ইউক্রেনে যে বর্বরোচিত লড়াই চলছে, তা অনেককে ভাবতে বাধ্য করছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কথিত কৌশলগত বিচক্ষণতা অনুযায়ীই সবকিছু চলছে কি না। অর্থাৎ পুতিনের ছক অনুযায়ী এখনো পরিস্থিতি এগোচ্ছে কি না, সবার মধ্যে সেই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।
যদিও পুতিন অনুমান করেছিলেন, ন্যাটো সরাসরি সামরিকভাবে তঁার সঙ্গে লড়তে আসবে না; কিন্তু তিনি পশ্চিমাদের সংহতির সক্ষমতাকে সম্ভবত অবমূল্যায়ন করেছেন। পশ্চিমারা যে এত দ্রুত তাঁর বিরুদ্ধে এক হয়ে নামবে, তা সম্ভবত তিনি অনুমান করতে পারেননি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ও অংশীদারেরা ইতিমধ্যে পুতিনের শাসনের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব কঠিন অর্থনৈতিক ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে। এ ছাড়া তারা কার্যকরভাবে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকে দিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি রাশিয়ার ওপর একটি বিরাট আঘাত।
এটি সত্যি যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া ডলার থেকে নিজেকে অনেকটা সরিয়ে রেখে তার রিজার্ভকে বৈচিত্র্যময় করেছে। কিন্তু যে মাত্রায় রুশবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে এবং রাশিয়ার অর্থনীতিতে যেভাবে এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ছে, তা বিচার করলে দেখা যায়, পুতিনের এ কৌশল তাঁর প্রয়োজনীয় অর্থায়নের সুযোগ নিশ্চিত করতে পুরোপুরি সক্ষম হবে না।
সুইজারল্যান্ড তার ব্যাংকে গচ্ছিত অন্য দেশের অর্থ সাধারণত জব্দ করে না। কিন্তু সেই দেশটিও রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করে মস্কোর ওপর নতুন আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় অংশ নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে
রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তার তাৎক্ষণিক প্রভাব হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত আধিপত্য সামনে উঠে আসছে। আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া যত চাপে পড়ছে, বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব তত বেশি ধরা পড়ছে।
ডলারের বিকল্প হিসেবে রাশিয়া আগে থেকেই চীনের রেনমিনবি এবং অন্য কয়েকটি দেশের মুদ্রায় তাদের রুবল ভাঙিয়ে রিজার্ভ গড়েছে। সেই রিজার্ভ যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে না থেকে থাকে, তাহলে রাশিয়াকে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপে পড়তে হবে।
রাশিয়া অর্থনৈতিক লড়াই মোকাবিলা করতে যে পদক্ষেপই নিয়ে থাকুক না কেন, পশ্চিমের তথা প্রায় গোটা বিশ্বের আর্থিক কেন্দ্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা ভবিষ্যতের আর্থিক বিষয় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থার জন্য কী বয়ে আনবে, সেটিও এক গুরুতর প্রশ্ন।
রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তার তাৎক্ষণিক প্রভাব হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত আধিপত্য সামনে উঠে আসছে। আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া যত চাপে পড়ছে, বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব তত বেশি ধরা পড়ছে।
এটি এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করছে, যা অনেক উদীয়মান অর্থনীতির দেশকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তোলার গতানুগতিক পদ্ধতির বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করছে।
১৯৯৭-৯৮ সালে এশিয়ায় যে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছিল, তা অনেক দেশকে এ ধরনের স্ব-বিমার প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এখন রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে এবং সে কারণে দেশটি তার বৈদেশিক মুদ্রাকে রুবলে রূপান্তর করার ক্ষমতা হারিয়েছে। এ কারণে ডলারের রিজার্ভ বাড়ানোর প্রচলিত কৌশলটি এখন রাশিয়াকে উপকৃত করতে পারছে না।
একই কথা চীনের ক্ষেত্রেও খাটে। রাশিয়ার মতো চীনও যদি কোনো আগ্রাসী পদক্ষেপ নেয়, তাহলে পশ্চিমারা কী অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেবে, তা নতুন করে ভেবে দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেনে অভিযান চালিয়েছে, একইভাবে চীন যদি তাইওয়ানের ওপর হামলা করে, তাহলে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা থেকে চীনকে অংশত হলেও বিচ্ছিন্ন করা হবে বলে ভাবা হয়। এ কারণে কিছু দেশ পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন মুদ্রাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যায় কি না তা নিয়ে ভাবছে। যদি চীনা মুদ্রা রেনমিনবি, রুশ মুদ্রা রুবল, ভারতীয় মুদ্রা রুপি এবং অন্য কয়েকটি মুদ্রা অন্যান্য দেশে ডলারের মতো বিপুল পরিমাণে জমানো ও ভাঙানোর যোগ্য হয়ে উঠত, তাহলে তা আরেকটি বিকল্প আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থা চালু করত। সেটি হলে রাশিয়া এখন যেভাবে বেকায়দায় পড়েছে, তা তাকে পড়তে হতো না। তবে দুটি কারণে সে ধরনের মুদ্রাব্যবস্থা চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
প্রথমত, এর জন্য রেনমিনবিকে যথার্থ আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তা করার ইচ্ছা চীনের নেই। কারণ ডলারের মতো রেনমিনবিকে আন্তর্জাতিক মানে নিতে হলে তার মুদ্রাকে বিদেশে আরও স্বাধীনভাবে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এতে চীন রাজি নয়। চীন চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে তার প্রভাব বাড়াতে।
দ্বিতীয়ত, চীন বা রাশিয়ার মতো বড় শক্তি যদি বড় ধরনের আর্থিক সংস্কারের ঘোষণা দেয়, তাদের পশ্চিমা মুদ্রার বাইরে রাখা মজুতের নিরাপত্তা ও তারল্যের বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য আশ্বাস দিতে হবে। নইলে তাদের মুদ্রায় নিজেদের মুদ্রা ভাঙানোর ঝুঁকি কেউ নেবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জিম ও’নিল যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থমন্ত্রী