আজ সব বন্ধ। দোকানপাট, অফিস-কাছারি, সব ছুটিতে। কারণ, ‘আজ ঈদ। মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ। দলে দলে লোক ঈদগাহে চলেছে।’ কিন্তু আজও পত্রিকা অফিস (অনলাইন বিভাগ) খোলা। তাই ঈদের নামাজ শেষে আমি চলেছি অফিসে। কারওয়ান বাজারে। সবুজবাগ থেকে রিকশায় উঠেছি। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। খিলগাঁও পর্যন্ত আসতেই মোবাইল বাজল। এক বন্ধু ফোন করেছেন।
‘হ্যালো, সারফুদ্দিন! ঈদ মোবারক।’
‘হ ভাই! ঈদ মোবারক!’
‘তুমি কই। বালবাচ্চা নিয়ে চলে আসো।’
‘দাওয়াত দিলা, তার জন্য থ্যাংক ইউ। কিন্তু এ বেলা তো যেতে পারব না। অফিসে যাচ্ছি।’
‘কও কী? আজ তো সব বন্ধ। আজকে আবার কিসের অফিস?’
‘আছে। আজকেও কিছু অফিস খোলা থাকে। হাসপাতাল, মিডিয়া, থানা, জেলখানা...’
‘তাই বলে আজকেও কাজ!’
‘আরে কাজই তো ভালো। শোনো নাই, “কর্মেই মুক্তি?”’
তার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দিলাম। রিকশা চলছে। বাস-ট্রাক নেই। দু-একটা প্রাইভেট কার শাঁই শাঁই করে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। অল্প কিছু রিকশার বেল-বাটির টুংটাং ছাড়া কোনো শব্দ নেই। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। মিষ্টি ঠান্ডা বাতাসে শিরশিরে ভালো লাগা নিয়ে রিকশা এগোচ্ছে।
আচমকা কোনো ভূমিকা না করে রিকশাওয়ালা মাথাটা পেছন দিকে ঘুরিয়ে আমাকে বললেন, ‘স্যার, ম্যালা দামি কথা কইলেন তো! কর্মেই মুক্তি! কতাটা মোর মনোত ধরছে।’ তিনি শব্দ করে হাসতে লাগলেন। এতক্ষণ তাঁর দিকে খেয়াল করিনি। বললাম, ‘এই দামি কথাটা আমার না। এইটা মহাপুরুষ টাইপের কারও কথা। তাঁর নাম মনে পড়ছে না।’
‘নামটা বড় কতা নোয়ায়। কতাটাই আসল’—রিকশাওয়ালা একটু দর্শন মেশানো গলায় হাসতে হাসতে বলল।
‘সে তো ঠিকই। কিন্তু আপনার নাম কী?’
‘মাসুদ।’
‘খালি মাসুদ?’
‘না, মাসুদ রানা।’
‘ও আচ্ছা, বাড়ি?’
‘অংপুর।’
‘রংপুরের কোথায়?’
‘পীরগঞ্জের ফতেপুর।’
‘ফ্যামিলি ঢাকায় থাকে?’
‘না, দ্যাশে থাকে।’
‘ফ্যামিলিতে কে কে আছে?’
‘বাপ-মাও, বউ আর দুই ছাওয়া। বড় ছাওয়ার বয়েস তিন বছর। ছোটটার বয়েস দুই মাস।’
‘এই যে “কর্মেই মুক্তি” কথাটা আপনার ভালো লাগল, কেন ভালো লাগল? এই যে ঈদের দিন আপনি বউ-পোলাপান দেশে রেখে ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন। এইটা কি আপনার ভালো লাগছে?’
এতক্ষণ মাসুদ রানা ফটাফট কথার জবাব দিচ্ছিলেন। এবার জবাব এল না। তিনি খানিকক্ষণ চুপ মেরে থাকলেন। তারপর বললেন:
‘স্যার, আপনার কতাটা মোর কানোত শুনতে ভালো নাগছে, এইটা সত্যি। কিন্তু মনোত ভালো নাগে নাই। ঈদের টাইমে বউ-ছাওয়াপোয়া থুয়ে একা একা ইকশে (রিকশা) চালানো কোনো কাজের নোয়ায়। কিন্তু করার কিছু নাই।’
‘কেন নাই? ঘটনা খুলে বলেন তো।’
মাসুদ রানা এবার তাঁর নিজের কথা বলতে লাগলেন। তাঁর গল্পের সারকথা হলো, তিনি মূলত গ্রামে ধানকাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। ধান কাটার কাজ না পেলে দিনমজুরি করেন। কিন্তু গ্রামে সব সময় কাজ পান না। বাড়িতে এতগুলো মানুষের খাওয়া-পরার ভার তাঁর ওপর। বৃদ্ধ মা-বাবাকে তাঁকেই দেখতে হয়। এ কারণে তিনি ঢাকা আসতে চান না। কিন্তু যখন গ্রামে কাজ থাকে না, বাধ্য হয়ে তাঁকে ঢাকায় আসতে হয়। তিনি হাতিরঝিলের কাছে মধুবাগের একটি রিকশার গ্যারেজ থেকে রিকশা দিন চুক্তিতে ভাড়া নেন। এক দিনের ভাড়া হিসেবে মহাজনকে ১২০ টাকা দিতে হয়। রিকশার গ্যারেজটা একটা বাঁশের মাচার নিচে। সেই মাচার ওপর তিনিসহ অন্য রিকশাওয়ালারা থাকেন। সেখানে থাকার জন্য ভাড়া দিতে হয় না। প্রতিদিন তাঁর খোরাকির পেছনে দেড় শ টাকা খরচ হয়। সব খরচাপাতির পর দিন শেষে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা টেকে। এক সপ্তাহ টাকা জমিয়ে তারপর বাড়ি যান। বাড়িতে বাজারসদাই করে দিয়ে দুদিন বাড়িতে কাটিয়ে আবার ঢাকায় ফেরেন। এই দফায় তিনি তিন দিন আগে ঢাকায় এসেছেন। অসুস্থ থাকায় কোনো টাকা উপার্জন করতে পারেননি। এ কারণে বাড়ি যাওয়া হয়নি। আজও কিছুটা অসুস্থ। বাড়িতে বাচ্চার দুধ কিনতে হয়। এতগুলো মুখে ভাত তুলে দিতে হয়। তাই অসুস্থ শরীর নিয়ে এই ঈদের দিনে তিনি রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। কিছু টাকা হাতে পেলেই দু-তিন দিন পর বাড়ি যাবেন।
‘এই যে আপনি ঢাকায় ঈদে কাটালেন, ভাবি রাগ করছে না?’
মাসুদ রানা বললেন, ‘জি না স্যার। তাকে ফোন করছিনু। তায় বুজবার পাইছে।’
‘ভাবির নাম কী?’
‘তার নাম তাহসিনা।’
‘সে আপনাকে খুব ভালোবাসে, তাই না?’
এ প্রশ্নে মনে হলো মাসুদ রানা কিছুটা লজ্জা পেয়েছেন। তিনি পেডেল মারতে মারতে পেছনে আমার মুখের দিকে চাইলেন। তাঁর মুখে অসম্ভব সুন্দর একটা সলজ্জ আরক্তিম আভা ফুটে উঠছিল।
‘জি স্যার। তায় চায় না মুই ঢাকাত ইকশে চালাওঁ। তায় চায় মুই বাড়িত থাকঁ। মুই যতক্ষণ ঢাকাত থাকোঁ, ততক্ষণ ফোন করতে থাকে। বাড়িত যাবার কয়। মুই যেদিন বাড়ি যাওঁ, তার আগে ফোন করি কও। তায় আন্দিবাড়ি (রান্নাবাড়া) বসি থাকে।’
‘জি স্যার। তায় চায় না মুই ঢাকাত ইকশে চালাওঁ। তায় চায় মুই বাড়িত থাকঁ। মুই যতক্ষণ ঢাকাত থাকোঁ, ততক্ষণ ফোন করতে থাকে। বাড়িত যাবার কয়। মুই যেদিন বাড়ি যাওঁ, তার আগে ফোন করি কও। তায় আন্দিবাড়ি (রান্নাবাড়া) বসি থাকে।’
‘আপনি যাবেন বলে ভাবি সাজগোজ করে বসে থাকে?’
মাসুদ রানা জবাব দিলেন না। হাসতে লাগলেন। হাসতেই লাগলেন। এবার মনে হলো তাঁর মুখে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে।
তাঁর হাসি দেখে মেন পড়ল বছর বিশেক আগের একটি ঈদের দিনের সন্ধ্যার একটি দৃশ্য। গোপালগঞ্জের ডিসি অফিসের উল্টো দিকে উদীচীর কার্যালয়ে আড্ডা চলছে। সেখানে কবি ও গীতিকার মারজুক রাসেল তাঁর সদ্য লেখা একটি গান নিজের সুরে গাইছিলেন। গানটি তখনো কোনো পেশাদার শিল্পী গায়নি। সম্ভবত এখনো গানটি কারও গলাবন্দী হয়নি।
আমার স্মরণশক্তি যদি প্রতারণা না করে, তাহলে গানটির কথাগুলো ছিল এ রকম:
‘এ বছর বাউন্ডুলে
সাজাবে জীবন ঢেলে
সূর্য ডোবার আগে ফিরে যাবে ঘরে
ঘরে তার মনের মানুষ রেঁধে-বেড়ে অপেক্ষা করে।
ঘরে তার মনের মানুষ সেজেগুজে অপেক্ষা করে।।’
মারজুকের মুখে শোনা সেই সুর দিয়ে গানটি এই ফাঁকা রাজপথে অতি উচ্চ স্বরে গাইতে লাগলাম। মাসুদ রানার রিকশা চলতে লাগল। আশপাশের সব রিকশা চালককে কেন জানি আমার মাসুদ রানা মনে হতে লাগল।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]