রাহুল এখন একবগ্গা ঘোড়া
এত দিনে সোনিয়া গান্ধী স্বস্তির শ্বাস ফেলতেই পারেন, পুত্র রাহুল পায়ের তলার জমি শক্ত করতে পেরেছেন বলে। মা হিসেবে এটা অবশ্যই পরম নিশ্চিন্তির। এই মুহূর্তে রাহুলকে নিয়ে অধিকাংশের গদগদ ভাব নিশ্চয় তাঁর হতাশা ও সংশয়ও দূর করেছে।
উজ্জীবিত রাহুলও। এত দিন ধরে যারা তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আসছিল, ‘পাপ্পু’ বলে কটাক্ষ করত, কিংবা ‘পার্টটাইম পলিটিশিয়ান’ বলে পাত্তা দিত না, এই প্রথম তারা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে বিজেপিকে হারিয়ে সরকার গঠন রাহুলকে আত্মবিশ্বাসের চূড়ায় তুলে দিয়েছে। এই প্রথম তিনি নিজে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে নরেন্দ্র মোদি অজেয় নন। আগামী বছরেই তাঁর স্বপ্নের দৌড় শেষ করে দেওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, এই বিশ্বাস তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন কংগ্রেসের সর্বত্র। এবং অবশ্যই সেই সঙ্গে বেশ কিছু বিজেপিবিরোধী দলেও। উদাহরণ দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি ডিএমকে দলের সভাপতি এম কে স্ট্যালিন।
এই সেদিন চেন্নাইয়ে প্রয়াত করুণানিধির পূর্ণাবয়ব এক মূর্তির আবরণ উন্মোচন উপলক্ষে স্ট্যালিন রাখঢাক না রেখেই বলে দিলেন, বিজেপিকে হারিয়ে বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে রাহুলই হবেন প্রধানমন্ত্রী। যে মঞ্চ থেকে স্ট্যালিন তাঁর ইচ্ছার কথাটি প্রকাশ করলেন, রাহুল ও সোনিয়া তখন সেখানে বসে। পরদিন এই ঘোষণা নিয়ে বিরোধী শিবিরে কিছু কানাকানি হলো। মমতা বা মায়াবতীদের মতো যাঁরা এখনো মনে করেন, পাটিগণিতের হিসাবে বিজেপিকে দাপিয়ে বিরোধীদের মাথা আকাশ ছুঁলে সাতলোক কল্যাণমার্গে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দুয়ার তাঁদের জন্য খুলে যাবে, তাঁদের দল অস্বস্তি কাটাতে জানাল, প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন উঠবে একমাত্র ভোটের ফল বেরোনোর পর। বামপন্থীদের সুরও মোটামুটি ওই। অস্বস্তি কাটাতে কংগ্রেসও তৎপর হয়ে উঠল। বলা হলো, প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্ন নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক নয়। এসব রাজনৈতিক বিবৃতি পাশ কাটালে যে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয় তার একটি হলো রাহুল হয়ে উঠছেন বিরোধীদের মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রিত্বের বড় দাবিদার। এবং অন্যটি, রাহুলকে নিয়ে অনেকের আড়ষ্টতা এখনো অটুট। কিন্তু এই দুইয়ের পাশে তৃতীয় একটি বিষয়ও উল্লেখযোগ্য। স্ট্যালিনের এই ঘোষণা সত্ত্বেও বিজেপির কেউ এই ঘোষণাকে ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ বলে তাচ্ছিল্য বা ঠাট্টা করল না। কংগ্রেসের কাছে গোবলয় হারানোর ভয় বিজেপিকে সম্ভবত এতটাই কাবু করে তুলেছে। গত সাড়ে চার বছর বিজেপিকে এমন মুহ্যমান দেখা যায়নি।
রাহুল সম্পর্কে স্ট্যালিন যা বললেন, নেহরু-গান্ধী পরিবারের প্রতি সেই কথা তাঁর বাবা অতীতে বারবার বলে এসেছেন। ১৯৮০ সালে করুণানিধি প্রথম বলেন, ‘স্বাগত পণ্ডিত নেহরুর কন্যা। দেশকে স্থিতিশীল এক সরকার উপহার দিন।’ ২০০৪ সালে করুণানিধি স্বাগত জানান সোনিয়াকে। বলেছিলেন, ‘স্বাগত ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ। আপনি ভারতীয় নারী। আপনার জয় হোক।’ বাবার এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে স্ট্যালিন সেদিন বলেন, ‘সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আমিও তামিলনাড়ুর মাটি থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাহুল গান্ধীর নাম প্রস্তাব করছি। আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি, রাহুল। দেশকে আপনি সুশাসন দিন। ফ্যাসিস্ট সরকারের অবসান ঘটানোর ক্ষমতা ও শক্তি আপনার আছে।’
রাহুলকে ঘিরে এই যে বিশ্বাস বিজেপিশাসিত তিন রাজ্য দখলের পর মাথাচাড়া দিয়েছে, একি নিতান্তই আকাশকুসুম কল্পনা? নাকি এর পেছনে ভোটের পাটিগণিত ও রসায়নও রয়েছে? উত্তরটা সহজ। বিশ্বাসের ভিত পাটিগণিত ও রসায়ন দুটোতেই।
প্রথমেই বলা দরকার, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ভোটারদের কাছে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ছিলেন অচেনা ও অজানা। ১০ বছরের কংগ্রেস শাসনের শেষে দুর্নীতির অভিযোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উল্কার গতিতে ধেয়ে এসেছিলেন অচেনা–অজানা মোদি। মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেছিল। তিনি ছিলেন ‘চ্যালেঞ্জার’। দেশ জিতে সেই মোদি যে যে রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলকে চ্যালেঞ্জ জানান, যেমন উত্তর প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, আসাম, ত্রিপুরা, গোয়া, মণিপুর, মেঘালয়, সর্বত্র তাঁর জয়জয়কার। চ্যালেঞ্জার মোদি ব্যর্থ হয়েছেন দুটি ক্ষেত্রে। দিল্লি ও বিহার। কর্ণাটকে বিজেপি সরকার গড়তে পারেনি কংগ্রেসি তৎপরতায়। কিন্তু সেখানে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের রাতের ঘুম তিনি ছুটিয়ে দিয়েছিলেন। তুলনায়, যে যে রাজ্য বিজেপির দখলে ছিল, অর্থাৎ যে যে রাজ্যে মোদি ‘ডিফেন্ডার’, নিজের সরকারকে আগলাতে হচ্ছে, সেখানে তিনি ব্যর্থ। যেমন, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়। গুজরাটেও তিনি ছিলেন ডিফেন্ডার। সরকার গড়েছেন ঠিকই, কিন্তু কোনোরকমে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত: এক, মোদি–ম্যাজিক ফিকে হচ্ছে। দুই, কংগ্রেসমুক্ত ভারত গঠনের ডাক দেশবাসী প্রত্যাখ্যান করছে। তিন, গোবলয়ে যে যে রাজ্যে কংগ্রেসই একমাত্র প্রতিপক্ষ, সেখানে তার ওপর মানুষ ভরসা রাখতে ভালোবাসছে। রাহুলের নেতৃত্বকে সুযোগ দিতে চাইছে।
কেন ফিকে হচ্ছে মোদি-ম্যাজিক? কারণ অনেক। প্রধান কারণগুলো হলো, প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা। নোট বাতিল ও জিএসটির সিদ্ধান্ত দীর্ঘ মেয়াদে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বৃদ্ধি। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। ফলে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া। কৃষি ও কৃষক সমস্যার সমাধানে ব্যর্থতা। সামাজিক বৈষম্য ও অসন্তোষ বাড়ানো এবং অবশ্যই প্রশাসনিক ঔদ্ধত্য। ঔদ্ধত্য এতটাই যে নিজের দলেও মোদির বিরুদ্ধে নীরব বিরোধিতা বেড়ে চলেছে। দল হয়ে গেছে মোদি ও অমিত শাহকেন্দ্রিক। এই অবস্থায় মোদিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে নমনীয় কংগ্রেসের সঙ্গে। সেই কংগ্রেস, বিরোধী জোটকে জোরদার করতে যে দল কর্ণাটকের ভার তুলে দিয়েছে সহযোদ্ধা কুমারস্বামীর হাতে। স্ট্যালিনের ঘোষণা সত্ত্বেও যে দলের নেতা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্নকে আমল দিতে রাজি নন।
রাসায়নিক পরিবর্তনও বেশ কিছুটা ঘটে গেছে ধরে নিয়ে ২০১৪ সালের নিরিখে ২০১৯ সালের সম্ভাব্য পাটিগণিত কেমন হতে পারে দেখা যাক। যদিও এটা ঠিক, ভোটের চার মাস বাকি থাকতে নির্দিষ্টভাবে এখনই কিছু বলা ঠিক নয়। বিশেষ করে বিজেপি যখন ‘মোদি বনাম কে?’ প্রশ্নটি তুলে ভোট চাইতে নামবে। তবে এটা মনে রাখা দরকার, ২০১৪ সালের মোদি ছিলেন ‘চ্যালেঞ্জার’, ২০১৯-এর মোদি ‘ডিফেন্ডার’। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই লাভ-লোকসানের হিসাবটা জানতে চাইবে। কংগ্রেস বা রাহুল গান্ধীর গালমন্দ শুনতে পছন্দ করবে না।
পাঁচ বছর আগে ‘চ্যালেঞ্জার’ মোদির খতিয়ানটা কেমন ছিল? দেশের হিন্দি-হৃদয় যা কিনা গোবলয় বলে পরিচিত এবং যে রাজ্যগুলোয় কংগ্রেসই তার একমাত্র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, গত লোকসভা নির্বাচনে সেখানকার রাজ্যওয়ারি হিসাব বিজেপির কাছে ছিল তাক লাগানো। হিমাচল প্রদেশে ৪-এ ৪, উত্তরাখন্ডে ৫-এ ৫, গুজরাটে ২৬-এ ২৬, রাজস্থানে ২৫-এ ২৫, মধ্যপ্রদেশে ২৯-এ ২৭, ছত্তিশগড়ে ১১-তে ১০। পাঁচ রাজ্যের এই ১০০ আসনে বিজেপি পেয়েছিল ৯৭টি।
এগুলোর বাইরে ছিল উত্তর প্রদেশে ৮০তে ৭৩ (দুটি আসন জোট শরিক আপনা দলের), মহারাষ্ট্রে ৪৮-এ ২২ বিজেপি ও ১৮ শিব সেনা এবং কর্ণাটকে ২৮-এ ১৫। এর মানে এই তিন রাজ্যের ১৫৬টি আসনে বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীরা পেয়েছিল ১২৮ আসন। অর্থাৎ, ২৫৬ আসনের মধ্যে ২২৫টা পেয়ে মোদি নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন। চার মাস পর ভোটের সময় এই রাজ্যগুলোর মধ্যে চারটি থাকবে কিন্তু কংগ্রেসশাসিত। আরও দুটো বড় রাজ্য বিহার ও ঝাড়খন্ড। বিহারের ৪০টির মধ্যে বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীরা পেয়েছিল ৩০টি। ঝাড়খন্ডের ১৪টির মধ্যে ১২। বিহারের এক জোটসঙ্গী (কুশাওয়া) বেরিয়ে গেছে। আরেকজন (রামবিলাস পাসোয়ান) যেতে পারি যেতে পারি করছে। বিভিন্ন জরিপ বলছে, এখনই ভোট হলে বিজেপির আসন ৫০ শতাংশ কমে যাবে। মানে, এই রাজ্যগুলোর প্রাপ্তি ২২৫ কমে হতে পারে ১১২-১১৫। দেশের বাকি রাজ্যে ঘাটতি পূরণের জায়গা এক কথায় নেই।
রাহুল এইখানেই তেড়েফুঁড়ে নেমেছেন। কৃষিঋণ মওকুফের সিদ্ধান্ত অর্থনীতিবিদদের কাছে ‘হারাকিরির’ শামিল হলেও মোদিরাজের অবসানে এটা তাঁর তুরুপের তাস। অন্য হাতিয়ার রাফাল। সুপ্রিম কোর্ট সরকারের পক্ষে দাঁড়ালেও রাহুল অনড়। এই জোড়া আক্রমণের পর তিন রাজ্য যদি কংগ্রেসকে কোল পেতে দিতে পারে, তাহলে বাকি রাজ্যগুলো নয় কেন? রাহুল এখন একবগ্গা ঘোড়া। নরেন্দ্র মোদি যে দলটাকে ভারতছাড়া করতে চেয়েছিলেন, সেই কংগ্রেসই তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে। লড়াইটা ক্রমেই হয়ে দাঁড়াচ্ছে মোদি বনাম রাহুল।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় : প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি