২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

রাজনীতির খোলনলচে পাল্টে যাওয়ার দিন

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, লে. কর্নেল আবু তাহের

একটি দিন নিয়ে তিনটি পক্ষ। দিনটি কারও জন্য কষ্টের, কারও জন্য আনন্দের। একটি দিবস নিয়ে এত পক্ষ-বিপক্ষ খুব কম দেখা যায়।

এ দেশে শতভাগ ঐকমত্য নিয়ে কোনো একটি দিবস উদ্‌যাপিত হয় না। দু-একটি ক্ষেত্রে প্রকাশ্য বিরোধিতা না থাকলেও ভেতরে-ভেতরে অস্বস্তি টের পাওয়া যায়। কিন্তু ৭ নভেম্বর নিয়ে মতভিন্নতা বেশ খোলামেলা। কারণটি অবশ্যই রাজনৈতিক।

১৯৭৫ সালে এ দেশে তিনটি সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে একধরনের পরম্পরা লক্ষ করা যায়। ১৫ আগস্ট ক্ষমতার বারান্দায় ঢুকে পড়ে সেনাবাহিনী। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে এক গ্রুপকে সরিয়ে জায়গা করে নেয় আরেকটি গ্রুপ। ৭ নভেম্বরে সেনাবাহিনী ঢুকে যায় ক্ষমতার অন্দরমহলে। ৭ নভেম্বরকে বলা যায় ইতিহাসের একটি ‘কাট অব পয়েন্ট’। এর আগের আর পরের বাংলাদেশ এক নয়।

৭ নভেম্বর আমরা একটি ত্রিমুখী লড়াইয়ের মীমাংসা হতে দেখি। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন মুক্তিযুদ্ধের তিনজন কমান্ডার—মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং লে. কর্নেল আবু তাহের। ক্ষমতার লড়াইয়ে ৭ নভেম্বরের প্রথম প্রহরেই ছিটকে পড়েন খালেদ মোশাররফ—দুজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা, লে. কর্নেল এ টি এম হায়দারসহ নিহত হন নৃশংসভাবে। তাঁরা তিনজনই ছিলেন একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা—বীর উত্তম। একটি পক্ষ দিনটিকে স্মরণ করে ‘মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’ হিসেবে।

৭ নভেম্বর বেলা গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার লড়াইয়ে হেরে যান আরেক বীর উত্তম আবু তাহের। নিজের অবস্থান সংহত করে সেনানিবাসের ভেতরে ও বাইরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন জিয়াউর রহমান। তিনিও বীর উত্তম। একাত্তরের সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধারা একে অপরের বিরুদ্ধে সেদিন কেন দাঁড়িয়েছিলেন, তা নিয়ে অনেক লেখাজোখা হয়েছে। কতিপয় ‘বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা’ কিংবা ‘একাত্তরের পরাজিত শক্তি’ অথবা ‘সাম্রাজ্যবাদের দালাল’—এসব রাজনীতি-আশ্রিত শব্দ দিয়ে ঘটনাটিকে বর্ণিল করতে গিয়ে আসল বিষয় হারিয়ে যেতে বসেছে। ইতিহাসের সত্য খোঁজার চেয়ে রাজনৈতিক লাভালাভকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তৈরি হয়েছে অপ-ইতিহাস।

একাত্তরে এ দেশে একটি সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ হয়েছিল। দুই দশকের ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে শুরু হয়েছিল এই যুদ্ধ। এতে জনগণের নানা অংশের সঙ্গে শামিল হয়েছিলেন পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর অনেক বাঙালি সদস্য। যুদ্ধটা সবাই মিলেই করেছেন। কিন্তু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মালিকানা নিয়ে শরিকানা বিরোধ ছিল শুরু থেকেই। একদল বলে, আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, অন্য দল বলে আমরা। এ নিয়ে দেশটা ভাগ হয়ে গেছে জন্মলগ্ন থেকেই। সবার মুখে একই আওয়াজ—যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই। দেশে শুরু হলো সংঘাতের রাজনীতি। এ ধারাবাহিকতায় এল জরুরি আইন, একদলীয় সরকারব্যবস্থা এবং সেনা অভ্যুত্থান। স্মরণকালের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো ৭ নভেম্বরেও। এ দেশে সব শাসকের হাতেই আছে রক্তের দাগ। ব্যতিক্রম শুধু খালেদ মোশাররফ, যাঁর শাসনক্ষমতায় থাকার সুযোগ হয়েছিল মাত্র তিন দিন।

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে খালেদ টেকসই করতে পারেননি। জনমনস্তত্ত্ব তো দূরের কথা, সেনামনস্তত্ত্বও তিনি বুঝতে পারেননি। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে চরম মূল্য দিতে হয়। খালেদ-হুদা-হায়দার যে পরিস্থিতিতে নিহত হলেন, তা বিয়োগান্ত। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ‘মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’।

অন্য দুটি পক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই খালেদ-হুদা-হায়দারকে নিয়ে। তঁারা খালেদের কপালে তকমা লাগিয়ে দিলেন—ভারতের দালাল। ‘বিশ্বাসঘাতক খালেদ মোশাররফ চক্র’কে উৎখাতের আহ্বান জানিয়ে সেনানিবাসে লিফলেট বিলি করল জাসদ। এর অনুঘটক হলেন তাহের। ফলে যে অভ্যুত্থানটি হলো, জাসদ তাকে ‘সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে উদ্‌যাপন করে। তাদের দাবি, ওই দিন সিপাহি আর জনতা গলাগলি করে পথে নেমেছিল দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য।

জাসদের অভ্যুত্থান পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে একটি ‘শোষণমুক্ত সমাজ’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে জন্ম হয়েছিল জাসদের। তারা জমি চাষ করেছে, বীজ বুনেছে, ফসল ফলিয়েছে। সে ফসল কেটে নিয়ে গেছে ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একটি দল।

প্রশ্ন হলো, ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পাল্টা কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে জাসদ কেন খালেদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হলো? এটা স্পষ্ট যে ১৫ আগস্টের আগে-পরে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে জাসদের একটি সমীকরণ তৈরি হয়েছিল। জাসদ ভেবেছিল, তাদের ‘বিপ্লবে’ সেনাবাহিনীর সমর্থন পাওয়া যাবে। যেভাবেই হোক, জাসদ নেতাদের এটা গেলাতে পেরেছিলেন তাহের। জিয়া ভেবেছিলেন, তাহেরের মাধ্যমে জাসদের মতো একটি সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তিকে তিনি হাতে পাবেন। তাহেরের ওপর জাসদ একটু বেশি নির্ভর করেছিল এবং জিয়ার শক্তিকে খাটো করে দেখেছিল।

জাসদের প্রচারে জানা যায়, জিয়া তাঁর প্রাণ বাঁচাতে তাহেরের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, জিয়ার প্রাণসংশয় হলে তাতে জাসদের কী আসে যায়? এটা স্পষ্ট যে তাদের লক্ষ্য ছিল অভিন্ন—খালেদকে হটাতে হবে।

জিয়ার প্রাণসংশয়ের তত্ত্বটি সম্পূর্ণ ভুয়া। জিয়াকে অন্তরীণ করেছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের লোকজন। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল কর্নেল শাফায়াত জামিল ও মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদের। তাঁরা দুজনই বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করছেন। তাঁরা জিয়াকে শুধু অন্তরীণ করেননি, তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেছেন। জিয়া সপরিবার বাড়িতেই ছিলেন। জিয়ার নিরাপত্তার জন্য খালেদ কখনোই হুমকি হয়ে ওঠেননি।

৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল জাসদ-সমর্থিত ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’। এরা তাহেরের অনুগত। কিন্তু অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন সব স্তরের সিপাহিরা। তাঁরা সবাই জাসদের সমর্থক নন। তাঁদের একটি বড় অংশ জিয়ার অনুগত ও অনুরাগী। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল মেজর ফারুক রহমানের কমান্ডে বেঙ্গল ল্যান্সার্স এবং মেজর খন্দকার আবদুর রশিদের নেতৃত্বাধীন সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি। ৭ নভেম্বর ফারুক-রশিদের এ দুটি ইউনিটের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের অনেকেই ছিলেন পাকিস্তান-প্রত্যাগত। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা ৩ নভেম্বরে দেশ ত্যাগ করলেও তাঁদের একজন থেকে যান। তিনি হলেন আর্টিলারি রশিদের ইউনিটের মেজর মুহিউদ্দিন। ৭ নভেম্বর প্রথম প্রহরে তিনি জিয়াকে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্ত করে সেকেন্ড ফিল্ডের দপ্তরে নিয়ে আসেন। তাহেরের লোকজন জিয়াকে মুক্ত করেছেন, এ দাবি ধোপে টেকে না।

১৫ আগস্টের কুশীলবদের সঙ্গে জাসদের যোগাযোগ ছিল কি না, তা গবেষণার বিষয়। কিন্তু তাহেরের যোগাযোগ ছিল। ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের একটু আগে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে একটি ১২ দফা দাবিনামা লেখা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে দুটি বেশ কৌতূহল জাগায়। যেমন ১০ নম্বর দাবিতে বলা হয়, ‘যেসব সামরিক অফিসার ও জওয়ানকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে, তাদের দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।’ ৩ নভেম্বর দেশ ত্যাগ করার সময় একটা সমঝোতা হয়েছিল যে অবস্থার পরিবর্তন হলে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা আবার দেশে ফিরে আসবেন। জিয়া অবশ্য তাঁদের ফিরিয়ে আনেননি। তিনি কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করেছেন বিদেশে তাঁদের পুনর্বাসন করে।

১২ দফার ১২ নম্বর দাবিটি ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত সৈন্যদের তুষ্ট রাখার জন্য, ‘পাকিস্তানফেরত সামরিক বাহিনীর লোকদের ১৮ মাসের বেতন দিতে হবে।’

এখানে একটি কথা না বললেই নয়। ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের লোকেরাই খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা আলো করেছিলেন। তাঁদের অনেক শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হন। চারজন জেলে নৃশংসভাবে নিহত হন। অনেকেই আত্মগোপন করেন। কেউ কেউ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। ১৫ আগস্টের পর তাঁদের কোনো প্রতিবাদ বা প্রচারপত্র চোখে পড়েনি। তাঁরা বেশ বুদ্ধিমান। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সরকারগুলোর সঙ্গে তাঁরা কোনো সংঘর্ষে যাননি। সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন। দীর্ঘদিন পরে হলেও সময় তাঁদের কাছে ধরা দিয়েছে। কেবল জাসদের ঝুলিটিই ছিল শূন্য। অদৃষ্টের কী পরিহাস! তাঁদের কপালেই জুটল দেশদ্রোহীর তকমা। আর তাহের ঝুললেন ফাঁসির দড়িতে।

৭ নভেম্বরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটেছে নতুন এক শক্তির—সেনাবাহিনী। একে আর উপেক্ষা করা যায় না। ৭ নভেম্বর এ দেশের রাজনীতির খোলনলচে পাল্টে গিয়েছিল। শুরু হয়েছিল দীর্ঘমেয়াদি সেনাশাসন।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক

[email protected]