লাখো রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশ সীমান্তে এসে আছড়ে পড়ার ছবিগুলো বিশ্বকে ধাক্কা দেওয়ার তিন বছর পার হলো। তার থেকেও দ্রুত মুছে গেল তাদের দেশে ফেরার আশা। নভেম্বরে মিয়ানমারের নির্বাচন। যে দল এই নির্বাচনে জিততে চায়, নির্বাচনের পর যে দল নেপিডোর ক্ষমতায় থাকতে চায়, ১০ লাখের বেশি মুসলিম রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার চিন্তা তারা করবে না। পশ্চিমারাও বুঝে গেছে, মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার ফল হলো দেশটাকে চীনের দিকে আরও ঠেলে দেওয়া। চীন ও তার মিত্র রাশিয়া আন্তর্জাতিক স্তরে মিয়ানমারের ঢাল হয়ে কাজ করছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও তারা তা–ই করেছে। ভেটো ক্ষমতার বলে তারা চাইলে মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপ করতে পারত।
রোহিঙ্গাদের ফিরতে না দেওয়ার অর্থ হলো তাদের পরিণতিও ফিলিস্তিনিদের মতো হয়ে যাওয়া। লেবানন ও অন্যান্য আরব দেশে তারা স্থায়ী শরণার্থী হিসেবে আটকে আছে। সেখানে তারা রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র হয়ে আছে, তাদের আছে নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন, প্রশাসন ও কর্মসূচি। রোহিঙ্গাদের বেলাতেও তেমন ঘটনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দক্ষিণ–পূর্ব বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের এশীয় সংস্করণের উদয়ের আশঙ্কা ঢাকার মাথায়ও আছে। গত বছরের জুন মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘যদি না রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের ক্যাম্পের মধ্যেই থাকে, তবে আমাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতায় চিড় ধরবে।’
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একটা প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরের বছর জাতিসংঘও রোহিঙ্গাদের জন্য গ্রহণযোগ্য প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ তৈরিতে নিয়োজিত হয়। কিন্তু স্থানীয় উদ্যোগে ফেরত যেতে পেরেছিল হাতে গোনা কয়েকজন। গত বছরের মে মাসের পর বাংলাদেশ–মিয়ানমারের যৌথ কমিটির কোনো বৈঠক হতে পারেনি। মিয়ানমারের তরফে কয়েকটা নির্ধারিত বৈঠক বাতিলের পর এক বাংলাদেশি কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, মিয়ানমার কোভিড–১৯ মহামারিকে ‘বৈঠক না করার অজুহাত হিসেবে’ ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশি দৈনিক ডেইলি স্টার জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার ৬০ হাজার রোহিঙ্গার তথ্য সংগ্রহ করে মিয়ানমারকে পাঠিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার মাত্র ৩০ হাজারের তথ্য যাচাই করেছে এবং পরে সেসবের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বাতিল করে দিয়েছে। মিয়ানমারের কাছে শরণার্থীদের তথ্য যাচাই করাই আসল বিষয়। মিয়ানমারের সরকার, শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং জনগণের বড় অংশেরই বিশ্বাস, রোহিঙ্গারা অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু তারা এটাও অস্বীকার করতে পারবে না যে শত শত বছর ধরে আজকের রাখাইন প্রদেশের উত্তরে একটা সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। কিন্তু তাদের ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয় এবং বাংলাদেশের দেওয়া শরণার্থী সংখ্যা নিয়ে মিয়ানমার একমত নয়। তবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ২০ লাখের মতো হবে। এই সংখ্যা নিয়েও তারা মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের চেয়ে অনেক কম।
সত্যিকার সংখ্যা যা–ই হোক, দরিদ্র বাংলাদেশের পক্ষে একা এত বড় বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের গবেষণা সংস্থা সিপিডি জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার বার্ষিক খরচ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ক্রমে এই খরচ বাড়ছে। কারণ, বিদেশি দাতারা তহবিল জোগানো কমিয়ে দিচ্ছে। আরেকটা হিসাব দেখাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের জন্য শরণার্থীশিবির তৈরি করতে গিয়ে বাংলাদেশের ২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির বন উজাড় হয়েছে।
বাংলাদেশের আরেক সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট জানিয়েছে, ওই এলাকায় বিদেশি সহায়তা সংস্থার কর্মীদের কারণে বাড়িভাড়া বেড়ে গেছে, অথচ কমে গেছে মজুরি। কারণ, রোহিঙ্গারা বাঙালিদের চেয়ে কম মজুরিতে কাজ করতে রাজি। এ পরিস্থিতি একদিকে রোহিঙ্গা বনাম স্থানীয় উত্তেজনায় ইন্ধন জোগাচ্ছে, তেমনি রোহিঙ্গাদের মধ্যেও মাদক পাচার, মানব পাচার ও দেহব্যবসার বিস্তার ঘটাচ্ছে।
রোহিঙ্গারা এখনো একটা ছত্রভঙ্গ বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। কিন্তু ভূরাজনৈতিক পালাবদল ঘটছে। একদিকে চীনের উত্থান, অন্যদিকে পাশ্চাত্যের তাকে মোকাবিলার আয়োজন মানবিক পরিস্থিতির চেয়ে আঞ্চলিক স্বার্থকে বড় করে তুলতে পারে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তে যে ট্র্যাজেডির জন্ম হয়েছে, তার পরিণতি হয়তো আরেকটা ফিলিস্তিন ধরনের পরিস্থিতির জন্ম।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
বার্টিল লিন্টনার সুইডিশ সাংবাদিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক