রাষ্ট্রীয় পুরস্কার: জিব কাটো লজ্জায়
যেকোনো পুরস্কার, আর তা যদি সাহিত্য বা সংস্কৃতির মতো অনির্বচনীয় কোনো বিষয় নিয়ে দেওয়া হয়, তা বিতর্কের জন্ম দেবেই। পুরস্কার ঘোষিত হলে কিছু মানুষ সেটাকে সাধুবাদ জানাবে। কিছু মানুষ বলবে—না, একদমই ঠিক হয়নি। এটা জগতের নিয়ম। তাই বলে পিটার হান্ডকের মতো লেখক, যিনি বসনীয়-সার্ব সৈন্যদের যুদ্ধাপরাধকে অস্বীকার করেন, এটাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, তিনি যখন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন, পৃথিবীর বহু শান্তিবাদী মানবতাবাদী লেখক-কবি উচ্চকণ্ঠে তারস্বরে তার প্রতিবাদ করেছেন। আমার কণ্ঠ কোথাও পৌঁছাবে না জানা সত্ত্বেও আমিও এই পিটার হান্ডকেকে নোবেল দেওয়ার প্রতিবাদ করেছি, করছি, করি।
যেমন আমাদের প্রতিবাদ করে যেতেই হবে শর্ষিনার পীরের স্বাধীনতা পদক পাওয়ার ঘটনাকে।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন:
পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এবং টুপি মাথায় দিয়ে আমরা দুই ভাই আশ্রয়দাতা ভদ্রলোকের সঙ্গে স্বরূপকাঠি রওনা হলাম। পৌঁছালাম পীর সাহেবের দরবারে। শুনলাম ৬ মে মিলিটারিরা পীর সাহেবকে সালাম জানাতে এসেছিল এবং সালাম জানিয়ে দোয়া নিয়ে গেছে। যাওয়ার পথে চারদিক ছারখার করে দিয়ে গেছে।
জানা গেল, শর্ষিনার পীর সাহেবের সঙ্গে মিলিটারির খুব ভালো যোগাযোগ আছে। তারা স্বরূপকাঠি এলেই পীর সাহেবের আতিথ্য গ্রহণ করে। পীর সাহেব আমাদের দুই ভাইকে মাদ্রাসায় রাখতে রাজি হলেন না। আমরাও থাকতে চাইলাম না। আমরা চাচ্ছিলাম অতি দ্রুত পালিয়ে যেতে। কেবলই মনে হচ্ছিল, এ জায়গা থেকে যত দূরে থাকতে পারব ততই মঙ্গল। (শুনেছি শর্ষিনার পীর সাহেবকে নাকি স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই খবরটা সত্যি না। পত্রপত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে তো প্রায়ই মিথ্যা খবর ছাপা ও প্রচার হয়, এটাও বোধ হয় সে রকম কোনো খবর।) সূত্র: ১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, সম্পাদনা: রশীদ হায়দার, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, মে ১৯৯৬।
হুমায়ূন আহমেদ স্যার, আপনি নিশ্চয়ই জেনে গেছেন, আপনার শোনা কথাটা মিথ্যা নয়। পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর এই লোককে সেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, যার নাম স্বাধীনতা পুরস্কার, যা কিনা এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। খবরের কাগজে দেখলাম, মাহবুবুল আলম চাষীও নাকি স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছিল।
এবার স্বাধীনতা পুরস্কারে সাহিত্যে একজনকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়ার জন্য নাম ঘোষণা করা হয়েছে। সাহিত্যে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার যিনি পাবেন, তিনি নিশ্চয়ই সাহিত্যক্ষেত্রে আমাদের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তাঁর নাম আসবে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে, শামসুর রাহমানের সঙ্গে, হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে, নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে।
দেখা গেল, সাহিত্যে মুক্তিযোদ্ধা এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ এবং সংস্কৃতিতে কালীপদ দাস নামের যে দুজন এ পুরস্কার পাবেন বলে ঘোষিত হয়েছে, তাঁদের আমরা অনেকেই চিনি না। আমি না চিনতেই পারি, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত শামসুজ্জামান খান, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, যঁার কাণ্ডজ্ঞানের ওপরে আমাদের আস্থা আছে, তিনিও চেনেন না। এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদকে আস্তে আস্তে চেনা গেল। তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ফেসবুকে। সত্যি সত্যি যদি এগুলো এস এম রইজ উদ্দিনের লেখা হয়ে থাকে এবং সত্যি সত্যি এই কবিতার লেখককে যদি সাহিত্যে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে খুবই লজ্জার ব্যাপার। আমি প্রথমেই এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ এবং তঁার পরিবার-পরিজনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। পুরস্কারের তালিকায় আপনারা নিজেরা নিজের নাম লিখে দেননি, রাষ্ট্র দিয়েছে। আপনাদের কোনো সমালোচনা আমি করব না। কিন্তু প্রকাশিত কবিতা বা সাহিত্যের সমালোচনা করার অধিকার পাঠক হিসেবে আমার আছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই যে রইজ সাহেবের এই কবিতা কোনো জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার উপযুক্ত নয়। এবং এ কবিতা লিখে তিনি পাড়ার মিতালি সংঘ, সবুজ সংঘের বার্ষিক পুরস্কারও পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন না। আবারও বলি, একটা ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ হয়ে না উঠলে এ বিষয়ে স্বাধীনতা পুরস্কার একজন পেতে পারেন না। অবশ্যই এ পুরস্কার আনিসুজ্জামান স্যার পেতে পারেন, অবশ্যই আনোয়ার পাশা পেতে পারেন। সৈয়দ শামসুল হক পেতে পারেন। কিন্তু আমরা কেউ জানলাম না, পড়লাম না, এত বড় সাহিত্যকৃতী আমাদের মধ্যে রয়ে গেলেন! আর যখন পড়লাম, তখন একজন সাহিত্যের পাঠক হিসেবে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির একজন নাগরিক হিসেবে আমার মাথা নিচু হয়ে এসেছে! এটা যে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার!
বলা হচ্ছে, তিনি গ্রামভিত্তিক একটা সাহিত্য সংগঠন পরিচালনা করেন। তাহলে তাঁকে সংগঠনে বা সমাজসেবায় পুরস্কার দিন। তাঁর সংগঠনটা কি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চেয়েও বড়?
ফেসবুকে এসব নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। শামসুজ্জামান খান লিখেছেন। জুয়েল আইচ শর্ষিনার পীর আবু জাফর এবং রইজ সাহেবের পুরস্কার প্রত্যাহার করার প্রস্তাব দিয়েছেন। কবি প্রাবন্ধিক রাজনীতিক নূহ–উল–আলম লেনিন ফেসবুকে লিখেছেন:
‘এ বছর স্বাধীনতা পুরস্কার একাধিক অজ্ঞাত অখ্যাত ও অযোগ্য ব্যক্তিকে প্রদান করে সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার, পুরস্কারের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অন্তত একজনের অর্থাৎ জনাব রইজ উদ্দিনের নামে প্রদত্ত স্বাধীনতা পুরস্কারটি প্রত্যাহার করা হোক।’
স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। একুশে পদকের দায়িত্ব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের। পদ্ধতিটাও বেশ আমলাতান্ত্রিক। একুশে পদকের জন্য নিজেই আবেদন করা যায়। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নাম প্রস্তাব করতে পারেন। তাঁরাই যাচাই–বাছাই করেন। ধরা যাক, উচ্চাঙ্গসংগীত বা চিত্রকলা বা সাহিত্যের বিচার করার জন্য কি এ বিষয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করে দেওয়া যায় না? আমি জানি, কোনো পুরস্কারই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। যাঁকেই পুরস্কার দিন না কেন, কথা উঠবেই। তাই বলে আপনারা যদি আমাকে ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার দিতে চান এই বলে যে আমি স্টেডিয়ামে দুই দিন খেলা দেখতে গেছি, এবং পতাকা নেড়েছি, তা কি গ্রহণযোগ্য হবে? রইজ সাহেবের বয়সও তো এমন কিছু নয়, তিনি মুক্তিযোদ্ধা, ১১ বছর বয়সে যুদ্ধ করেছেন, তাহলে তিনি তো কেবল ৬০। কবি মহাদেব সাহার বয়স ৭৬, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বয়স ৮১। এসব কথা বলতেও লজ্জা পাই। তাঁরাও লজ্জা পাবেন।
রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা আছে, ‘পুরস্কার’। তাতে কবি বলেছিলেন, একজন কবির কাজ হলো, ‘সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর/ রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,/ দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—/ তার পরে ছুটি নিব।/ সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,/ সুন্দর হবে নয়নের জল,/ স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল/ আরো আপনার হবে।’ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মহাদেব সাহা আমাদের সুখহাসিকে আরও উজ্জ্বল করেছেন। এ রকম আরও ৫০টা নাম আমরা বলতে পারব।
রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’ কবিতায় কবি রাজার কাছ থেকে ফুলের মালা এনেছিলেন, স্ত্রীর কাছে পেয়েছিলেন কপট ভর্ৎসনা আর উষ্ণ আলিঙ্গন। বোধ হয় প্রকৃত কবি, প্রকৃত সাহিত্যিক, প্রকৃত যোগ্যদের জন্য এটাই যথেষ্ট, মানুষের ভালোবাসা! রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নয়।
কিন্তু এই রাষ্ট্রের আমিও তো একজন মালিক। এই দেশটা তো গণপ্রজাতন্ত্রী! একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুব সংকোচ বোধ করছি। গুন্টার গ্রাসের বইয়ের শিরোনামটা এখন আমার মনের মধ্যে বাজছে: জিব কাটো লজ্জায়।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক