রেলের যাত্রীসেবা হোক সর্বজনীন

গণপরিবহন হিসেবে রেলের বিকল্প নেই
গণপরিবহন হিসেবে রেলের বিকল্প নেই

ঈদের দুই দিন পর ২১ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘ট্রেনের জন্য হাহাকার’। রাজশাহী রেলস্টেশনকেন্দ্রিক এই খবরটি পরিবেশন করেন প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিবেদক। এরপর ২৬ জুলাই প্রথম আলোতেই গাইবান্ধা প্রতিনিধির পাঠানো খবরের শিরোনাম ছিল ‘জনবলসংকটে ১৬টি স্টেশনে কার্যক্রম বন্ধ’।
বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীসেবা-উদ্দিষ্ট বিবেচনায় নিলে বলতেই হবে যে এ দুটি খবরের মধ্যে গুরুতর বৈপরীত্য রয়েছে। অর্থাৎ, যাত্রীরা যখন বেশি করে ট্রেনের দিকে ঝুঁকছে, তখন রেলওয়ে অনেক স্থানেই তার কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলছে।
অনেকেই একমত হবেন যে প্রথম খবরটি রাজশাহীকেন্দ্রিক হলেও সারা দেশের চিত্র একই রকম। আর ঈদের কারণে ট্রেনের টিকিটের চাহিদা বেড়েছে এমনটিও নয়। নিরাপদ ও সাশ্রয়ী ভ্রমণের সুযোগ থাকায় ট্রেনের প্রতি যাত্রীদের আগ্রহ আগে থেকেই ছিল। এখন বরং তা কয়েক গুণ বেড়েছে। ঘন ঘন সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট, সড়ক পরিবহন ধর্মঘট, বেশি ভাড়া আদায়—এসব এড়াতে যাত্রীরা বাস ছেড়ে ক্রমেই ট্রেনের দিকে ঝুঁকছে। এমনকি দুই বছর আগে ট্রেনের যাত্রীভাড়া প্রায় দ্বিগুণ করার পরও যাত্রীদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি। রাজশাহীর উদাহরণ টেনেই বলা যায়, এখান থেকে সপ্তাহে এক দিন বিরতিসহ ঢাকার উদ্দেশে প্রতিদিন তিনটি করে ট্রেন ছেড়ে যায়। এই ট্রেনগুলোর টিকিট না পেয়ে যত যাত্রী ফিরে যায়, তা হিসাবে নিলে দেখা যাবে যে একই রুটে দিনে অন্তত আরও তিনটি ট্রেনের চাহিদা রয়েছে।
দ্বিতীয় খবরটিতে যে ১৬টি স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধের কথা বলা হয়েছে, তা কেবল একটি রুটের চিত্র। এই রুটটি সান্তাহার-লালমনিরহাট রুট। খবরে বলা হয়েছে, এ রুটের ৩১টি স্টেশনের মধ্যে ‘অন্তত ১৬টির অপারেশনাল ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ’। দক্ষিণের বৃহত্তর খুলনা-যশোরসহ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ নিয়ে গড়ে উঠেছে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল। এ অঞ্চলে দুটি ডিভিশন—লালমনিরহাট ও পাকশী। ডিভিশন দুটিতে ছোট-বড় ১৫টির বেশি রুট রয়েছে। প্রতিটি রুটের অবস্থাই লালমনিরহাট-সান্তাহার রুটের মতো।
এ তথ্যের সত্যতা মেলে ২৬ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত আরেকটি খবর থেকে। খবরটির শিরোনাম: ‘গুয়াখড়া স্টেশন ছয় বছর ধরে বন্ধ, জনদুর্ভোগ’। খবরে পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিবহন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, প্রধানত জনবলের সংকটের কারণে বিভাগের ১১৩টি স্টেশনের মধ্যে ৪২টি সম্পূর্ণভাবে এবং ১৭টি আংশিকভাবে বন্ধ আছে। অনেকে নিশ্চয়ই এ ব্যাপারেও একমত হবেন যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চালচিত্রও একই রকম। অর্থাৎ, সারা দেশের বিভিন্ন রেলরুটে অপেক্ষাকৃত ছোট স্টেশনগুলোর কার্যক্রম হয় ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, নয়তো বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
অতিসম্প্রতি রেলওয়ের সেবার মান কিছুটা উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে এর টাইম শিডিউল এখন অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেললাইন আগের চেয়ে ভালো হওয়ায় গতিও কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু এ সবই হয়েছে দূরপাল্লার ট্রেনের ক্ষেত্রে, যার সুবিধা ভোগ করছে দেশের হাতে গোনা কয়েকটি শহরের সৌভাগ্যবান যাত্রীরা। বাদবাকি সারা দেশের বিপুলসংখ্যক আমজনতা এই ‘উন্নয়নের’ আওতার বাইরেই রয়ে গেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বন্ধ হয়ে যাওয়া ওই স্টেশনগুলোর সবই হলো আমজনতার মফস্বলের স্টেশন, যেখানে এখন আর ‘নটার ট্রেন কটায় যায়’ অবস্থাটাও নেই।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের নাগরিকদের করের পয়সাতেই চলে রেলওয়ে। আমাদের এ তথ্যও জানা আছে যে বছরের পর বছর রেলওয়ে একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে আছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সাধারণের কল্যাণের স্বার্থে রেলওয়ের জন্য ভর্তুকি গুনতে হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সব প্রতিষ্ঠানকেই মুনাফা করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। পৃথিবীব্যাপী সাধারণের স্বার্থে সব রাষ্ট্রই এক বা একাধিক খাতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। কিন্তু এই ভর্তুকি তো যুক্তিগ্রাহ্য হতে হবে। সাশ্রয়ী হওয়ায় এই উপমহাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই ট্রেন হলো সাধারণের বাহন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ট্রেনের কথিত উন্নয়ন ‘তেলা মাথায় তেল ঢালা’র পথে হাঁটছে। যাদের হাতের নাগালে বিমান আছে, বিলাসবহুল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস আছে, তাদের দিকেই ঝুঁকছে ট্রেন। এই ঝোঁকটা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু যা ঘটছে, তা একপেশে ও বৈষম্যমূলক। মফস্বলকে পেছনে ফেলে রেলের এই সদরযাত্রাকে আর যা-ই বলা যায়, উন্নয়ন বলা যায় না।
‘গুয়াখড়া স্টেশন ছয় বছর ধরে বন্ধ’—এ খবরটি জেনে খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। বন্ধ স্টেশনটি ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রুটে। এই রুটেই সিরাজগঞ্জের দিকে মাত্র কয়েকটি স্টেশন পরে গুয়াখড়ার মতোই আরেকটি ছোট রেলস্টেশন আছে। নাম সলপ, যে স্টেশনকে ঘিরে রয়েছে আমাদের ছেলেবেলার রেলভ্রমণের নানা স্মৃতি। ১৯৬০-৬১ সালের কথা। ঢাকা থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হয়ে রেলওয়ে ফেরিতে যাত্রীরা যমুনা পার হয়ে সিরাজগঞ্জে এসে আবার ট্রেনে চাপতেন। এ রকম একটা ট্রেন রাত সাড়ে নয়টার দিকে সলপ স্টেশনে আসত। আমরা সেই ট্রেনে উঠে ঈশ্বরদী স্টেশনে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ভোরবেলায় যখন ঘুম ভাঙত, তখন দেখতাম ট্রেনটি পূর্ব পাকিস্তানের দর্শনা বা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গেদে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যেত। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়ে যেত বিকেল। আন্তদেশীয় ও দূরপাল্লার ট্রেন হওয়া সত্ত্বেও ওই ট্রেনটি ছোট-বড় সব স্টেশনে দাঁড়াত এবং প্রতিদিনই চলত এই ট্রেনটি। এতে অতিসাধারণের সেবাও নিশ্চিত হতো। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ওই ধরনের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সরাসরি ট্রেন চালু হতে ৪২ থেকে ৪৩ বছর লেগে গেল। এখন ঢাকা থেকে মৈত্রী এক্সপ্রেস ওই একই রুটে কলকাতায় যায়। ট্রেনটি সপ্তাহের সব দিন চলে না। আর সলপ-গুয়াখড়া স্টেশনের মতো স্থানে দাঁড়ানো দূরে থাক, বড় স্টেশন এমনকি ঈশ্বরদীর মতো বড় জংশন স্টেশনেও দাঁড়ায় না ট্রেনটি। শুনেছি, মৈত্রী এক্সপ্রেসে প্রত্যাশিত যাত্রী মেলে না। ৫০ বছর আগে যখন পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি, তখন প্রতিদিন কলকাতার ট্রেনে যাত্রী মিলত। এখন সেই একই ভূখণ্ডে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৬ কোটি ছাড়িয়েছে, অথচ কলকাতার ট্রেনে যাত্রী নেই। যাত্রীরা কি সবাই স্বেচ্ছায় আকাশ বা সড়কপথে কলকাতা যেতে চায়? নাকি যেতে বাধ্য হয়? মৈত্রী ট্রেন অন্তত বড় স্টেশনগুলোতে দাঁড়ালেও এখন দিনে দুই থেকে তিনটি কলকাতাগামী ট্রেনের চাহিদা রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
সলপ বা গুয়াখড়ার মতো স্টেশন, যেখানে ৬০ থেকে ৬৫ বছর আগে দূরপাল্লার আন্তদেশীয় ট্রেন দাঁড়াত, সেখানে এত দিন পরও দেশের অভ্যন্তরের আন্তনগর ট্রেনগুলো পর্যন্ত থামে না। আমরা আন্তনগর ট্রেনে গ্রামের বাড়িতে যেতে চাইলে আর সলপ স্টেশনের মতো স্থানে নামতে পারি না। ওই সব স্টেশনের আশপাশের যাত্রীরাও একই কারণে আন্তনগর ট্রেনের নাগাল পায় না। দু-একটি স্থানীয় ভাঙা ট্রেন এসব স্টেশনে থামলেও তার সেবার মান এমন যে মানুষ বাধ্য হয়েছে ট্রেনবিমুখ হতে।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চলাচল অনেক গুণ বেড়েছে। বেড়েছে তাদের সামর্থ্যও। কিন্তু অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ট্রেনভ্রমণের অধিকার থেকে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ আজ বঞ্চিত। এ কথা ঠিক যে সব স্টেশনে দাঁড়ালে গন্তব্যে পৌঁছাতে ট্রেনের সময় বেশি লাগবে। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান সহজেই সম্ভব। কোনো কোনো ট্রেন সরাসরি এবং কোনো কোনোটি সব স্টেশনে বিরতি দিয়ে চালানো যায়।
স্বাধীনতার আগে থেকেই ট্রেনের অবকাঠামো এ এলাকায় ছিল। ট্রেন সব সময় সব দেশেই সাধারণের বাহন। প্রতিবছর অল্প অল্প বিনিয়োগ করলেও আজ রেলপথের ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অটোমোবাইল ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষাকারী সিন্ডিকেট ইচ্ছাকৃতভাবে এই খাতে অবহেলা দেখিয়েছে। রেলকর্মীরাও খুব একটা দায় এড়াতে পারেন না।
রেলওয়ের প্রতি বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট ইতিবাচক। পৃথক রেল মন্ত্রণালয় স্থাপনসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ সেই দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই যমুনা সেতুতে রেললাইন সংযোজন সম্ভব হয়। যদিও মূল পরিকল্পনায় না থাকায় যমুনা সেতুর রেললাইনটি যথেষ্ট নাজুক। রেলকে গতিশীল করতে হলে যমুনায় জরুরি ভিত্তিতে পৃথক রেলসেতু নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি সিঙ্গেল ট্র্যাকের স্থলে ডাবল ট্র্যাক নির্মাণও রেলওয়েকে গতিশীল করার আবশ্যিক শর্ত। মিটারগেজ-ব্রডগেজের জটিলতা এড়াতে সব রুটে অবিলম্বে মিশ্রগেজের ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি। সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সেই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কানেকটিভিটি বাড়ানোর সাম্প্রতিক উদ্যোগের ফলে রেলওয়ের প্রকৃত উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। এসব সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে এসে সাধারণ মানুষ রেলওয়ে সেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, এমনটা আমরা কখনোই প্রত্যাশা করি না।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।