ইউক্রেনে রুশ সেনা অভিযানের একটা বাংলা নাম দেওয়া যায়—হাডুডু অভিযান। যেকোনো যুদ্ধই মর্মান্তিক এবং বীভৎস রকম ট্র্যাজিক। তবু বোঝার সুবিধার জন্য হাডুডু খেলার আদলে এই যুদ্ধকে বুঝে দেখা যেতে পারে। হাডুডু খেলায় প্রতিপক্ষের সীমানায় ঢুকে তাদের খেলোয়াড়দের ছুঁয়ে দিয়ে ফিরে আসাকেই জয় বলে ধরা হয়। প্রতিপক্ষের কোর্ট দখল করা এই খেলার উদ্দেশ্য নয়। যাকে ছুঁয়ে দেওয়া হবে, সে পরাজিত হবে। সে চলে যাবে কোর্টের বাইরে। শুধু ছুঁয়ে দিলেই হলো না; দম ধরে রেখে নিজের কোর্টে ফিরে আসতে পারতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া দম ধরে রেখে ইউক্রেন থেকে ফিরে আসতে পারবে তো? নাকি আটকে যাবে আফগানিস্তানে যেমন গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তান ও ইরাকে আগ্রাসনকে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধই বলেছিল। তবে রাশিয়া তার আক্রমণকে পুরোপুরি যুদ্ধ বলছে না। পুতিনের ভাষায় এটা হলো ইউক্রেনকে নিরস্ত্র করা এবং সেখানে ছড়িয়ে পড়া ‘নাৎসিবাদী ভাড়াটে যোদ্ধাদের’ নির্মূল করার ‘স্পেশাল’ অভিযান। অর্থাৎ রাশিয়ার দৃষ্টিতে এটা তার নিজস্ব সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ, যে সন্ত্রাস চালানো হচ্ছিল ইউক্রেন থেকে আলাদা হওয়া যমজ শিশুরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের রুশভাষীদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু বাস্তবে অভিযানটা আর আত্মরক্ষামূলক নেই। পুরোপুরি যুদ্ধের চেহারা নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও ইউক্রেনের ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা পাওয়া কঠিন। রুশ বয়ানে ভরসা রাখারও কারণ নেই। কিন্তু যেখানে পশ্চিমা দুনিয়া একে তথ্য বিশ্বযুদ্ধে পরিণত করেছে, বিশ্বের সব বড় মিডিয়া যখন এক সুরে কথা বলছে, যখন ফেসবুক নিজের নীতিমালা ভেঙে রাশিয়া ও পুতিনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সহিংসতার উসকানির অবাধ সুযোগ খুলে দিয়েছে, তখন কোথায় গেল সেইসব ইউরোপীয় মূল্যবোধ?
এ অবস্থায় দেশে দেশে দস্যুতা ও আগ্রাসনের জন্য যাঁরা আমেরিকাবিরোধী হয়ে আছেন, তাঁরা রাশিয়ার পক্ষে হেলে পড়ছেন। ইরাক-আফগানিস্তান-সিরিয়া-হাইতি-পানামার ঘটনায় যাঁদের মন আগেভাগেই বিষিয়ে আছে, তাঁদের বিবেক মার্কিন বয়ানে সাড়া দিতে চাইছে না। পাশ্চাত্যের নোয়াম চমস্কি, স্লাভোয় জিজেক, জন মার্শমিয়ারের মতো অধ্যাপকেরা যুদ্ধের নিন্দা করলেও সব দায় একা পুতিনকে দিচ্ছেন না। এই জটিল মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিন দার্শনিক হামিদ দাবাশি কিংবা আল-জাজিরার মারওয়ান বিশারার লেখালেখিতে। মারওয়ান বিশারা এককথায় এই মনোভাবকে প্রকাশ করেছেন: ইউক্রেনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নে বিভক্ত।
অনেক রাষ্ট্রের জন্য এটা উভসংকট। এই উভয়সংকট থেকে জার্মানি পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পেরেছে, তা বলা যায় না। তেলের দাম ১৩০ ডলারে ওঠার পর জার্মানি, বুলগেরিয়া ও ফ্রান্সসহ আরো কিছু ইউরো-দেশ বলছে রুশ তেল-গ্যাস ছাড়া তারা চলতে পারবে না। ব্রিটেনের মতো করে ফ্রান্সও যুক্তরাষ্ট্রের মোসাহেবগিরি করতে নারাজ। ন্যাটো’র ফাটল চোখে পড়ে যাচ্ছে্।
খোলাখুলি পুতিনের পক্ষেও কম দেশই আছে। আমেরিকার চিরবন্ধু মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাধর দেশগুলো কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পালে এবার আর হাওয়া দিচ্ছে না। তারা এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বহুমুখী করার পথে। ইরান-ভেনেজুয়েলাও তেল বেচছে না যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। মওকামতো সৌদি জোটও যদি বেঁকে বসে, তাহলে রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাম অনেক চড়া হয়ে যাবে। সৌদিদের পক্ষে টানতে এর মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সৌদি আরবে ছুটেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যে সমৃদ্ধি ইউরোপকে শান্তি দিয়েছে, তাতে টান পড়ছে। এই অবস্থা দীর্ঘদিন চললে অনৈক্য, অসন্তোষ আর অস্থিরতা ইউরোপকে অশান্ত করে তুলতে পারে। পুতিন রয়েসয়ে আক্রমণ করছেন যাতে বেসামরিক নাগরিকেরা সরে যেতে পারে এবং যাতে ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন উদ্বাস্তুর চাপে ইউরোপের অর্থনীতি আরও কাবু হয়ে যায়।
পুতিন অবশ্যই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লংঘন করে নৈতিক অপরাধ করেছেন, কিন্তু কৌশলগতভাবে কতটা ভুল করেছেন, তা বলার সময় এখনো আসেনি। শেষ পর্যন্ত এটা দমেরই খেলা। ইউক্রেনীয় ফ্রন্টে কার দম আগে ফুরোবে, পুতিনের সেনাদের নাকি জেলেনস্কির জোড়াতালি প্রতিরোধের? রুশ আক্রমণের মুখে দুই সপ্তাহ টিকে থেকে তিনি যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন।
মহামারি সামলে নাজুক হয়ে পড়া ইউরোপীয় অর্থনীতির পিঠে অর্ধকোটি শরণার্থীর ভার চাপিয়ে দিতে পারলে ইউরোপের সঙ্গে দর-কষাকষিতে রাশিয়ার সুবিধা হবে। এটা হবে অর্থনৈতিক অবরোধের প্রতিশোধ। এখন আইএমএফের লোকেরাও বলছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অবরোধের মাশুল ইউরোপকেও ভালোমতোই দিতে হবে। আন্তর্জাতিক বিনিময়ের মুদ্রা হিসেবে ডলারের একচেটিয়া অবস্থানও টলে যাবে। ইতিমধ্যে রাশিয়া, চীন, কাজাখস্তান, কিরঘিসস্তান, বেলারুশ, আর্মেনিয়া মার্কিন শাসিত অর্থব্যবস্থার বাইরে স্বাধীন মুদ্রাব্যবস্থা গঠনে একমত হয়েছে। ইরান, ভেনেজুয়েলা, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশও এর জন্য অপেক্ষমান। দেশগুলি নিজেদের মধ্যে মুক্তবাজার চালু করবে। সম্ভবত চীনা ইউয়ান হবে তাদের বিনিময় মুদ্রা। এদিকে ভারত মার্কিন হুশিয়ারি উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে। অবশ্যই এই বিনিময় ডলারে হবে না। ইউক্রেন যুদ্ধের ফল যাই-ই হোক, ডলারের একচেটিয়া কারবারের দিন শেষ হতে চলেছে। ইউরোপের মাটিতে যুদ্ধের পরিণাম সুদূরপ্রসারী।
ন্যাটো ব্লকের বিভক্তিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল রাশিয়া। কিন্তু প্রশ্ন হলো ঠিক এখনই কেন তারা দুর্বল প্রতিবেশীর ওপর হামলে পড়ল? সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন। বাইডেন বলে দিয়েছেন, একজন মার্কিন সেনা বা একটি প্লেনও ইউক্রেনে পাঠানো হবে না।
পুতিন নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, সংক্ষিপ্ত সামরিক অভিযান দিয়েই ইউক্রেনীয় কেল্লা ফতে করে ফেলবেন। কার্যত বিমান আক্রমণ ছাড়াই ইউক্রেনের সামরিক সামর্থ্যকে অকার্যকর করা গেছে। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং অস্ত্রের জোগান আটকে দিয়ে। কিন্তু ইউক্রেন নিয়েছে অপ্রচলিত যুদ্ধের পথ। নাৎসিবাদী বলে পরিচিতি পাওয়া আজভ ব্যাটালিয়নের মিলিশিয়ারা জনবসতির মধ্যে অবস্থান নিয়েছে। সাধারণ মানুষের হাতেও অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের আইসিসের ভাড়াটে যোদ্ধাদেরও ইউক্রেনে ঢোকানো হচ্ছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি বলেছেন, বিদেশি যোদ্ধাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এসব কথা প্রমাণ করে যে, তিনি ন্যাটোর কাছ থেকে পরিত্যক্ত বলে বোধ করছেন।
এ কারণে সামরিক বাহিনী দিয়ে রাজধানীসহ বড় শহরগুলো ঘেরাও করে রেখে চালানো হচ্ছে বিশেষ পুলিশি অভিযান। এদের কাজ হবে রুশ বাহিনীর ওপর গুপ্ত হামলাকারীদের খুঁজে বের করা। মনে রাখতে হবে, আমেরিকার প্রধান যুদ্ধকৌশল যেখানে রণতরি বা নৌবাহিনীকেন্দ্রিক, রুশ কৌশল সেখানে ভূসেনাকেন্দ্রিক। তা ছাড়া ইউক্রেনে ইরাকের মতো ধ্বংসলীলা চালানো রাশিয়ার লক্ষ্য নয়। সেটা করতে চাইলে বিমান হামলা দিয়েই তা তারা করে ফেলতে পারত। কিন্তু ইউক্রেনে বিমানবাহিনীকে এখনো তারা ততটা ব্যবহার করেনি। রাশিয়া সম্ভবত চাইছে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যেতে বাধ্য করে ফাঁকা শহরে সেনা অভিযান পরিচালনা করতে, যাতে বেসামরিক প্রাণহানি অল্প হয়।
পুতিন অবশ্যই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লংঘন করে নৈতিক অপরাধ করেছেন, কিন্তু কৌশলগতভাবে কতটা ভুল করেছেন, তা বলার সময় এখনো আসেনি। শেষ পর্যন্ত এটা দমেরই খেলা। ইউক্রেনীয় ফ্রন্টে কার দম আগে ফুরোবে, পুতিনের সেনাদের নাকি জেলেনস্কির জোড়াতালি প্রতিরোধের? রুশ আক্রমণের মুখে দুই সপ্তাহ টিকে থেকে তিনি যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। ন্যাটো না এলেও এখন তাঁর পক্ষে বাজি ধরার মানুষ বেড়ে গেছে। তিনটি বলকান রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কিয়েভ সফর তারই আলামত। রুশ-ইউক্রেন আলোচনার টেবিলে তিনি এখন দরকষাকষি করার সামর্থ্য রাখেন।
ইউক্রেনকে বাঁচানোর পথ একাধিক ছিল না পশ্চিমাদের হাতে। হয় ন্যাটোকে লড়াইয়ে নেমে পড়তে হতো। এর পরিণতি হতো পারমাণবিক আশঙ্কাসমৃদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় পথ ছিল, ২০০৮ সাল থেকে রাশিয়ার দাবি করা নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিয়ে দেওয়া। পুতিন তখন থেকেই ন্যাটোর পূর্বমুখী বিস্তারকে রাশিয়ার ‘অস্তিত্বের জন্য হুমকি’ বলে সোচ্চার ছিলেন। আমেরিকা শোনেনি। ২০১৪ সালে মার্কিন তহবিল ও গোয়েন্দা সহায়তায় ইউক্রেনের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের সময়ও রাশিয়া সতর্ক করেছিল। এবারও মাসাধিককাল ধরে সেনাসমাবেশ করে বোঝাতে চেয়েছিল, ন্যাটো ঠেকাতে কতটা মরিয়া রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র যদি তখন রাশিয়ার নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিতে রাজি হতো, তাহলে সম্ভবত রাশিয়াকেও তার প্রতিবেশীদের জন্য হুমকি হওয়া থেকে বিরত রাখা যেত্। তাহলে ন্যাটো আর রাশিয়ার মাঝে বাফার বা নিরপেক্ষ অঞ্চল দেখা যেত। বিশ্বও এ রকম যুদ্ধের মুখে মানবিক টানাপোড়েনে ভুগত না।
রাশিয়ার দাবির মুখে বধিরের মতো আচরণ করা তো কূটনীতি না। কূটনৈতিক সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী ছিল না। বরং পেন্টাগন চেয়েছে ইউক্রেনকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে রাশিয়াকে ফাঁদে ফেলতে। তারা ইউক্রেনকে উশকালো রাশিয়াকে চটাতে। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিল। ইউক্রেন হয়ে গেল ন্যাটোর টোপ। ইউক্রেন বাঁচল কি মরল, তা আমেরিকার মাথাব্যথা নয়। পেন্টাগনের ইতিহাস বলে, তাদের একমাত্র লক্ষ্য প্রতিপক্ষের প্রধান মাথাটিকে কেটে ফেলা। এভাবেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ছলে-বলে-কৌশলে পরাস্ত করে উপহার দিয়েছিল মাতাল ইয়েলেৎসিনের দুর্বৃত্ত শাসন। এখন তারা চায় পুতিনসহ রাশিয়ার বর্তমান শাসকচক্রকে সমূলে উচ্ছেদ করতে। তার জন্য ইউক্রেনীয় মাটিতে রাশিয়াকে টেনে আনা তাদের বহুদিনে তৈরি করা পরিকল্পনা। জেলেনস্কির পুরো আমলেই এই প্রস্তুতি নিয়ে গেছে। সেখানে সেনা বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষক, গোয়েন্দা সরঞ্জাম, অস্ত্র ও ভাড়াটে সৈন্য পাঠিয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পদে জেলেনস্কিকে বসাতে পাঁচ বিলিয়ন ডলার খরচের কথা মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুলান্ড স্বীকারও করেছেন, এ মর্মে ফোনালাপও ফাঁস হয়েছে।
মানবসভ্যতার মূলে সহাবস্থান নয়, ধ্বংসের প্রেরণাই বোধ হয় বেশি। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড মানুষকে ভাষাধারী পশু মনে করতেন। এসবের মধ্যে পড়ে মানুষ থাকার সংগ্রামে আমাদের ভাবতে হচ্ছে কোন পক্ষ কম নিষ্ঠুর? বিশ শতকের মর্মান্তিক পরিহাস হলো এটাই।
আমেরিকা চেয়েছে ইউক্রেনে রাশিয়াকে এমনভাবে পরাজিত ও নিন্দিত করে তুলতে, যাতে খোদ মস্কোতে পুতিনের ক্ষমতার খুঁটি নড়বড়ে হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে প্রস্তুতকৃত গণবিক্ষোভ অথবা সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি উচ্ছেদ হন। সবাই জানে, এসব কাজে আমেরিকার মুনশিয়ানা শৈল্পিক পর্যায়ের। ইউক্রেনীয়দের অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ চালানোর অর্থ হলো রাশিয়া যাতে ইউক্রেনে ব্যাপক ধ্বংস ও হত্যাকাণ্ড চালায়। এ সবকিছুই প্রমাণ করে, ইউক্রেনকে রুশ ভালুকের জন্য মরণফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমেরিকার কাছে এর বেশি গুরুত্ব জেলেনস্কি বা তাঁর দেশবাসীর আছে বলে ঘটনা প্রমাণ করে না।
এদিকে রাশিয়ারও হারানোর কোনো উপায় নেই। যদি কোনো কারণে রুশ বাহিনীর পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়, তাহলে রাশিয়া তার আসল মারণাস্ত্রগুলো বের করবে। আহত পরাশক্তির আচরণ এটাই হয়। তারা হারতে জানে না। কারণ, হারের মূল্যটা অনেক বেশি। তাই পশ্চিমাদের উচিত ছিল সমস্যাটাকে কারও জন্যই অস্তিত্বের সংকটে পরিণত হতে না দেওয়া।
রাশিয়াও অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ভুল করেছে। তার আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি ভেবে থাকে তারা জিতছে, তাহলে পুতিনের ভুলটাই তারা করবে। আমেরিকা সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নব্বইয়ের আমেরিকা আর নেই। তাদের প্রধান জোর আর রাজনীতি কিংবা সমরশক্তি নয়। বিশ্ব জনমতও আগের মতো তাদের কথায় দোলে না। তাদের শক্তিটা হলো গণমাধ্যম তথা তথ্য সাম্রাজ্য এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ।
রাশিয়াকে হারতে দিতে পারে না চীনও। কারণ, তাতে তার বিশ্বপরিকল্পনা পুরোপুরি ভেস্তে যাবে; বরং এই যুদ্ধে কাবু রাশিয়াকে তারা তাদের শর্তে আপন পক্ষে রাখতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনকে মোকাবিলার সক্ষমতা হারাবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কেবল করোনায় কাতর বিশ্ব অর্থনীতিকে শুইয়ে ফেলছে না, ডলারকেন্দ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাকেই ভেঙে ফেলছে না, তা আমেরিকাকেও টেনে নামাচ্ছে সংকটের ঘূর্ণিপাকে। আমেরিকার বিশ্ব নেতৃত্ব হারানোর ভয়, ইউক্রেনীয়দের জীবনের চেয়ে বেশি।
ইউক্রেনেরও বিজয়ী হওয়ার উপায় নেই। রাশিয়া যদি ইউক্রেনকে দখল করে রাখতে চায়, তাহলে রাশিয়ার পরিণতিও যুক্তরাষ্ট্রেরই মতোই হবে। পুতিন সেটা নির্ঘাত জানেন। এ কারণেই ইউক্রেন থেকে দ্রুত তাদের বের হয়ে আসা দরকার। মনে হচ্ছে রাশিয়া দখলদারি নয়, ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ হতে বাধ্য করার মিশন নিয়েছে। এ কারণেই ইউক্রেনীয় বরফে রুশ ভালুককে আটকানোর কৌশল কাজ করার কথা না।
মানবসভ্যতার মূলে সহাবস্থান নয়, ধ্বংসের প্রেরণাই বোধ হয় বেশি। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড মানুষকে ভাষাধারী পশু মনে করতেন। এসবের মধ্যে পড়ে মানুষ থাকার সংগ্রামে আমাদের ভাবতে হচ্ছে কোন পক্ষ কম নিষ্ঠুর? বিশ শতকের মর্মান্তিক পরিহাস হলো এটাই।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]