করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে অনেকটাই গতি ফিরে পেয়েছিল অর্থনীতি। কয়েক মাস ধরে আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে, স্থানীয় উৎপাদন ও সরবরাহ–শৃঙ্খলেও গতি আসে। ফলে, রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪৪ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা ঘাটতি থাকলেও আগের তুলনায় বেড়েছে আহরণ ও প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আহরণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। মোটাদাগে, প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ। অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) গত অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকারও বেশি আহরণ হয়েছে। প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ।
সম্প্রতি প্রকাশিত এনবিআরের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ১ লাখ ৫১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছে। এই সময়ে শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৯৬ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। সেই হিসাবে, আগামী চার মাসে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। আমরা অবশ্য জানি, বছরের শেষ দিকে সাধারণত রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পায়। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে আগামী চার মাসে প্রতি মাসে গড়ে ৪৪ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। স্বাভাবিক সময়েও প্রতি মাসে এত শুল্ক-কর আদায় হয়নি।
এদিকে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি বিবেচনায় কারণে ৫ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয়বারের মতো এক সপ্তাহের লকডাউন বা রাস্তাঘাট এবং অফিস আদালতে সীমিত উপস্থিতি ঘোষণা করেছে সরকার। এ সময় শিল্পকারখানা খোলা থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এক সপ্তাহ পর পরিস্থিতি বুঝে লকডাউনের সময় বাড়ানো হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এমন অবস্থায় লকডাউন কিংবা করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে আবারও শ্লথগতি দেখা দিতে পারে। এতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আদায়ে কাঙ্ক্ষিত গতি শ্লথ হবে। ফলে, ভবিষ্যতে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। লকডাউন বা সবকিছু বন্ধ থাকলে রাজস্ব আদায়ে কী ধরনের প্রভাব পড়ে, তা গতবারই বোঝা গেছে। গত বছরের এপ্রিল মাসে মাত্র পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় হয়েছিল। বছর শেষে ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। ঘাটতি থাকে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা।
আমরা জানি, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের আট মাস ভালো ছিল না। তবে মাঝের কয়েকটি মাস ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য তুলনামূলক অনেকটা ভালো ছিল। এ ছাড়া করোনার মধ্যেও রাজস্ব বাড়ার জন্য করের হার কমানোসহ আরও বেশ কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে তদারকিও ভালো ছিল। তাই রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও মোটামুটি ভালো প্রবৃদ্ধি ছিল। কিন্তু আবারও লকডাউন ঘোষণা করায় ভবিষ্যতে রাজস্ব আহরণে বড় ঘাটতির শঙ্কা রয়েছে।
এনবিআরের রাজস্ব মূলত আয়কর, মূল্য সংযোজন কর এবং আমদানি শুল্কের ওপর নির্ভরশীল। এ বছর আয়কর খাতে রাজস্ব আহরণ বেশ ভালো। কারণ, গত অর্থবছরের আয়ের ওপর এ বছর আয়কর নেওয়া হচ্ছে। গত অর্থবছরে প্রায় নয় মাস করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছিল না। তাই মানুষের আয় ভালো হয়েছিল। এবার বছরজুড়েই যেহেতু করোনা, তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আয় কম হয়েছে। তাই আয়কর কমার প্রভাবটা মূলত পড়বে আগামী অর্থবছরে।
উপরন্তু, করোনার কারণে প্রায় সবকিছুতে স্থবিরতায় নতুন বিনিয়োগ তেমন নেই, উৎপাদনও কম। সব মিলিয়ে আমদানি কম হওয়ায় শুল্ক কম পাওয়া গেছে। করোনার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, পাশাপাশি ভ্যাট আদায়ে এনবিআর দোকানে দোকানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) স্থাপন করতে পারেনি। এতে ভ্যাট আদায়ও কম হচ্ছে।
এনবিআরের উল্লিখিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট থেকে ৫ হাজার ৩১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার রাজস্ব আহরণ হয়েছে, যা গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। গত ফেব্রুয়ারিতে এ খাতে রাজস্ব আহরণ হয়েছিল ৪ হাজার ৭১১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। তবে গত আট মাসে এ খাতে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আহরণ কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৭৩৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
এ ছাড়া আমদানি পর্যায়ে মূসক বা ভ্যাট থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৩ হাজার ৫০ কোটি ২ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় ১০ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। আর আট মাসে এ খাতে রাজস্ব আহরণ হয় ২২ হাজার ৭০৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি।
আয়কর খাত থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৫ হাজার ৮৮১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। আর আট মাসে এ খাতে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৪৬ হাজার ৬৯৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি।
চলতি অর্থবছরের আট মাসে আমদানি শুল্ক থেকে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ১৮ হাজার ৩১৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক থেকে আট মাসে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৫ হাজার ২০৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ কম। স্থানীয় পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক থেকে আট মাসে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ১৮ হাজার ৬৫১ কোটি ২২ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি।
এ ছাড়া গত আট মাসে আবগারি শুল্ক থেকে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ২ হাজার ১৪০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ভ্রমণ–কর থেকে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ১৮৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। পাশাপাশি টার্নওভার ট্যাক্স থেকে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৬৫ লাখ টাকা।
কোভিডকালে নাহয় কিছুটা কম রাজস্ব নিয়ে চললাম, কিন্তু ভবিষ্যতে এগোতে হলে কিংবা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য আমাদের রাজস্ব আদায় অনেক বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে রাজস্ব ব্যবস্থায় সংস্কারেও হাত দিতে হবে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় আদর্শ করপোরেট কর আরও কম হওয়া উচিত। কিন্তু হঠাৎ এ করের হার কমানো হলে রাজস্ব আহরণের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ জন্য অবশ্য ব্যক্তি বা কোম্পানি কর্তৃক মুনাফা লুকানো কিংবা সম্পদ অপ্রদর্শনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। করহার কমানোর আগে কর ব্যবস্থায় সুশাসন, জবাবদিহি নিশ্চিত করাসহ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে রাজস্ব বিভাগকে। মন্ত্রী, এমপি, সচিব, সামরিক কর্মকর্তা, গবেষণা সংস্থা—কাউকেই করজালের বাইরে রাখা যাবে না। যত দূর সম্ভব ‘কর অব্যাহতি’ তুলে দিতে হবে। জনগণের জন্য কর প্রদানকে করতে হবে এক সুখকর অভিজ্ঞতা। কর প্রশাসনকে যেতে হবে করদাতাদের দোরগোড়ায়।
মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে নজর দিতে হবে আমাদের। সেসব দেশ রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং এর ব্যবস্থাপনায় অধিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পেরেছে। এ ছাড়া হিসাবরক্ষক ও অডিটররা যেন নৈতিকতা মেনে যথাযথভাবে কাজ করতে পারেন, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।
যখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ওপর করারোপের কথা বলা হয়, তখন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির মধ্যে বিভাজন থাকা উচিত নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাথমিক এক জরিপে উঠে এসেছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে কর ছাড় দেওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে অধিক কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিশ্চিত করেনি। এর অর্থ, সেখানে করবহির্ভূত অন্য প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করছে, যা শেয়ারবাজারে নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তিকে আরও নিরুৎসাহিত করে তুলছে। একই সঙ্গে, যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানি ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে, কিংবা সহস্রাধিক ব্যক্তির কর্মসংস্থান দিচ্ছে, তাদের কর কমানো উচিত। কেননা, এটি জনগণের সঙ্গে অধিক মুনাফা ভাগাভাগিতে অন্য কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করবে। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করবে।
কর অব্যাহতির অন্য ক্ষেত্র হলো সিএসআর কার্যক্রম। সিএসআর কর্মকাণ্ডে কর অব্যাহতির সুযোগ সমর্থন করলেও সিএসআরের নামে যা হচ্ছে, সে সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন বা আপত্তি রয়েছে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে যথাযথ ও কার্যকর পাঠক্রম প্রণয়নের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী সম্প্রদায় বা পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় অধিক অর্থ ব্যয় করা উচিত। আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক ও কৃষি গবেষণা, শিক্ষা এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মতো ক্ষেত্রগুলো উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। সিএসআরের অর্থ সেসব খাতেই ব্যয় হওয়া দরকার। সিএসআরের বিনিয়োগ কোথায় যাচ্ছে, এনবিআরকে সেটা তদারক করতে হবে এবং একই সঙ্গে একটি স্বাধীন এজেন্সির মাধ্যমে নিয়মিত বিরতিতে এর প্রভাব মূল্যায়ন করা উচিত। অডিট ফার্মগুলোকেও কঠোর তদারকির আওতায় আনা দরকার। প্রতিটি দেশেই করপোরেট প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় হিসাববিদদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই আমাদের দেশেও তাঁদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
এনবিআরের অটোমেশনও গুরুত্বপূর্ণ। এটা কেবল কর ফাঁকি ধরতে সাহায্য করবে না, উপরন্তু এটি নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা এবং এনবিআর ডেটাবেইসের সঙ্গে কর প্রদানকারীর ব্যাংক হিসাবের যোগাযোগ তৈরিতে সহায়তা করবে। এনবিআর এরই মধ্যে কিছু সার্ভিস সেন্টার খুলেছে। এ ব্যাপারে করদাতাদের ওয়াকিবহাল করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে সার্বক্ষণিক কলসেন্টার প্রতিষ্ঠা, বিশেষভাবে ছুটির দিনগুলোয় কলসেন্টারকে কার্যকর রাখতে পারলে গ্রাহকনন্দিত হবে এনবিআর। রাজস্ব বিভাগে কর গোয়েন্দা সেলকে আরও সক্ষম ও কার্যকর করাটাও অতীব বিবেচ্য হওয়া উচিত।
মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক।