত প্রধান তাঁর মন্তব্যে হাডুডু সম্পর্কে কিছুটা অবমাননাকর মন্তব্য করে সবার দৃষ্টি কেড়েছেন। তিনি ক্রসফায়ারের সমালোচকদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়েছেন যে ‘আমরা অস্ত্র ব্যবহার করব না তো কি হাডুডু খেলব?’ তাঁর এই বক্তব্যের জেরে প্রশ্ন উঠতে পারে যে পুলিশ ম্যানুয়াল অথবা তাদের বিধিমালায় হাডুডু খেলা কি নিষিদ্ধ? তাদের অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনায় কি আইন অনুসরণের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই?
নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রত্যেকেরই নিজস্ব অভিযানকালীন নির্দেশনা বা অপারেশনাল গাইড লাইনস আছে, যেগুলোর কোনোটিতেই বিনা বিচারে কাউকে এমনকি চিহ্নিত অপরাধীকেও হত্যার অনুমোদন নেই। আত্মরক্ষা অথবা সাধারণের জান-মাল রক্ষার প্রয়োজনে আইনগত কর্তৃপক্ষের আদেশ প্রতিপালনে অস্ত্রের ব্যবহার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুলিশের স্বীকৃত কৌশল। তবে এসব কৌশলের অপব্যবহার বিভিন্ন দেশে অতীতে এত বেশি পরিমাণে হয়েছে যে এখন অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে যেকোনো মৃত্যুর গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ তদন্ত অবশ্যম্ভাবী। এমনকি, নিহত ব্যক্তি যদি কুখ্যাত সন্ত্রাসী হয় অথবা সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী, তবু তার তদন্ত হবে পুলিশের বাইরের কোনো আধা বিচারিক সংস্থার দ্বারা। অথচ, আমাদের দেশে ‘কথিত’ সন্দেহভাজনকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানকালে দুর্বৃত্তদের হামলা ও গুলিবিনিময়ে সেই সন্দেহভাজনের নিহত হওয়ার কাহিনি এতই বহুল ব্যবহৃত যে এখন র্যাব ও পুলিশ নতুন নতুন কৌশল চালু করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ক্রসফায়ারের কোনো মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্ত তো দূরের কথা, বিভাগীয় তদন্তও সব ক্ষেত্রে হয় কি না, তা–ও স্পষ্ট নয়। নতুন কৌশলের মধ্যে আছে সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা পর পেট্রলবোমা ছোড়ার অভিযোগে ট্রাকচাপায় মৃত্যু (যেমনটি ঘটেছে যশোরে, তা–ও দুজনের ক্ষেত্রে) অথবা চাঁপাইনবাবগঞ্জে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির চুয়াডাঙ্গায় বোমা মারতে গিয়ে মৃত্যু। নতুন বছরে নতুন করে শুরু হওয়া রাজনৈতিক সহিংসতায় গত ৩৯ দিনে এ ধরনের ক্রসফায়ারে অন্তত ১৯ জনের মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে।
নাশকতা ও আগুনে বোমায় হত্যা বন্ধে নিরাপত্তা বাহিনীকে যে কঠোর হতে হবে, সে প্রশ্নে কারও ভিন্নমত নেই। কিন্তু তা হতে হবে আইন মেনে।
রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা না থাকলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সদস্যদের ব্যক্তিপর্যায়ের আবেগ কিংবা ক্রোধ নিরসনে হাডুডু খেলার নিয়মিত অনুশীলন যেসব সম্ভাব্য ইতিবাচক ফল দিতে পারে, সেগুলো বোধ হয় সবারই বিবেচনার সময় এসেছে। ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ফি বছর বৈশ্বিক পর্যায়ে আমাদের রেকর্ডগুলো যে ধরনের সমালোচনার মুখে পড়ে, তা এড়ানোর জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। তাহলে হয়তো আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে হাস্যকর ও অবিশ্বাস্য ব্যাখ্যা প্রদানের বিড়ম্বনা থেকে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কূটনীতিকেরা রেহাই পাবেন। এ রকম অবিশ্বাস্য ব্যাখ্যার দুটি উদাহরণ এখানে দেওয়া যায়। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের বাংলাদেশ পরিস্থিতির পর্যালোচনা (ইউপিআর) অধিবেশনে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন যে বাংলাদেশে গুম বলে কিছু নেই এবং বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটে না। আবার র্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের জবাবে গত বছরের মে মাসে লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ানদের এক সভায় বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন যে সম্ভবত ব্রিটিশ ট্রেইনারদের ট্রেনিংটা ঠিক ছিল না? কেননা, তোমরাই তো এই বাহিনী প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছ?
ক্রসফায়ার ও গুমের মতো ঘটনাগুলোয় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করলেই যে তা সবাই বিশ্বাস করবেন, এ ধারণাটি দেশের ভেতরে-বাইরে কেউই গ্রহণ করেন না। ফলে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের উৎসাহে সন্ত্রাসবিরোধী নীতির প্রয়োজনে একটি যোগ্য ও চৌকস নিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে র্যাব গড়ে তোলা হলেও ওই দেশ দুটিই এখন আর অস্ত্র-সরঞ্জাম যেমন দিচ্ছে না, তেমনি প্রশিক্ষণ থেকেও নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। ভাবনার বিষয় হলো, র্যাবের অভ্যাসটি এখন পুলিশ যেভাবে অনুশীলন করতে শুরু করেছে, তাতে করে তাদেরও একই পরিণতি ঘটতে পারে। সে রকমটি হলে অস্ত্রশস্ত্র ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য পুলিশের জন্য তখন রাশিয়া, চীন ও বেলারুশের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না।
এসব বাহিনীর যেসব কর্মকর্তা অতি উৎসাহে বা দলীয় আনুগত্যের কারণে পেশাদারত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে অমানবিক আচরণের মাধ্যমে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছেন, তাঁরা পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রশিক্ষণের সুযোগ হারানোর মতো ঝুঁকি নিচ্ছেন। জাতিসংঘে শান্তিরক্ষার চাকরিতে এসব রেকর্ড যে বিবেচনায় নেওয়া হয়, সম্ভবত সে কথাটাও তাঁরা ভুলে গেছেন। অতীতে দেখা গেছে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপির আমলে বিতর্কিত পুলিশকর্তাদের অনেকেই স্থায়ীভাবে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। যাঁরা ভবিষ্যতে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার কথা চিন্তাও করেন না, তাঁদের জন্য যখন-তখন অস্ত্র ব্যবহারের চেয়ে হাডুডু খেলাই কি শ্রেয় নয়?
বৈশ্বিক পরিসরে মানবাধিকার আন্দোলন এখন ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। ফলে কারও বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে সেটা তার জন্য ভবিষ্যতে কী ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে, তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে নেপালের পুলিশকর্তা কর্নেল কুমার লামাকে ব্রিটেনে আটক করে বিচারের সম্মুখীন করার ঘটনা। নেপালে কর্নেল লামার কাছে নির্যাতনের শিকার দুই ব্যক্তির পক্ষে একটি মানবাধিকার সংগঠনের অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে (ইউকে ডিফেন্ডস ডিসিশন টু প্রসিকিউট নেপালিজ কর্নেল ফর টর্চার, দ্য গার্ডিয়ান, ৬ জানুয়ারি, ২০১৩)।
অতি উৎসাহী পুলিশকর্তাদের এ ধরনের আচরণে রাজনীতিকদের কেউ কেউ তুষ্টি লাভ করছেন সন্দেহ নেই। যে কারণে তাঁদের কেউ কেউ এ ধরনের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাস বন্ধ না হলে এনকাউন্টারের মাধ্যমেই জবাব দেওয়া হবে (সহিংসতা দমনে এনকাউন্টারের হুমকি শেখ সেলিমের, যুগান্তর, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের এ ধরনের বক্তব্য সরকারের জন্য যে ভালো ফল আনে না, সেটা সম্ভবত এঁদের অনেকেই জেনেশুনে উপেক্ষা করছেন। অথচ, মাত্র দুই দিন আগে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) সিনিয়র গবেষক, দক্ষিণ এশিয়া প্রকল্পের পরিচালক, সামিনা আহমেদ জার্মান রেডিও ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘পুলিশ এবং সবচেয়ে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী নিরাপত্তা বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রীর আদেশ পালন করে চলেছে।’ বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিশ্লেষণ তৈরির জন্য পরিচিত ব্রাসেলসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইসিজি ৯ ফেব্রুয়ারি ‘ম্যাপিং বাংলাদেশিজ পলিটিক্যাল ক্রাইসিস’ প্রকাশের পরদিন ডয়চে ভেলের ইংরেজি অনুষ্ঠানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সামিনা আহমেদ নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যকলাপ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পরিচালিত হওয়ার কথা বললেন (বাংলাদেশ ক্রাইসিস ফাস্ট অ্যাপ্রোচিং পয়েন্ট অব নো রিটার্ন, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ডয়চে ভেলে)।
সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনের প্রয়োজনের কথা বলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেওয়ার পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা তার একটা নির্মম দৃষ্টান্ত। আশা করি, সাম্প্রতিক কালের ওই ঘটনা কেউ বিস্মৃত হননি।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।