রিকশা চললে জীবন চলবে এক কোটি মানুষের
দিনকে দিন করোনা ছুটির গিঁটগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। গিঁট ফিট শুনলেই কেন জানি মনে পড়ে বাংলা বাগধারা ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’র কথা। আঁটুনি শিথিলের পেছনে বলা হচ্ছে জীবিকার উপায়হীনতার কথা। বাধ্যবাধকতা কিংবা ইচ্ছা-অনিচ্ছার তামাম তালিকা তৈরি জন্য এই লেখা নয়। এই লেখা ‘সীমাবদ্ধ জলে’ কতটুকু ‘সীমিত সবুজে’ বাঁচা যায় তার একটা বয়ান তৈরির চেষ্টামাত্র।
এই শিথিল পর্বে পৃথিবীর তাবৎ নগরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কীভাবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে জনপরিবহন চালু রাখা যায়? কেউ বাসের আসন পাতলা (কমিয়ে) করে দিচ্ছে। কেউ একটা আসন ছেড়ে বসার নিয়ম চালু করছে। কোথাও মানছে, কোথাও করছে ‘থোড়াই কেয়ার’।
কাঁটাতারের ওপারের নিকটতম শহর কলকাতা কীভাবে ও কেমন ভাড়ায় যাত্রী নিয়ন্ত্রণ করে বাস চালাবে, তা নিয়ে প্রতিদিন গলদঘর্ম হচ্ছে। ঢাকায়ও বাসের ঢাকনা খুলে দেওয়ার জন্য দেন-দরবার চলছে। কী হবে আল্লাহ মালুম। পরিবহনশ্রমিকদের কল্যাণের কথা বলে সারা দেশে প্রতিদিন যে কোটি কোটি টাকার চাঁদা তোলা হতো, তা এখন কার ভোগে লাগছে কে জানে। জানতে চাওয়াটাও হয়তো বেয়াদবি হবে।
তবে একটা কথা বেশ জোর দিয়ে বলা যায়, পৃথিবীতে কেউ পারুক না পারুক, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে যানবাহন চালু করার হেকমত রাখে। আমাদের জনপ্রিয় ও পরিবেশবান্ধব যান রিকশা অবলীলায় সে কাজটা করতে পারে। শুধু শারীরিক দূরত্ব রক্ষা নয়, বরং গতিও ফিরিয়ে আনতে পারে। কথিত ‘স্বাভাবিক সময়ে’ যানজটের দোলায় দুলতে দুলতে সায়েন্স ল্যাব থেকে মতিঝিলে নিজের গাড়িতে বা বাসে পৌঁছাতে যে সময় লাগত, তার অর্ধেকের কম সময়ে রিকশায় সেখানে পৌঁছানো সম্ভব। অ্যাম্বুলেন্স, দমকল ছাড়া সব গাড়ি বন্ধ করে শুধু রিকশা চলতে দিলেই হবে। সব রিকশাচালকের মাস্ক পরা এবং রিকশায় সাবান পানির বোতল রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে শুধু। যাত্রী ওঠার আগে ও পরে সিটটা সেই পানি দিয়ে মুছে দেওয়ার নিয়ম চালু করতে হবে।
সব কিছিমের অর্থনীতিবিদেরা মোটামুটি একমত, করোনা-পরবর্তী পৃথিবীকে আবার দাঁড় করানোর শক্তি রাখে কৃষি। যার কৃষি দেশের মানুষকে খাইয়ে বাইরে কিছু পাঠাতে পারবে, সে টিকতে পারবে, এগোতে পারবে। শুধু প্রবাসী শ্রমিকের বা গার্মেন্টস শ্রমিকের আয় নয়, রিকশার প্যাডেলের সঙ্গে এখন আমাদের কৃষির ভাগ্য ঘোরে অথবা থামে। জমির মালিকেরা এখন আর জমি চাষ করেন না, তারা শহরে বা বিদেশে চাকরি করেন, জব করেন, ব্যবসা-ঠিকাদারি করেন। চাষ করেন ভূমিহীনেরা। ভূমিহীনের কাছ থেকে জমির মালিক বা তাঁর প্রতিনিধি বছরের বা মৌসুমের শুরুতে মালিকের ঠিক করা হারে বিঘাপ্রতি অগ্রিম নিয়ে নেন। ভূমিহীন এই অগ্রিম জোগাড় করেন ক্ষুদ্রঋণের খাতক হয়ে। তারপর লাগে চারা, বীজ, নিড়ানি, সেচ, সার। সে টাকাও আসে ক্ষুদ্রঋণের আঁচল থেকে বা রিকশার প্যাডেল থেকে। ধান পাকলে ধানের দাম কমে যায়। সরকার ধান শুকিয়ে খনখন না করে দিলে কেনে না। ধারদেনা আর কিস্তি মেটাতে সোঁদা ধানই তাঁকে বেচতে হয়। তাই শুধু চাষ-বাসে দিন চলে না। তখন দিন চালানোর পথ একটাই—রিকশা চালানো।
এ তো গেল কৃষির যুক্তি। সবচেয়ে বড় হলো, একদম তলানিতে থাকা প্রায় এক কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার যুক্তি। সরকার তার সীমিত সম্পদ নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। তবে এভাবে বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া টেকসই হবে না।
শুধু ঢাকা শহরে অন্য যানবাহন বন্ধ করে রিকশার জন্য খুলে দিলে কোনো রকম ত্রাণ ছাড়াই এসব পরিবার উঠে দাঁড়িয়ে অন্যদেরও চলতে সাহায্য করতে পারে। গত বছর ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বা বিলসের খুব পরিচ্ছন্ন এক গবেষণা ফলাফল থেকে জানা যায়, ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ১১ লাখের মতো। গবেষণায় পাওয়া তথ্যমতে, দিনে একটি রিকশা দুই শিফটে চলে। সেই হিসাবে এর চালকের সংখ্যা আনুমানিক ২২ লাখের মতো। ভাবা যায়, শুধু ঢাকা শহরে এতগুলো মানুষকে, তাঁদের পরিবারকে ভুখা রেখে দিয়েছি! দিনে কখনো মেলে সামান্য খাবার, কখনো রাস্তার পাশে বসে থাকাই সার।
১২ মে ধানমন্ডি আবাহনী ক্লাবের সামনের রাস্তায় অনেকগুলো রিকশা উল্টে রেখে লকডাউনের কড়াকড়ির মহড়া দিচ্ছিল আনসার-পুলিশ যৌথ বাহিনী। দূরে একটা সাদা গাড়ির কাচ নামিয়ে সবকিছু ঢাকা এক উঠতি বয়সী দাতা ইশারায় ডাকছিলেন উল্টে রাখা জীবিকার (রিকশা) চালকদের। হাতে তাঁর খাবারের প্যাকেট। এটাই এখন বাংলাদেশের সাধারণ দৃশ্য। ভূরুঙ্গামারীর আবু মিয়া লকডাউন শিথিলের কথা শুনে মহাজনের কাছ থেকে রিকশা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। দুই সপ্তাহ গ্রামে বিকাশ করতে পারেননি। পুঁজি শেষ, ভিক্ষা করা লাগবে। ‘আমার রিকশা ছাড়ি দিলে আমি তিনজনকে খিলাতি পারি। হামাক দেখায় বাস্কো (ত্রাণের বাক্স)। পিত্তি জ্বলি যায় তুমার ঢং দেখি।’
শেরপুর থেকে আরও মর্মান্তিক খবর এসেছে ১৬ মে বিকেলে। লকডাউন শিথিল হওয়ার পর শেরপুর জেলা শহরের অটোরিকশার চালক খোকন রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ খোকনের অটোরিকশার সিটটি ফোয়ারার পানিতে ফেলে দিলে খোকন সিটটি উদ্ধার করতে পানিতে নেমেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। ফেসবুকে তাঁর মাস্ক পরা মৃতদেহ দেখে ১০ হাজার কান্নার ছবি পোস্ট হয়েছে।
খোকনের এক সতীর্থ ঝিনাইদহের অটোরিকশার চালক নিজের মাথা খাটিয়ে বের করে ফেলেছেন এক নতুন ডিজাইনের অটোরিকশা। সেটায় চারজন বসবেন শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে, চার দিকে মুখ করে। কারও সঙ্গে কারও ছোঁয়াছুঁয়ি হবে না। ইন্টারনেটে এ খবর ও ছবি চাউর হওয়ার পর ভারতের এক অটো কোম্পানির পরিচালক ঝিনাইদহের সেই অটোচালককে তাঁদের কোম্পানিতে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়ে যাওয়ার খায়েশ জানিয়েছেন। সংকটে উদ্ভাবন আর উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়।
মনে রাখতে হবে করোনার সঙ্গে বসবাসের পথ আমাদেরই খুঁজে নিতে হবে। সজাগ থাকতে হবে আবার কাজেও ফিরতে হবে। পৃথিবীব্যাপী এই সংকটে সবাই ভুগছে, পকেটে সবার হাত পড়েছে। সাহায্য-ভিক্ষা ছাড়াই আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে। কৃষিই পারবে সে পথ দেখাতে, যার খরচের একটা বড় জোগানদার রিকশাশ্রমিক। তাঁদের রিকশা উল্টিয়ে রাখলে আমাদের ডিগবাজিই ত্বরান্বিত হবে, বিকাশ নয়, মুক্তিও নয়।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক।
[email protected]