র্যাগিং ও ছাত্রলীগের 'প্যাকের' নামতা
ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য যেদিন পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে সংগঠনের সুনাম ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন, সেদিনের পত্রিকায় ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তিন কর্মীর অপকর্মের খবর প্রকাশিত হলো। খবরটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, সেখানে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ আছে—একটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়র মোহাম্মদ নাছির উদ্দীনের ও অপরটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী। মেয়রের গ্রুপটিতে আবার ১০টি উপগ্রুপ আছে। শিক্ষা উপমন্ত্রীর উপগ্রুপ দুটি।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ১২টি উপগ্রুপ থাকলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কতটা শোচনীয় হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। গত ১০ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আটজন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন, যার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ছাত্রলীগ জড়িত। একটিরও বিচার হয়নি। ভবিষ্যতে হবে, সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
সংগঠনের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পত্রিকান্তরে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগের সুনাম ফিরিয়ে আনা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন ইস্যু ও পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। আমরা এই সুনাম ফিরিয়ে আনতে চাই, সবাই মিলে এক হয়ে কাজ করতে হবে। সবার সহযোগিতা পেলে সেটা করা সম্ভব। (কালের কণ্ঠ, ২৭ অক্টোবর, ২০১৯)।’ তাঁর দাবি, সারা দেশে ছাত্রলীগের লাখ লাখ কর্মী আছেন। কিন্তু সেই কর্মীদের কে কোথায় কী করছেন, সেই খবর নেতৃত্ব রাখে বলে মনে হয় না। তাঁর বর্ণিত লাখ লাখ কর্মীর মধ্যে নিশ্চয়ই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ওই তিন কর্মীও আছেন, যাঁরা র্যাগিংয়ের নামে এক ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই লাঞ্ছিত ও অপমান করেছেন।
একসময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভর্তির জন্য আসা শিক্ষার্থীদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো হতো। আর এখন ছাত্রলীগের কর্মীরা স্বাগত জানাচ্ছেন র্যাগিং করে। আর র্যাগিংয়ের নামে পীড়ন শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে, তা-ই নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়ে থাকে। সেই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
প্রতি বছর স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসেন, যাঁদের একাংশ র্যাগিংয়ের শিকার হন। আমরা খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তেমন র্যাগিং হয় না। তখন নানা গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত ছাত্রলীগ তাদের পক্ষে টানার চেষ্টা করে। সেখানে র্যাগিংয়ের কাজটি হয় ভর্তির সময়ই।
বরিশাল থেকে আসা এক শিক্ষার্থী উঠেছিলেন শাহজালাল হলে কোনো বড় ভাইয়ের কক্ষে। গত শনিবার বিকেলে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে গিয়েই তিন ছাত্রলীগ কর্মীর হাতে মানসিক ও শারীরিক পীড়নের শিকার হন। ওই শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলের কাছে চলে আসেন, তখনই ছাত্রলীগের তিন কর্মী ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জিহাদ হাসান, একই বর্ষের লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আরশিল আজিম ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের আরাফাত রহমান তাঁকে পাকড়াও করেন। তাঁরা যখন জানতে পারেন, তিনি ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছেন, তখন তাঁকে নিয়ে মজা করতে থাকেন। প্রথমে তাঁকে পরনের শার্ট খুলে ফেলতে বলেন। এরপর ‘প্যাকের’ নামতা পড়তে বলেন। কিন্তু ওই শিক্ষার্থী যাদব বাবুর পাটিগণিতের কথা শুনলেও ‘প্যাকের’ নামতা কখনো শোনেননি। তাই নিশ্চুপ থাকেন। প্যাক মানে কাদা। আর প্যাকের নামতা হলো একধরনের মজা ও নির্যাতনের কৌশল। যেমন প্যাক এক্কে প্যাক, প্যাক দুগুণে প্যাক প্যাক..... । সংখ্যা যত বাড়বে প্যাক কথাটি ততবার বেশি বলতে হবে। এ রকম কোনো নামতা পাটিগণিতে না থাকলেও নির্যাতনের গণিতে আছে বলে দেখা যাচ্ছে। প্যাকের নামতা না বলতে পারায় ছাত্রলীগের কর্মীরা ওই শিক্ষার্থীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। এভাবে অনেকক্ষণ চলার পর কেউ বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন। এরপর প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা এসে ওই শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেন এবং তিন ছাত্রলীগ কর্মীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন।
এক দিন পর ভর্তি পরীক্ষা। আগের দিন বিকেলে কারও এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলে কারও পক্ষেই ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করা সম্ভব নয়। ছাত্রলীগের তিন কর্মীর পীড়নের কারণে যদি ওই শিক্ষার্থী পরীক্ষায় খারাপ করেন এবং ভর্তি হতে না পারেন, তার দায় কে নেবে?
চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের তিন কর্মীর আচরণ অনেকটা কুয়ায় আটকে পড়া ব্যাঙের গায়ে দুষ্ট বালকদের ঢিল ছোড়ার মতো। কুয়ায় ঢিল ছুড়লে যে প্রাণীটি মারা যেতে পারে, তা নিয়ে দুষ্ট বালকদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা খেলাচ্ছলেই কাজটি করছিল। ছাত্রলীগের ওই কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কুয়া এবং ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীকে ব্যাঙ ছাড়া কিছু ভাবেন না।
প্রথম আলোর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সুজয় চৌধুরীকে গতকাল টেলিফোন করলাম ছাত্রলীগের ওই তিন কর্মীর সর্বশেষ অবস্থা জানতে। তিনি জানালেন, পুলিশ শনিবার রাতেই তাঁদের ছেড়ে দিয়েছে। কেননা তাদের রেকর্ড ভালো। আগে এ রকম কাজ করেননি। প্রথমবারের অপরাধ বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মার্জনা করে দিয়েছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর প্রণব মিত্র চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এ ঘটনায় কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও রাজনৈতিক নেতাদের ভাষায় কথা বলেন। তাঁরা মুখে বলেন, ছাড় দেওয়া হবে না। কিন্তু কাজ করেন উল্টো। ছাত্রলীগের ওই তিন কর্মী যেই গ্রুপের অনুসারী, সেই বিজয় গ্রুপের নেতা জাহাঙ্গীর জীবন বলেছিলেন, ‘তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাড় দেওয়া হবে না বলে ছাড় দিয়েছে। এখন দেখা যাক ছাত্রলীগের নেতা কী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেন। আর কোনো গ্রুপ ব্যবস্থা নিলেও তো সমস্যা নেই। অন্য গ্রুপ সাদরে তাঁদের কাছে টেনে নেবে।
ছাত্রলীগে এখন ‘প্যাকের’ নামতা শেখানো কর্মীদেরই পাল্লা ভারী।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]