২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

রাজনৈতিক দলের উপকমিটির উপযোগিতা

তিন–চার বছর আগে ঢাকার উপকণ্ঠে এক আত্মীয়ের বাসা খুঁজতে গিয়ে এ গলি–সে গলি ঘুরতে হয়েছিল। এক বাড়ির দেয়ালে দেখি সাইনবোর্ডে লেখা এক ব্যক্তির নামের পাশে পদবি ‘আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক’, (বোধ হয় থানা কমিটির), বাংলাদেশ বিদ্যার্থী লীগ। আর কেউ জানুক বা না জানুক, পাড়াপড়শি ঠিকই বোঝেন তিনি যেমন তেমন লোক নন।

বাংলাদেশের দুটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে পরবর্তী ২৫-৩০ বছরের সাংগঠনিক বিষয়ের কাগজপত্র সংগ্রহ করেছি আমি অনেক বছর ধরে। দল দুটি হলো আওয়ামী লীগ এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। নেতৃত্বের গুণে একটি দল আজও সাবলীলভাবে টিকে আছে, অন্যটি নেতৃত্বের দুর্বলতায় বিলুপ্তপ্রায়। তবে দেশের গণতান্ত্রিক ও বাম আন্দোলনে সেটিরও একসময়ের ভূমিকা কম নয়।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। তখন দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ছিল ছোট। তারপর ছিল জেলা কমিটি, মহকুমা কমিটি ও থানা কমিটি। সেগুলোও ছিল ছোট। সংখ্যায় নেতা কম হলেও, যাঁরা পদে ছিলেন তাঁরা কাজ করেছেন জান-প্রাণ দিয়ে। রাজার লোক তাঁদের ছায়া অনুসরণ করত। হয়তো সন্ধ্যার পরে ভাত খেতে বসেছেন, দেউড়ির কাছে খাকি পোশাক পরা দুজন হাজির। গলা খাকারি দিয়ে একজন বলেন, ‘তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করেন, থানায় চলেন, আসমানের অবস্থা ভালো না, বৃষ্টি আইয়া পড়ব।’ থালায় ভাত পড়ে থাকত; থানায় যে যেতেন, কয় মাস পরে বাড়ি ফিরবেন তার নিশ্চয়তা ছিল না। কখনো কয়েক বছর জেলের ভাত খেতে হতো। সেই দল জাতীয় জীবনের মহত্তম ঘটনা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। সেদিন সারা দুনিয়ার মানুষ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাঙালিকে সমর্থন দিয়েছে। তখন দলের কোনো আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটি ছিল না।

বড় বড় রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদে বিভিন্ন বিষয়ক সম্পাদকের পদ থাকে। আওয়ামী লীগেও প্রথম থেকে তা ছিল, যেমন সাংগঠনিক সম্পাদক, শ্রমবিষয়ক সম্পাদক, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, প্রচার সম্পাদক, দপ্তর সম্পাদক প্রভৃতি। পরে যোগ হয়েছিল আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকসহ আরও কোনো কোনো পদ। আওয়ামী লীগের কোন জাতীয় কাউন্সিল থেকে সাংগঠনিক কমিটিতে ‘উপপরিষদ’–এর উদ্ভব, তা আমার জানা নেই। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিয়ে ৫০ বছর ঘাঁটাঘাঁটি করেও বুঝতে পারি না উপপরিষদের উপযোগিতা কী; এবং উপপরিষদ যদি বিশেষ জরুরি হয়েও থাকে, তার আকারই-বা কী হবে।

আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির এক সদস্য আগেও স্বনামধন্য ছিলেন, এক সপ্তাহ ধরে তিনি রয়েছেন লাইমলাইটে। তিনি পাদপ্রদীপের আলোতে থাকায় উপকমিটির চেয়ারম্যানকে নয়, তাঁকেই মানুষ চেনে। আলোচ্য কীর্তিমান ২০১৬-১৯–এর উপকমিটিতে ২৪ নম্বর সদস্য ছিলেন। তিনি আগের কমিটির প্রায় সব বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন। ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পর এখন পর্যন্ত নতুন উপকমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে পুরোনো কমিটিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের নিয়েই একাধিক বৈঠক হয়েছে।’ [কালের কণ্ঠ, ১১ জুলাই]

বাংলার মাটিতে সব ব্যাপারে যেমন অস্পষ্টতা, রাজনৈতিক দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটিতে সদস্য কত, তা নিয়েও অস্পষ্টতা না থেকেই পারে না। দলের এক যুগ্ম সম্পাদক সাংবাদিকদের বলেছেন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির ‘মিটিংয়ে ৫০-৬০ জন উপস্থিত থাকেন।’ উপকমিটির সভাপতি বলেছেন, ‘মিটিংয়ে ৩০-৪০ জন উপস্থিত থাকে, অন্য সদস্যদের মতো আমি তাকেও চিনি।’

উপকমিটির সদস্যসচিব কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর নামে কখনোই কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি। তাহলে নিয়মিত বৈঠকে আসতেন কী করে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাঁকে কখনোই আমন্ত্রণ করিনি। তবে কারও সঙ্গে এলে তো আর ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া যায় না।’

দলের তিন নেতার তিন রকম ভাষ্যে পাঠক কী বুঝলেন। সব পাঠক যে আহাম্মক তা নয়। দলের উপকমিটির সভাপতি বলছেন তাঁদের মিটিংয়ে ৫০-৬০ জন সদস্য উপস্থিত থাকেন। আমরা জানি কোনো কমিটির কোনো সভায় সব সদস্য উপস্থিত থাকতে পারেন না। উপকমিটির সভাগুলোতে যদি ৬০ জন উপস্থিত থাকেন তাহলে ধারণা করা যায়, তার সদস্য শ খানেকের কম নয়। তবে প্রকৃত সংখ্যাটি জানা যায়নি। কোনো নাদান পাঠক যদি অনুমান করেন যে জাতিসংঘের যতগুলো সদস্যদেশ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্যসংখ্যাও তত, তঁার দোষ কী?

আরেকটি বিষয় যেটা উঠে এসেছে নেতাদের কথা থেকে তা হলো আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সভায় কোনো সদস্যের সঙ্গে কোনো উপসদস্যও যোগ দিতে পারেন। এমনকি যে কেউ যোগ দিতে পারেন এবং যোগ দিলে তাঁকে ‘ঘাড় ধরে বের করে’ দেওয়া হয় না সৌজন্যবশত। আলোচ্য কীর্তিমান হাসপাতালের স্বত্বাধিকারী সেভাবেই মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেছেন, উপকমিটির সদস্য হিসেবে নন। কোনো দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কি এভাবেই চলে? দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই এখন গণতান্ত্রিক সরকার, আর কোন দেশে আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটি এত বিপুলসংখ্যক সদস্য দ্বারা গঠিত, জনগণকে জানালে ভালো হয়।

বাংলাদেশের বড় দুই দলের উপকমিটিগুলোর সদস্য হওয়ার জন্য কাউন্সিলের আগে থেকে যে তদবির শুরু হয় তা জাতিসংঘের মহাসচিবের পদের জন্যও হয় কি না সন্দেহ রয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব হওয়ার জন্য অন্যভাবে তদবির হয়, টাকা খরচ করতে হয় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি বা উপকমিটির সদস্য হওয়ার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়। কমিটি-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। ক্ষমতাসীন দলের কোনো কমিটির সদস্য হওয়ার মধ্যে যে মধু আছে, সেই অমৃতের স্বাদ যে একবার পেয়েছে, তার কাছে দুনিয়ার সবকিছু বিস্বাদ।

দুই নম্বর ব্যবসায়ী এবং কালোটাকার মালিকদের উপকমিটির সদস্য না করেও উপায় নেই। উপকমিটিগুলোর যে মিটিং বা সেমিনার হয় চারতারা, পাঁচতারা হোটেলে, তার খরচ বহন করে কে? কয়েক বছর আগে দলের একাধিক প্রধান নেতার কাছে শুনেছি, দলের তহবিলে এ ধরনের বাজেট নেই। একেকটি মিটিং বা সেমিনারে যে পাঁচ-সাত লাখ টাকা খরচা হয় তা দল বহন করে না, কোনো কোনো সুযোগ্য সদস্যই বহন করেন। খরচা করব আর ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট বেচে সে টাকা তুলব না, তা হয় না।

উপকমিটির মিটিংয়ে বক্তাদের মুখনিঃসৃত বাণীর বিষয়বস্তু যেমন অমূল্য, মিটিং-উত্তর লাঞ্চ বা ডিনারের মেনুর সঙ্গে পরিবেশিত আন্তর্জাতিক বস্তুটিও অমূল্য। প্রকাণ্ড উপকমিটির উপযোগিতা তাই অসামান্য। উপকমিটি যদি তিন–চার সদস্যবিশিষ্ট হতো, তাহলে অভিজাত হোটেলে সভা করতে হতো না, দুই নম্বরি ধনকুবেরদেরও সদস্য করতে হতো না। সুতরাং গলদটা গোড়ায়। সেই গলদ দূর না করলে রাজনৈতিক দলগুলোর উপকমিটির সদস্যে ভরে যাবে দেশ।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক