সুশাসনের বিষয়টি বাদ দিলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং এবং বিশেষত সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা যে খেলাপি ঋণ, সেটি নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এ বিষয়ে যত লেখালেখি ও গবেষণা হয়েছে, ব্যাংকিংয়ের আর কোনো বিষয় নিয়ে ততটা হয়নি। কিন্তু সব সময় প্রকৃত তথ্য প্রতিফলিত হয়েছে, তা জোর গলায় বলা যায় না। কয়েক মাস আগে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দেশের ১০০টি খেলাপি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করেন, কিন্তু তাতে সর্বজনবিদিত তারকা খেলাপিদের নাম নেই। যাদের নাম থাকা উচিত ছিল, তাদের প্রায় সবাই পুনঃ তফসিলীকরণের আড়ালে কিংবা উচ্চ আদালতের আশ্রয়ে থাকায় আইনি বাধ্যবাধকতায় তালিকার বাইরে রয়ে গেছে।
খেলাপি ঋণের নিরিখে ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা থেকে যদি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ। ব্যাংক খাতের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুন ২০১৭ ভিত্তিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা, যা ২০১৫ ডিসেম্বরে ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। এই হিসাবে জুন ২০১৭ প্রান্তিক শেষে দেশের সামগ্রিক খেলাপি ঋণের হার ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা ২০১৬-এর ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৬ সালে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারতে এই হার ৯ দশমিক ২, পাকিস্তানে ১০ দশমিক ১, শ্রীলঙ্কায় ২ দশমিক ৬ এবং মালদ্বীপে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ।
অন্যদিকে আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২৫ শতাংশ। এটা সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক খাতের চরম দৈন্যদশাই কেবল নির্দেশ করে না, এসব ব্যাংকের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নিয়েও সন্দেহের উদ্রেক করে। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, ২০১৫ সালের প্রথম ভাগে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিশ্বমন্দার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকার ওপর খেলাপি ঋণের জন্য একটা বিশেষ সুযোগ দিয়েছিল। এই সুযোগের মাধ্যমে ৫০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকার মধ্যকার ঋণের জন্য ২ শতাংশ এবং ১ হাজার কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ঋণের জন্য ১ শতাংশ হারে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৬ বছর থেকে ১২ বছরের জন্য পুনঃ তফসিল করা হয়। এমনকি এসব ঋণের জন্য সুদের হারেও বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই প্রতিষেধকেও যে বিশেষ কাজ হয়নি, তা ওপরের খেলাপি ঋণের চিত্র থেকেই বোঝা যায়। পরিস্থিতির আরও উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে, রেয়াতি হারে ডাউন পেমেন্টসহ পুনঃ তফসিলকৃত বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত খেলাপিদের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আবার খেলাপির খাতায় উঠে এসেছে।
আইএমএফ আর্টিকেল-৪-এর জুন ২০১৭ প্রকাশনায় মন্তব্য করা হয়েছে যে বাংলাদেশের সরকারি ব্যাংকগুলোতে ব্যাংকিং সম্পদের এক-চতুর্থাংশ পুঞ্জীভূত থাকলেও এগুলো চলছে দুর্বল ব্যালান্সশিট নিয়ে। এই দুর্বলতা মূলত দীর্ঘদিনের পরম্পরায় চলে আসা পরিশোধের অনীহাসম্পন্ন বৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি ঋণ এবং আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে, যা ঋণ আদায়ে ব্যাংকের সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
একই মত দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটেরও। তাদের মতে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ, স্বল্প মুনাফা, বিশাল মূলধন ঘাটতিসহ নানান দুর্বলতায় ভুগছে। এসবের মূলে রয়েছে দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। বছরের পর বছর ধরে এই ব্যাংকগুলো বৃহৎ প্রভাবশালী গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে গেছে, যারা পরিশোধে উদাসীন বলে পরিচিত। প্রভাবশালী খেলাপিদের খুব কম ক্ষেত্রেই শাস্তি দেওয়া হয়, বরং এসব ঋণ নিয়মিত পুনর্বিন্যাস করা হয়, যাতে তাদের আরও নতুনভাবে অর্থায়ন করা যায়।
অতএব, সংগত কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। মার্চ ২০১৭ প্রান্তিকে সমগ্র ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার আগের ত্রৈমাসিকের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়, এর মধ্যে ছয়টি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের অংশ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট খেলাপি ঋণের ৪৯ শতাংশ। তবে এই হার আরও বেশি হওয়াই স্বাভাবিক; কারণ, চাতুরী বিন্যাস করে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর একটা প্রবণতা এসব ব্যাংকে প্রবল। ডিসেম্বর ২০১৬ ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত খেলাপি ঋণের হিসাবের মধ্যে প্রধান চারটি সরকারি ব্যাংকে মোট ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছিল, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল উদ্ঘাটন করতে পেরেছে। এই পরিদর্শনে যেহেতু সব কটি ঋণ হিসাব নিরীক্ষা করে দেখা হয় না, সেহেতু সহজেই ধারণা করা যায়, আড়াল করে না রাখলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ আরও বেশি হতো। খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখা মন্দঋণ সংস্থানের ঘাটতি সত্ত্বেও সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতিও বিশাল। ২০১৭ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে আটটি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
পুরো ব্যাংক খাতে অবলোপন করা মোট ৪৫ হাজার কোটি টাকা হিসাবে ধরলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। তার সঙ্গে ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত পুনঃ তফসিল করা ৭০ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়াবে ভয়াবহ এক অঙ্কে। অবলোপন ও পুনঃ তফসিল করা ঋণ বাদ দিয়ে যদি কেবল ঘোষিত খেলাপি ঋণের মোট হিসাবও ধরা হয়, তাহলে দেখা যায় তা দেশের সব কটি ব্যাংকের সংরক্ষিত সংবিধিবদ্ধ মূলধনের ৭৪ শতাংশ।
যেকোনো ধরনের আর্থিক অব্যবস্থা ও বিপর্যয় সামাল দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মূলধন মজুত রাখতে ব্যাংকগুলোকে সক্ষম ও বাধ্য করার জন্যই সংবিধিবদ্ধ মূলধন সংরক্ষণের উদ্যোগ। সেই বিবেচনায় মূলধন ঘাটতিসম্পন্ন সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোকে করদাতাদের অর্থে চালু রাখার চলমান প্রবণতাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। আর্থিক সংকটের সময় ব্যাংকগুলো নিজস্ব মূলধন দিয়েই যাতে বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে, এই সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্যই ব্যাংকগুলোকে পর্যাপ্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু আমাদের ব্যাংক খাতে কেবল খেলাপি ঋণের কারণে মূলধনের তিন-চতুর্থাংশ যদি বিপন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে অন্যান্য ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য কতটুকু মূলধন অবশিষ্ট থাকবে? মূলধন সংরক্ষণের সক্ষমতা নিরূপণ করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু অনুমান প্রয়োগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর চাপ সহনক্ষমতা (স্ট্রেস টেস্টিং) পরীক্ষা করা হয়। ব্যাংকগুলোর ভিত্তি এবং স্থিতিশীলতার সামর্থ্য পরিমাপের জন্য ঝুঁকিভারিত (বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় সম্পদের পরিমাণ। যেমন সরকারি বন্ডে বিনিয়োজিত সম্পদের ঝুঁকিভার ‘শূন্য’। কিন্তু সাধারণ গ্রাহকদের দেওয়া ঋণ তথা সম্পদের ঝুঁকিভার ক্ষেত্রবিশেষে ২০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে)।) মূলধনের যে অনুপাত বের করা হয়, সেই মাপকাঠিতেও সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা সঙিন।
২০১৭ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে যেখানে বাংলাদেশের সব কটি ব্যাংকের ঝুঁকিভারিত সম্পদ ও মূলধনের অনুপাত ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে ছয়টি সরকারি ব্যাংকে এই হার মাত্র ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, অথচ ২০১৩ সালে এই হার ছিল ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে এই অনুপাত ১২ দশমিক ২ এবং বিদেশি ব্যাংকের ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ। বাসেল ৩ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় সব ব্যাংকের গড় অনুপাত ২০১৬ সালে ছিল ন্যূনতম ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, পর্যায়ক্রমে ২০১৯ সালে যা হবে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এই হিসাবে বাসেল ৩-এর পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটলে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি যে অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছাবে, সেটি অবশ্যম্ভাবী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা রিপোর্টে (২০১৬) দেখানো হয়েছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রাহকদের পরিবর্তে অতিমাত্রায় বৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের ওপর আমাদের ব্যাংকগুলোর নির্ভরশীলতা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য বিপজ্জনক। বিআইবিএমের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের হিসাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ৪৮ শতাংশ ঋণ পুঞ্জীভূত রয়েছে ২০ কোটি টাকার ওপরের গ্রহীতাদের মধ্যে। অথচ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ গেছে ১৩ শতাংশ, ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ ১৭ শতাংশ এবং ১ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকা ঋণ গেছে ২২ শতাংশ গ্রহীতার কাছে। অন্যদিকে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের ৩৫ শতাংশ পুঞ্জীভূত ১২০ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে।
খেলাপি ঋণসহ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে যে বিপজ্জনক অবস্থা বিরাজ করছে, মূলধন ঘাটতি মিটিয়ে এগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য গত সাত বছরে জনগণের করের টাকা থেকে দেওয়া হয়েছে ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, সরকারি মালিকানাধীন এসব ব্যাংকের অদক্ষতা ও দুর্নীতির মাশুল দিতে হচ্ছে করদাতা নাগরিকদের। এগুলোর ঐতিহাসিক প্রবণতা থেকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে খেলাপি ঋণের রাহুগ্রাস থেকে এগুলোর মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, যদি না বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর উদ্ভব ও ইতিহাস আমাদের সবারই জানা আছে। যে উদ্দেশ্যে এসব ব্যাংকের সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা সফল না হলেও সেই দর্শনের কার্যকারিতা বর্তমান ব্যবস্থায় আর নেই। সুতরাং রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলোর ভূমিকা যদি পরিবর্তন করে দেওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে এসব ব্যাংকের অস্তিত্ব ও কার্যক্রমকে যৌক্তিক করে তোলা যায়।
আমরা ভেবে দেখতে পারি, সরকারি ব্যাংকের ভূমিকাকে নির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রমের মধ্যে সীমিত রাখা যায় কি না। যেমন ১. এগুলোর সাবসিডিয়ারি হিসেবে আমানত গ্রহণকারী কোম্পানি গঠন, ২. ঋণ বিতরণ কার্যক্রম কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প খাতে সীমিত রাখা, ৩. বৃহৎ ঋণদান কেবল সরকারের ঋণ চাহিদার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। আকর্ষণীয় সুদে আমানত আকর্ষণ করার জন্য প্রয়োজনে সরকারি সাবসিডি ব্যবহার করা যেতে পারে। খেলাপিদের কারণে সরকার যে অর্থ মূলধন পুনর্ভরণের জন্য খরচ করে, তার একটা ছোট অংশ দিয়ে এই সুদ ভর্তুকি দেওয়া যায়। আমানত গ্রহণকারী ব্যাংক হিসেবে এই সব ব্যাংক বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে স্বল্প ও মাঝারি মেয়াদে বিনিয়োগ করতে পারে। এই উদ্যোগের জন্য আইনের ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। বৈপ্লবিক এই পরিবর্তন একটি দৈনিকের নগণ্য একজন পত্রকারের প্রাথমিক সুপারিশের ওপর ঘটানো সম্ভব নয় উপলব্ধি করে আশা করা যায়, নীতিনির্ধারকদের মধ্যে স্বপ্নদর্শী ও চিন্তাশীল কেউ এই সুপারিশ থেকে গ্রহণযোগ্য একটা সমাধান বের করতে পারবেন।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷