২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

রাজনৈতিক দল, গণতন্ত্র ও মন্ত্রিত্ব

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা সংগঠন বা রাজনৈতিক দল ছাড়া সম্ভব নয়। বহুদলীয় গণতন্ত্র বলতে গণতান্ত্রিক দেশগুলো বোঝে একাধিক রাজনৈতিক দল। একাধিক বলতে দু-তিনটি প্রধান দল আর কয়েকটি ছোট-মাঝারি দল। তবে ‘যত গুড় তত মিঠা’ প্রবচনটি শুধু বাংলাদেশি বহুদলীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। বাংলাবাসী রাজনীতিবিদদের প্রতিজ্ঞা, অগণিত দল গঠন করে গণতন্ত্রকে বাংলার মাটির প্রতি ইঞ্চি জায়গায় দৃঢ়ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন না। তাই চল্লিশটির মতো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থাকার পরে অনিবন্ধিত আরও যে শতাধিক দল আছে, সেগুলোও নিবন্ধনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। বছরের শেষের দিকে নির্বাচন; নিবন্ধিত না হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সরকার গঠন করা অথবা নিদেনপক্ষে সংসদে বিরোধী দলে থাকাও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, নতুন ৭৬টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। আবেদন জমা দেওয়ার দিন ছিল ৩১ ডিসেম্বর। কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ১৫টি দল আবেদন করার সময় বাড়ানোর প্রার্থনা করেছিল, কিন্তু সময় বাড়ানো হবে না। কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি যাচাই করে দেখবে আবেদনকারী দলগুলো নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করেছে কি না। প্রয়োজনে মাঠপর্যায়ে তদন্ত করা হবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যাচাই-বাছাইয়ে যাদের আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে, তাদের নাম কমিশনে সুপারিশ করা হবে। কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। যারা নিবন্ধিত হবে, তারা সামনের সব নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে।’

নির্বাচনেই যদি অংশগ্রহণ না করবে এবং বিজয়ী হয়ে এককভাবে অথবা কোয়ালিশন করে সরকার গঠনের আশাই না করবে, তাহলে খামোকা শেরেবাংলা নগরে দৌড়ঝাঁপ করবে কেন? ৭৬টি দলের সভাপতি/চেয়ারপারসন এবং সাধারণ সম্পাদক/মহাসচিবদের সঙ্গে প্রাথমিক কথা বলার জন্য যদি তাঁদের নির্বাচন কমিশনে ডাকা হয়, তাঁদের বসতে দেওয়ার জন্য ১৫২টি চেয়ারের প্রয়োজন হবে। সে এক বড় রকমের সভা! তাঁদের চা-নাশতা খাওয়ানোও কম ঝামেলার ব্যাপার নয়। কিন্তু বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে রাষ্ট্রকে তা করতেই হবে।

সাধারণত একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয় নেতা-কর্মী-সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের সম্মেলনের মাধ্যমে। নেতৃত্বে থাকেন নামজাদা নেতারা। সেভাবেই গঠিত হয়েছিল উপমহাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৮৮৫ সালে। ভারতবর্ষের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে বাঙালি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন। কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত এবং প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। উপমহাদেশে দ্বিতীয় দল গঠিত হয় ২১ বছর পর ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। ঢাকায় অনুষ্ঠিত যে সম্মেলনে নবাব খাজা সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ গঠিত হয়, তাতে যোগ দিয়েছিলেন নবাব ওয়াকার-উল মুল্‌কসহ উপমহাদেশের কয়েক হাজার মুসলমান নেতা। লীগের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান। যে আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়, সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে, ঢাকাতেই ১৯৪৯ সালে, নেতা-কর্মীদের এক সম্মেলনে। সেই আওয়ামী লীগই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ—শখানেক দলের প্রয়োজন হয়নি। দলের মতো দল দু-একটিই যথেষ্ট।
নিবন্ধনের জন্য আবেদনকারী দলগুলোর নাম উপভোগ করার মতো। কোনোটির নামই বলে দেয় তার নীতি, আদর্শ ও লক্ষ্য। কোনোটির আদর্শ বিপ্লবী, কোনোটি প্রায়-বিপ্লবী, কোনোটি ইসলামবাদী, কোনোটির নাম প্রবন্ধগ্রন্থের মতো, কোনোটি বিমূর্ত কাব্যধর্মী, কোনোটির নাম দেখে মনে হয় পরাবাস্তববাদী, কোনোটির নামের কোনো অর্থই হয় না। মানব জাতির ইতিহাসে একসঙ্গে এত দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল কি না জানি না। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ নিবন্ধন ছাড়াই জন্ম লাভ করে মানুষের মধ্যে কাজ করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এ বছর যেসব ছেলেমেয়ে পিএসসি/জেএসসি পরীক্ষা দেবে, তারা যদি এসব দলের নেতাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘রাজনৈতিক দল কাকে বলে এবং তার নেতাদের কাজ কী’—তারা কী জবাব পাবে বলতে পারব না। সাধারণ বুদ্ধিতে যা বুঝি তা হলো রাজনৈতিক দলের কাজ জাতির সমস্যাগুলো শনাক্ত করে তা সমাধানের জন্য জনমত সৃষ্টি করা এবং জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে নেতাদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কাজ করা। জাতির একেক অবস্থায় রাজনৈতিক দলের একেক রকম কাজ। দেশ যখন পরাধীন ছিল, তখন স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কাজ করেছেন। ঔপনিবেশিক সরকার অন্যায় বা জনবিরোধী কাজ করলে তার প্রতিবাদ করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্লামেন্ট নির্বাচেনে অংশগ্রহণ করে কেউ সরকার গঠন করেছেন, কেউ বিরোধী দলে থেকে জনগণের অধিকার বা স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছেন। রাজনীতি করলে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে অনেকে সেসব না হয়েও মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান পান। মহাত্মা গান্ধী, আবদুল গাফ্ফার খান, কমরেড মোজাফফর আহমদ, মাওলানা ভাসানী, সুভাষচন্দ্র বসু, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখ উপমহাদেশের শ্রদ্ধেয় নেতা মন্ত্রী বা কোনো রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণ করেননি। আজও তাঁদের নাম উচ্চারিত হয়।
রাজনৈতিক দলের নেতারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাই তাঁরা নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে যাবেন, কেউ মন্ত্রী হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। সংসদনেতা সরকার পরিচালনার জন্য তাঁকে সহায়তা করতে তাঁর আস্থাভাজনদের থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য মনোনীত করেন। মন্ত্রিসভার আকার কী হবে, তা প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার বিষয়। দশ-বারোজন মন্ত্রী দিয়ে একটি বিরাট দেশ চালানো যায়। ব্রিটিশ আমলে আফগানিস্তানের সীমান্ত থেকে বার্মা (মিয়ানমার) পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপমহাদেশ চালিয়েছেন ভারতের গভর্নর জেনারেলের জনা দশেক কাউন্সিল সদস্য (মন্ত্রী)। ১৯৪৬-৪৭-এ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কেবিনেটে মন্ত্রী ছিলেন ১৩ জন। তাঁরা এখনকার ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্মিলিত এলাকার শাসনকাজ পরিকল্পনা করেছেন। পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশই স্বাধীনতা লাভের পর ১০-১২ জন মন্ত্রীই দেশ চালিয়েছেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এ বাংলাদেশের সবচেয়ে জটিল সময়ে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় ১০-১২ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী দেশ চালিয়েছেন। মন্ত্রিসভার আকার প্রকাণ্ড হলেই সরকার দক্ষ হয় এমন নজির নেই। সব ক্ষেত্রেই অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট প্রবচনটি অর্থবহ।
যে দেশে বেশি বেশি রাজনৈতিক দল, সে দেশে গণতন্ত্রের পরিমাণ বেশি; যে দেশে মন্ত্রিসভা যত বড় সে দেশের সরকার তত দক্ষ এবং যে দেশে অকাল পদোন্নতিপ্রাপ্ত আমলার সংখ্যা অগণিত, সে দেশের প্রশাসন তত দক্ষ—এই তত্ত্ব যদি সঠিক হয়, তাহলে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র।
স্বাধীন মিডিয়া সরকার ও বিরোধী দলকে কঠোর সমালোচনা করতে দ্বিধা করে না। সরকারের ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়। কিন্তু মিডিয়ার ভুল ধরবে কে? হঠাৎ একশ্রেণির মিডিয়া থেকে শোনা গেল, নতুন বছরে ‘চমক’ আসছে। চমকটা কী? মন্ত্রিসভায় রদবদল। এই রদবদলের কথা ঘোষিত হওয়ায় জনগণ যতটা চমকিত হয়েছে, তার চেয়ে শতগুণ বেশি চমকিত নয় বরং আতঙ্কিত হয়ে পড়েন অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। চমক শব্দের অর্থ ভয়ে বা বিস্ময়ে চমকে ওঠা অথবা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে আঁতকে ওঠা। আকস্মিক কোনো কোনো ঘটনা দেশবাসীকে চমকে দিতে পারে। সে রকম ঘটনা অনেক গণতান্ত্রিক দেশে ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গোটা মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে পদত্যাগপত্র পেশ করে নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানায়। মন্ত্রিসভা থেকে কেউ পদত্যাগ করেননি, কেউ বাদ পড়েননি, যুক্ত হয়েছেন কয়েকজন, প্রমোশন পেয়েছেন একজন, রদবদল হয়েছে দপ্তর—এগুলোকে কেউ ‘চমক’ বলে না। তবে এই পরিবর্তনে যদি কেউ ‘অসন্তুষ্ট’ হয়ে থাকেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। অবেলায় কেউ যে বাদ পড়েননি সেটা পরম স্বস্তির। টক শো থেকে প্রাজ্ঞ কেউ কেউ বলে দিলেন, এই পরিবর্তনে ‘সরকারে গতি সঞ্চার হলো’; যেন নতুন দক্ষদের না নেওয়ায় এত দিন সরকার স্থবির হয়ে পড়েছিল।
তা যে খানিকটা ছিল তা বোঝা যায় নবনিযুক্তদের কারও কারও কথাবার্তায়। জনগণের অনেকের চমকটা সেখানেই। বাংলাদেশ বিমানের অবস্থা শোচনীয়, তা দুনিয়াসুদ্ধ মানুষ জানে। বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যিনি পেয়েছেন, তাঁর সূচনা বক্তব্য বিস্ময়কর। তিনি বলেছেন, একচুল ছাড় তো কাউকে দেবেনই না, লোকসানে থাকা বিমানকে ‘আমার রক্ত দিয়ে হলেও লাভজনক করব’। তিনি বলেছেন, ‘মন্ত্রী হব, জীবনেও ভাবিনি। আমার দায়িত্ব নেওয়াকে অনেকে আগুনে নিক্ষেপ করার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আগুন নয়, এটা আমার জন্য পানি। বিমানকে লাভজনক করা খুব কঠিন কাজ নয় বলে আমি মনে করি।’ তিনি আগামী আট মাসে বিমানকে ‘এশিয়ার সেরা এয়ারলাইনসে’ পরিণত করার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। তাঁর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। অব্যবহিত আগের বিমানমন্ত্রী বললেন, তিনি আকাশে ছিলেন, মাটিতে নামলেন। ঊর্ধ্বলোক থেকে ধরায় নামার অর্থ ধরাশায়ী হওয়া নয়। মাটির মানুষের সমাজে কল্যাণমূলক কাজ করা আরও সুখের।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী যিনি ছিলেন তাঁর নিষ্ঠা, সততা, দক্ষতা এবং দলের ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আনুগত্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। তাঁকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দিয়ে যাঁকে মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়েছে তাঁর অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। নিযুক্তির পর তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী একটি ডুবন্ত নৌকাকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব আমার ওপর দিয়েছেন। আমি সফল হলে প্রধানমন্ত্রীও সফল হবেন। সাত দিন আমি ছাত্র থাকব, এরপর আমি আমার কাজ শুরু করব।’ মন্ত্রণালয়কে ‘ডুবন্ত নৌকা’ বলা শুধু তাঁর পূর্বসূরিকে অসম্মান করা নয়, নয় বছরের সরকারকেও অমর্যাদা করা। তাহলে কি নয়টি বছর এই বিভাগে সরকার কিছুই করেনি?
রাজনৈতিক নেতাদের অনেক সময় পুলিশের লাঠিপেটাসহ নির্যাতন-নিপীড়ন সইতে হয়। গান্ধী, নেহরু, ভাসানীর মতো নেতাও শারীরিক আঘাত পেয়েছেন। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তাঁরা অবিচলভাবে জাতির জন্য কাজ করেছেন। রাজনীতি করলেই মর্যাদার উঁচু আসন সবাই পান না। সৌভাগ্যবশত যাঁরা পান, তাঁদের আচরণ ও কথাবার্তা সুন্দর ও সংযত হবে মানুষের সেটাই প্রত্যাশা। শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে একটি জাতিকে মর্যাদাসম্পন্ন করা যায় না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।