যখন মনে হচ্ছিল যে সিরিয়ার যুদ্ধ আর জটিল আকার ধারণ করছে না, ঠিক তখনই ভূমধ্যসাগরের আকাশে সিরীয় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে একটি রুশ গোয়েন্দা বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা এ যুদ্ধকে জটিল করে তুলল। ইসরায়েলের বোমারু মনে করে সিরিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা ইউনিট এই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলে সেটি গিয়ে রুশ বিমানকে আঘাত করে।
এমন একটি দিনে এই রুশ বিমান ভূপাতিত হয়, যেদিন রাশিয়ার পর্যটননগরী সোচিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মধ্যে তুরস্কের ইদলিব প্রদেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য চেচেন, উইঘুরসহ জিহাদি চরমপন্থীদের এবং অন্য বিদেশিদের পাশাপাশি সিরিয়ার উগ্রবাদীদের নিরস্ত্র করার ব্যাপারে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়।
এসব ঘটনায় দুটি বিষয় বোঝা গেল। একটি হচ্ছে ২০১১ সালে সংস্কারের জন্য সিরিয়ায় যে বাইরের হস্তক্ষেপের সূচনা হয়েছিল, এখন তার বিস্তার ঘটেছে। আরেকটি হলো কেন্দ্রীয় ও অপরিহার্য ভূমিকা, যা এখন রাশিয়া পালন করছে। রাশিয়া সিরিয়ার দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে ইসরায়েল অধিকৃত গোলান এলাকার কাছে সামরিক পুলিশ মোতায়েন করেছে। ইসরায়েলিদের উসকে দেবে—ইরানপন্থী জঙ্গিদের এমন যেকোনো আচরণ প্রতিহত করার জন্য এই সামরিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। রাশিয়া একসময় সিরিয়ায় ইরানের উপদেষ্টাদের ওপর ইসরায়েলের বিমান হামলা বিষয়ে ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন করেছিল। এখন রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর তারা এখন ইসরায়েলের প্রতি যারপরনাই ক্ষুব্ধ।
তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কটা সমানভাবে বহুমুখী। ইদলিবসহ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের ভূখণ্ডে তুরস্কের দখলদারত্বের নিন্দা জানায় রাশিয়া, আবার একই সঙ্গে জিহাদিদের নিরস্ত্র করার জন্য তারা সিরিয়ার শহরগুলোয় তুরস্কের উপস্থিতিকে সমর্থন করছে। এক দিকে তারা সিরিয়ার জনগণকে রক্ষার কথা বলছে, অন্য দিকে বিদ্রোহ দমনের নামে ইদলিব শহরে বিমান হামলা চালাচ্ছে, যাতে নিহত হচ্ছে বেসামরিক লোকজন। সোচির সমঝোতা চুক্তি বাস্তবায়িত হবে কি না, তা এখন দেখার বিষয়। কেননা, তুরস্ক এর আগেও চরমপন্থীদের দমন করার অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু সেই অঙ্গীকার এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি।
তবে সিরিয়ার এই যুদ্ধের জন্য পশ্চিমা সরকারগুলোও দায়ী। ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তারা জিহাদি চরমপন্থীসহ যুদ্ধরত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সাহায্য ও অর্থায়ন করেছে। যুদ্ধবিরতির জন্য তাদের আহ্বান বেসামরিক লোকজনকে নয় বরং বিদ্রোহীদের সাহায্য করার জন্য।
ইদলিবে ২০ লাখ বা তার চেয়ে বেশি বেসামরিক লোককে সুরক্ষা দেওয়ার ভালো উপায় আছে। এদের অনেকে অস্থায়ী শিবিরে বা এর চেয়েও খারাপ জায়গায় আছে। সিরিয়ায় একটি রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়া দরকার, যার অধীনে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করবে। সিরীয় সরকার গত দুই বছরে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে ১০০টিরও বেশি আত্মসমর্পণ চুক্তি নিয়ে কথা বলেছে। ‘রিকনসাইলেশন অ্যাগ্রিমেন্টস’ নামে এসব চুক্তির আওতায় অবরুদ্ধ এলাকাগুলো থেকে বিদ্রোহীদের সরে যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। এদের বেশির ভাগই ইদলিবে সরে গেছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সিরীয় বাহিনী বিদ্রোহীদের এমনকি রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্র সঙ্গে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় এবং সরকারি বাসে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়।
সশস্ত্র যোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের পরিবারের হাজার হাজার সদস্য ও অন্যান্য বেসামরিক লোকও যায়। যার ফলে ইদলিব এখন বাস্তুহারা লোকজনে পরিপূর্ণ। সিরিয়ার যুদ্ধ কখনোই আসাদ–সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সাধারণ যুদ্ধ ছিল না। বাইরের দেশগুলো এই যুদ্ধকে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। রুশ বিমানগুলো এখন ইদলিবের বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ফেলছে। যারা এসব লিফলেট তুলছে এবং লোকজনের মাঝে বিতরণ করছে, তাদের বিদ্রোহীরা শাস্তি দিচ্ছে। লিফলেটের বার্তা হচ্ছে, অর্থহীন এই যুদ্ধ করার চেয়ে শান্তি স্থাপন করাই ভালো হবে।
বিদ্রোহীরা পাল্টা একটি বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে যে, যে আত্মসমর্পণ করবে হোক সে বিদ্রোহী যোদ্ধা বা সাধারণ নাগরিক, তাদের সিরীয় বাহিনী হত্যা করবে। সিরীয় কর্তৃপক্ষ আত্মসমর্পণ করা বিদ্রোহীদের হত্যা করবে—এ ধরনের ধারণা কোনো অর্থ বহন করে না। তবে এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যা হোক সিরীয় সরকারের উচিত জোরে এবং স্পষ্টভাবে এ ঘোষণা দেওয়া যে ইদলিবের আত্মসমর্পণকারী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হবে।
তবে পশ্চিমা সরকারগুলোর এটা মানতে খুব কষ্ট হবে যে সাত বছর ধরে যুদ্ধের পর শেষ পর্যন্ত আসাদই বিজয়ী হয়েছেন। তাদের এটা মানতেও কষ্ট হবে যে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ফলে এই যুদ্ধের অবসান হয়েছে। যেহেতু এই যুদ্ধের জন্য তারাও অংশত দায়ী, তাই পশ্চিমা সরকারগুলোর উচিত এখন সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া
জনাথন স্টিল দ্য গার্ডিয়ান–এর সাবেক বিদেশ প্রতিনিধি