ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অভিযান নিয়ে চীন যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। চীনা কর্মকর্তারা বেসামরিক হতাহতের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তাঁরা এই হামলার নিন্দা জানাতে অস্বীকার করেছেন। তাঁরা এই অভিযানকে ন্যাটোর সম্প্রসারণ চেষ্টার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছেন। চীনের নেতারা ঘোষণা করেছেন, তাঁরা রাশিয়ার ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইস্যুতে পশ্চিমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন না। তবে চীন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যে একেবারে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিচ্ছে—সেটিও বলা যায় না। চীনের এই অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ অবস্থান ইউক্রেনে আরও বিপজ্জনক সামরিক উপস্থিতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে কি না, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
বেশির ভাগ পশ্চিমা রাজনীতিবিদ মনে করছেন, ইউক্রেনে পুতিনের সহিংসতায় চীনের প্রতিক্রিয়া খুবই অপ্রতুল। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি সম্প্রতি বলেছেন, ‘এটি গা বাঁচিয়ে সাইডলাইনে দাঁড়ানোর সময় নয়। এটি একটি সার্বভৌম দেশে প্রেসিডেন্ট পুতিনের আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার এবং যথাযথভাবে নিন্দা করার সময়।’ ফ্লোরিডার সিনেটর মার্কো রুবিও মনে করছেন, রাশিয়ার আগ্রাসনে চীনের নিন্দা জানাতে অস্বীকার করার অর্থ হলো চীন ‘ইউক্রেনে নির্দোষ মানুষের নির্বিচার হত্যা করাকে বিনা আপত্তিতে মেনে নিচ্ছে।’
তবে বাস্তবতা হলো চীনের অবস্থান সম্পর্কে পশ্চিমাদের দিক থেকে যা ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, তার সঙ্গে চীনের সত্যিকার অবস্থানের অমিল আছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় চীন সমর্থন দেবে না বললেও কিছু ক্ষেত্রে বেইজিং রাশিয়ার সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ইউক্রেন ইস্যুতে চীন বারবার নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করেছে এবং ক্রমান্বয়ে রাশিয়ার সামরিক তৎপরতার বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। পর্দার আড়ালে চীনের নেতারা রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্কবিষয়ক নীতি পরিবর্তনে নিজেদের মধ্যে আলাপ–আলোচনা করছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
ভয়ের কথা হলো পুতিন দৃশ্যত অযৌক্তিক চিন্তাধারার মানুষ। ইউক্রেনের ওপর হামলা তাঁর বর্বর মানসিকতা উন্মোচন করেছে। পুতিন এমন একজন মানুষ, যার কিছুই হারানোর ভয় নেই। এ ধরনের মানুষ সবচেয়ে বিপজ্জনক। এ কারণেই পারমাণবিক যুদ্ধ এড়াতে কূটনীতিক ও বিশ্বনেতাদের যতটা সম্ভব যুক্তিবাদী থাকতে হবে। এই অদ্ভুত ও ভীতিকর মুহূর্তে বিশ্বের এমন একটি দেশের প্রয়োজন, যেটি তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ থাকবে, ক্রেমলিনের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখবে এবং রাশিয়ার ওপর যার কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকবে। সেই দেশটি হলো চীন।
মনে করা হচ্ছে, নিজের কৌশলগত জায়গাটি ঠিক রাখতে চীন প্রকাশ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলছে না। এটি রাশিয়াকে তার সঙ্গে মিত্রভাব বজায় রাখতে সহায়তা করছে। অন্যদিকে ইউক্রেনও বেইজিংকে তুলনামূলক নিরপেক্ষ বলে মনে করছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি বলেছেন, তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কালেবার কথা হয়েছে এবং সে সময় কালেবা আশা প্রকাশ করেছেন, ইউক্রেন সংঘাতে চীন মধ্যস্থকারী হিসেবে আসতে পারে। চীন যদি মধ্যস্থতা করতে চায়, তাহলে তাকে সতর্কতার সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে আচরণ করতে হবে। রুবলের মান পড়ে যাওয়ায় রাশিয়ার শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস নেমেছে। ওদিকে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান প্রলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এসব বিষয় পুতিনকে অস্থির করে তোলা স্বাভাবিক।
পুতিনকে বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেললে তা পশ্চিমের কাছে ভালো লাগতে পারে। কিন্তু এটিও ভেবে দেখা দরকার, বিশাল পারমাণবিক অস্ত্রাগারে নিয়ন্ত্রণ হাতে আছে, এমন একজন কর্তৃত্ববাদী নেতাকে কোণঠাসা করা গোটা বিশ্বের জন্যই অস্তিত্বের হুমকি তৈরি করে। ইতিমধ্যেই পুতিন ঘোষণা করেছেন, তিনি রাশিয়ার পারমাণবিক বাহিনীকে ‘উচ্চ সতর্কতায়’ রেখেছেন। পুতিনের সেই কথাকে হালকাভাবে নেওয়ার কম। কারণ, তিনি সামরিক ক্ষেত্রে বিবেচনাপ্রসূত আচরণ করেন না। তিনি অনেক কাজই যুক্তির বাইরে গিয়ে করেন। ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক চুল্লিতে রকেট হামলা চালানো দেখেই বোঝা যায়, পুতিন কতটা অবিবেচক।
আজকের রাশিয়ায় পুতিন এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছেন, যেখানে তিনিই শেষ কথা। সাবেক সোভিয়েত আমলেও মস্কোতে পারমাণবিক বোমার নিরাপত্তায় পরমাণুসংক্রান্ত কর্তৃত্ব একচেটিয়াভাবে কারও ছিল না। নিকিতা ক্রুশচেভের পতনের পর সোভিয়েত নেতারা প্রাচীন রোমানদের (বিশেষত জুলিয়াস সিজারের সময়) মতো একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন যেখানে স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত এককভাবে কারও হাতে ছিল না। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের স্থান নেই। কিন্তু সেখানেও নেতাদের মধ্যে কর্তৃত্বের ভারসাম্য ছিল। কিন্তু আজকের রাশিয়ায় তা মোটেও নেই। এখানে পুতিনের ওপর কেউ নেই।
ভয়ের কথা হলো পুতিন দৃশ্যত অযৌক্তিক চিন্তাধারার মানুষ। ইউক্রেনের ওপর হামলা তাঁর বর্বর মানসিকতা উন্মোচন করেছে। পুতিন এমন একজন মানুষ, যার কিছুই হারানোর ভয় নেই। এ ধরনের মানুষ সবচেয়ে বিপজ্জনক। এ কারণেই পারমাণবিক যুদ্ধ এড়াতে কূটনীতিক ও বিশ্বনেতাদের যতটা সম্ভব যুক্তিবাদী থাকতে হবে। এই অদ্ভুত ও ভীতিকর মুহূর্তে বিশ্বের এমন একটি দেশের প্রয়োজন, যেটি তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ থাকবে, ক্রেমলিনের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখবে এবং রাশিয়ার ওপর যার কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকবে। সেই দেশটি হলো চীন।
একটি আশাব্যঞ্জক দিক হলো, চীন পুতিনের সঙ্গে একটি সংলাপ বজায় রাখছে এবং এটি ইউক্রেনে সংঘাত কমাতে সহায়তা করবে। চীনের উচিত উপযুক্ত কূটনীতি প্রয়োগ করা। চীনকে মনে রাখতে হবে, ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, যা চীন ও বিশ্বশান্তির স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● ইয়াশেং হাউং এমআইটি স্লোয়ান স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের গ্লোবাল ইকোনমিকস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ের অধ্যাপক