গণহত্যা বা জেনোসাইড, যাকে বলা হয় ক্রাইম অব দ্য ক্রাইমস এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ও দণ্ডিত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় যখন ঘোষণা করলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, তখন চার দশকের অধিককাল আগে সংঘটিত অকল্পনীয় নিষ্ঠুর বর্বরতার মোকাবিলায় বাঙালি জাতির অসাধারণ অর্জন ইতিহাসে স্থান করে নিল। এই দুই অভিযুক্ত নানা কারণে পেয়েছিলেন আলাদা পরিচিতি, যেমন আলাদা মাত্রা অর্জন করেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইহুদি নিধনের রূপকার অ্যাডলফ আইখম্যানের বিচার। আর সব অপরাধীকে ছাপিয়ে যেমন আইখম্যান পেয়েছিলেন বিশেষ পরিচিতি, তেমনি ঘটেছে সাকা ও মুজাহিদের ক্ষেত্রে, তবে এর সঙ্গে আরও দুই নামও জড়িয়ে যায়, তাঁরা হলেন গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামী।
তারপরও আসে সাকা ও মুজাহিদের নাম, একই অপরাধে উভয়ে অভিযুক্ত, যদিও ধরন ছিল আলাদা, একজন সংগঠিতভাবে নিষ্ঠুরতার উদ্গাতা ও রূপকার হয়েছেন, আরেকজন ব্যক্তিগতভাবে শরিক হয়েছিলেন দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে হিন্দু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিশ্চিহ্নকরণের কাজে, তাঁর নিজের এলাকায়। পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্ব ধর্মের নামে যে ঘৃণার আদর্শ প্রচার করেছিল, দিয়েছিল রাষ্ট্রীয় রূপ, একাত্তরে দানবের রূপ নিল সেই রাষ্ট্র এবং আদর্শগত ও রাষ্ট্রীয় দানবের প্রতিভূ হয়ে উঠলেন সাকা ও মুজাহিদ। দুজনের বিচার দুভাবে শুরু হয়েছিল দুই আদালতে দুই সময়ে এবং ইতিহাসের কী খেলা, রায় ঘোষিত হলো একই দিন, একাদিক্রমে।
জেরুজালেমে আইখম্যানের বিচার প্রত্যক্ষ করে নিউইয়র্কার সাময়িকীতে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন দার্শনিক ও চিন্তাবিদ হাননা আরেন্ড। ‘আইখম্যান ইন জেরুজালেম: দ্য ব্যানালিটি অব ইভিল’ নামে তাঁর এই রিপোর্ট গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে সাড়া জাগিয়েছিল বিশ্বময়। হাননা কেবল বিচারে সীমাবদ্ধ থাকেননি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির এমন ভয়ংকর রক্তপায়ী হয়ে ওঠার পেছনের কার্যকারণ তিনি তলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন।
বিচারকের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাননা আরেন্ড বলেছিলেন যে আদালতের বিবেচ্য এমন এক ভয়াবহ অপরাধ যার বিশদ ভাষ্য আইনের বইয়ে মিলবে না, তার সামনে এমন এক অপরাধী দণ্ডায়মান, যার মুখোমুখি আর কোনো আদালত কখনো হয়নি, অন্তত নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের আগে তো নয়ই। তাই তাঁর মনে হয়েছে অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী কি নির্দোষ, সেটা নির্ধারণই কেবল আদালতের কাজ নয়, অপরাধের প্রকৃতি, পটভূমি ও সংগঠিত রূপ উদ্ঘাটনও এর অংশ। সেই বিবেচনা থেকে আইখম্যান ট্রায়ালের একটি সমালোচনা করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন হাননা আরেন্ড, তিনি বলেছিলেন, ইহুদি জাতির বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য ইসরায়েলি আদালতে বিচার না করে জেরুজালেমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠা করে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য এই বিচার সম্পন্ন করা প্রয়োজন ছিল, তাহলে সেটা গোটা মানবসভ্যতার জন্য শিক্ষামূলক হতে পারত। অধিকন্তু ইসরায়েলের জাতীয় আইনে আইখম্যানকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তাঁর পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ ছিল না।
হাননা আরেন্ডের যা অভীষ্ট ছিল তা বাংলাদেশের আদালত সম্পূর্ণভাবে পূরণে সচেষ্ট ছিল। এই আদালত ছিল উন্মুক্ত, অভিযুক্ত পক্ষ আইনজীবী নিয়োগ থেকে সওয়াল-জবাবের সব রকম সুযোগ পেয়েছে। সর্বোপরি আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারকালে কেবল অভিযুক্তের সুনির্দিষ্ট অপরাধকর্ম নয়, এর পটভূমি ও সংগঠন বিবেচনায় নিয়েছেন। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞা অনুযায়ী মার্ডার এবং এক্সটারমিনেশন, হত্যা ও নিশ্চিহ্নকরণ—এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক নির্দেশকালে আদালতের পর্যবেক্ষণ এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যযোগ্য। আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মামলার রায়ে আদালত পটভূমির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে স্পষ্ট করে তুলেছেন যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, ছিল রাষ্ট্র (এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান) এবং সংগঠন (আলবদর তথা জামায়াতে ইসলামী) কর্তৃক সুপরিকল্পিত অভিযানের অংশ। বাঙালি জাতি ও হিন্দু ধর্মগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্নকরণের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সংঘটিত অপরাধগুলো মিলিয়ে তাই বড় ছবি আমরা দাঁড় করাতে পারি এবং এটা বোঝার চেষ্টা নিতে পারি, কেন সংঘটিত হয়েছিল গণহত্যা এবং এর পেছনের কার্যকারণ কী ছিল।
সাকা ও মুজাহিদের রায় তাই অনেকভাবে বিশ্লেষণ করার রয়েছে। যদি আমরা ফিরে তাকাই বাংলার এক সুসন্তান ভেষজ ওষুধ প্রতিষ্ঠান কুণ্ডেশ্বরীর প্রধান মানবহিতৈষী অশীতিপর বৃদ্ধ নূতনচন্দ্র সিংহ হত্যাকাণ্ডের দিকে, তবে সামরিক কিংবা রাজনৈতিক বিচারে এর যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। কিন্তু পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ এবং বাঙালি জাতিসত্তা বিলোপ করে সেই স্থলে তথাকথিত মুসলিম জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বিচার করলে আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মিল খুঁজে পাব সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নব্বই বছরের শয্যাগত বৃদ্ধ যোগেশ চন্দ্র ঘোষের হত্যাকাণ্ডের। মিল পাব আরেক বয়োবৃদ্ধ আইনজীবী কুমিল্লার সর্বজনশ্রদ্ধেয় রাজনীতিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হত্যাকাণ্ড কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাঅন্তঃপ্রাণ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা অথবা দেবতুল্য মানুষ ড. জি সি দেবকে হত্যার পেছনের কার্যকারণ, দেখতে পাব একই লক্ষ্য ও মতাদর্শ। এই পটভূমি বিচারকালে আমরা চরম নৃশংস বুদ্ধিজীবী হত্যার কার্যকারণ কিছুটা হলেও বুঝতে সক্ষম হব।
সাম্প্রতিক কালে আর্জেন্টিনার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, যা বাংলাদেশের মতোই জাতীয় আদালত, সে দেশে সামরিক শাসনামলে সংঘটিত নৃশংসতাকে কেবল ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি নয়, জেনোসাইড হিসেবেও চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। সে জন্য জেনোসাইডের সংজ্ঞার বিভিন্ন বিশ্লেষণ করে তাঁরা এর লক্ষ্য সাব্যস্ত করেছেন জাতিকে ধ্বংস করার প্রয়াস হিসেবে। একাত্তরের নৃশংসতাকেও আমরা বাঙালি জাতি ধ্বংসের প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি, যেটা মুজাহিদের রায়েও উঠে এসেছে বুদ্ধিজীবী হত্যা পর্যালোচনায়, যখন উল্লিখিত হয়েছে জাতি ধ্বংসের লক্ষ্যের কথা। জাতি ধ্বংসের এই লক্ষ্য বিবেচনা করলে নির্বিচার হিন্দু-নিধন যেমন ছিল ধর্মগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার কর্মকাণ্ড, যে কাজ সাকা ও মুজাহিদ ভালোভাবেই করেছিলেন, সেটা জাতি ধ্বংসেরও অংশ ছিল, কেননা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান মিলেই গড়ে উঠেছিল সমন্বিত ও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিগোষ্ঠী।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধের মামলা ও রায়ের কাছে আমাদের তাই বারবার ফিরে আসতে হবে। এই রায় মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় অবদান রচনার দাবিদার, তুলনামূলক নানা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে হাননা আরেন্ড কথিত ‘ব্যানালিটি অব ইভিল’ বুঝতে এই রায় বিশেষ সহায়ক হবে। আইখম্যান এবং ঘাতকের মানস হয়েছিল হাননার বিশ্লেষণের আরেক উপজীব্য, তেমনি আমাদের চিন্তাবিদ আইনবিদ মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের বিশ্লেষণ করতে হবে সাকা ও মুজাহিদের মানস, তবেই আমরা খুঁজে পাব জেনোসাইডের মতো ভয়ংকরতার উৎস, পারব জেনোসাইড প্রতিরোধের শক্তি আহরণ করে সম্প্রীতির সমাজ নির্মাণের প্রেরণা।
মফিদুল হক: লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।