একটা বিখ্যাত চীনা উপন্যাস আছে, যার নাম রিকশাওয়ালা। সেই উপন্যাসের কথা মনে পড়ল এই কারণে যে রিকশাওয়ালারা বড়ই দুর্ভাগা। একজন রিকশা চালায় আর তাঁর কাঁধে চড়ে যান দুজন। হাড়ভাঙা অমানবিক খাটুনি কিন্তু তার পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক বড়ই কম। চল্লিশের বা পঞ্চাশের দশকে এই শহরে রিকশা একটা বড় যানবাহন, তার মানে কিছু ঘোড়ার গাড়ি, একেবারেই কম কিছু বাস এবং হাতে গোনা কিছু প্রাইভেট কার। কালক্রমে তিন চাকার স্কুটার এল, বাস বাড়ল, ঘোড়ার গাড়ি কমল কিন্তু বেড়ে গেল রিকশা। তখনকার রিকশাভাড়া সত্যিই কম। পরিশ্রমের তুলনায় অপ্রতুল। তবু রিকশা বেড়েই চলল। রিকশার সঙ্গে আমাদের জীবনযাপনের একটা বিষয় আছে। রিকশা দিয়ে যেকোনো দূরত্বে যাওয়া যায়। অলস পরিশ্রমবিমুখ বাঙালির একেবারেই প্রিয় যানবাহন। যেখানে অবলীলায় হেঁটে যাওয়া যায়, সেখানেও ‘এই রিকশা চলো’ বলে বাঙালি সাহেব রিকশায় চেপে একটা মহা আনন্দ পান।
আবার গাড়ি চালাতে যে ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তা রিকশায় একেবারেই প্রয়োজন নেই। মাস খানেক চালালেই বেশ একটা ভালো রিকশাওয়ালা হওয়া যায়। রোজার মাসে প্রথম দিকে হাজার হাজার লোক এসে রিকশাওয়ালা বনে যান এবং ঈদের দিন বা পরের দিন কয়েক হাজার টাকা নিয়ে দেশে ফিরে যান। তাঁদের চালানোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় তাঁরা একেবারেই দক্ষ নন। কিন্তু এ সময় মানুষের হাতে টাকা থাকে, প্রয়োজনও থাকে; তাই এ সময়টা ঢাকাসহ বাংলাদেশের সব শহরই রিকশাওয়ালাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
গত আশির দশকের গোড়া থেকে পঁয়ত্রিশ বছরজুড়ে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। প্রায়ই হরতাল, অবরোধ। এ সময়ে একমাত্র যানবাহন রিকশা। রিকশা হরতালের আওতার বাইরে। শুধু তা-ই নয়, আইনেরও বাইরে। ট্রাফিক সিগন্যালগুলো আপন নিয়মে জ্বলছে-নিভছে। সম্ভবত ট্রাফিক আইন ভঙ্গের অভ্যাসটা শুরু হয়েছে তখনই। সরকার একসময় কতগুলো রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করে দিল। সেগুলোও হরতালের সময় রিকশার জন্য অবারিত।
ক্রমে ক্রমে গণপরিবহনের স্বল্পতায় রিকশার সংখ্যা বাড়তে থাকে। শুধু তা-ই নয়, রিকশার ভাড়াও অনেকের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। শুধু রিকশা নয়, সিএনজিচালিত অটোকিশারও একই অবস্থা। অটোকিশায় সরকার মিটার বসিয়ে দিল, সেগুলো বহুকাল ধরেই অচল। পুলিশ মাঝেমধ্যে চেষ্টা করে বিফল হয়। আর ট্যাক্সি? কিছুদিন পর থেকেই অচল। বর্তমানে যে ট্যাক্সি নেমেছে, তার ভাড়াও আকাশচুম্বী। এয়ারপোর্ট থেকে কোথাও যেতে হলে প্রিপেইড ট্যাক্সির ভাড়া পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। তাহলে শেষ পর্যন্ত স্বল্প দূরত্বের স্থানে যেতে হলেও ভরসা ওই একটিই। রিকশা। তাহলে রাজপথ ‘রিকশাওয়ালার দখলে। রিকশাওয়ালা আর চীনা সেই রিকশাওয়ালার দলে নেই। তার লাইসেন্স লাগে না। আইনের গুরুতর অমান্যকালে তার শাস্তি ট্রাফিক পুলিশের দু-এক ঘা লাঠির বাড়ি। তার জরিমানার কোনো ব্যবস্থা নেই। জরিমানা মানে পুলিশকে কিছু উৎকোচ। আজকাল নিষিদ্ধ রাস্তাতেও তারা ঢুকে পড়ছে।
ছিন্নমূল মানুষ, নদীভাঙা মানুষের একটা বড় জীবিকা রিকশা। শ্রমটি অমানবিক হলেও নগদ আয়ের নিশ্চয়তা। এখন কৃষিশ্রমিকেরাও ধাবিত হচ্ছেন শহরে, পেশা রিকশা চালানো। কৃষিশ্রমিকের প্রবল ঘাটতি দেখা দিচ্ছে গ্রামগঞ্জে, যদিও সেখানে কৃষিশ্রমিকের মজুরি বাড়ছে। মজুরি এ রকমভাবে বাড়ছে যে কৃষি আর লাভজনক থাকছে না। বাংলাদেশের শহরগুলোতে রিকশার প্রবল প্রতাপ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীন থেকে আমদানি করা ইজিবাইক। জেলা শহরগুলো এখন সৌন্দর্য হারিয়ে রিকশার শহরে পরিণত হয়েছে। কলকাতায় বহু আগে রিকশা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি গণপরিবহনের ব্যবস্থাটি সুনিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে পাতালরেলের মতো সবচেয়ে কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে।
আসলে আমরা একটা গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। এত বড় একটা জনগোষ্ঠীর কি শুধু রিকশায়, প্রাইভেট কারে, অটোকিশায় বা মুষ্টিমেয় বাসে করে চলা সম্ভব? একটা পাতালরেলের পরিকল্পনা কেন হলো না? গাড়ি আর বাস-ট্রাকে সয়লাব হয়ে গেল দেশ। আর মধ্যপ্রাচ্য তেল বিক্রি করল। কিন্তু আমাদের সরকারের নীতিনির্ধারকেরা তো মাঝেমধ্যেই চীন-জাপান-হংকং-কলকাতা-দিল্লি ঘুরে বেড়ান। তাঁরা কী দেখেন? এরশাদের আমলে বেশ রাস্তাঘাট হয়েছে। কিন্তু সেগুলো তো সবই গাড়ির। রেলপথ তো এক মাইলও বাড়ল না। আবার স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও বৈদ্যুতিক রেল হলো না একটাও। রেলের প্রতি অবহেলা, রেলের কারখানাগুলোতে সংঘবদ্ধ লুটপাটের জন্য পরিবহনের এই অবস্থা। আর রেলের যে পরিমাণ সম্পত্তি ছিল, তার হিসাব মেলাতে কেউ আর আজকে পারবে না। সামরিক শাসনামলে দেশ চলে আমলা-টেকনোক্র্যাটের দ্বারা, তাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তাঁরা নেন না। কিসে জনগণের উপকার হবে, তার সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত তাঁদের মাথায় নেই।
পরিবহন সমস্যার দ্রুত সমাধান হয় না। সময় লাগে। কিন্তু পরিকল্পনাটি হতে হয় সুদূরপ্রসারী। ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা ছিলেন দেশপ্রেমিক অর্থনীতিবিদ ও নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসাধারণ সব ব্যক্তিবর্গ। যাঁদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রশ্নাতীত। এখন সেই অবস্থা নেই। ঢাকার পথে যে পরিমাণে প্রাইভেট কার চলে, তাতে মনে হয় এমন উচ্চমধ্যবিত্তের দেশ আর নেই। পরিকল্পনাটি সেভাবেই হয়েছিল। দেশটা যে গরিবের, নিম্ন ও মধ্যবিত্তের, তা ভাবাই হয়নি। আবাসিক এলাকায় রাষ্ট্রের জমি সুবিধাভোগী আমলা-মন্ত্রীরা নিয়েছেন। কেন সমবায়িক পদ্ধতিতে অল্প জমি দিয়ে অনেক লোকের ফ্ল্যাট নির্মাণের কৌশলটিও নেওয়া হয়নি।
আবার ফিরে আসি রিকশাওয়ালায়। রিকশাচালকদের আয়-উপার্জন কম নয়, কিন্তু জীবনযাপন মানবেতর। সারা দিন পরিশ্রম করায় যে বসতিটিতে তিনি বসবাস করেন, তা মানুষের বাসযোগ্য নয়। কোনো সুস্থ পারিবারিক জীবন তাঁর নেই। স্বপ্নহীন এই মানুষগুলোর কাছে তাই কোনো উন্নত জীবনের ভাবনা ধরা দেয় না। নিত্য-নিষ্ঠুরতার মাঝেই তাঁর বসবাস। এই মানুষগুলোকে শুধু ভোটের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। এর বাইরে একটা জীবনের আহ্বানের ব্যবস্থা করাটাও গুরুতর রাজনৈতিক প্রশ্ন। রাজনীতি মানে শুধুই ভোট নয়, ভোটে জেতা নয়—মানবিক প্রশ্নটাও জরুরি।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।