রাজনীতিকদের জন্য দিল্লির শিক্ষা
মঙ্গলবার বিকেলে হ্যাটট্রিক নিশ্চিত করে অরবিন্দ কেজরিওয়াল জনতাকে ধন্যবাদ দিতে চটজলদি তৈরি মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে প্রথমেই যে স্লোগান তুললেন, তা এত দিন বিজেপি মনে করত তাদেরই পেটেন্ট নেওয়া। ‘ভারতমাতা কী জয়’। এরপর বললেন কমিউনিস্টদের ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ এবং শেষে কংগ্রেসের প্রায় নিজস্ব করে নেওয়া ‘বন্দে মাতরম’। জনতা নির্দ্বিধায় তাঁর সঙ্গে গলা মেলাল।
এতদ্দ্বারা কী বোঝাতে চাইলেন তিনি? এ কথাই কি, তিনি বিজেপি-কমিউনিস্ট ও কংগ্রেসেরই সমার্থক? সবাইকে নিয়েই তিনি এবং তাঁর দল? কিন্তু কেন এইভাবে পরিচিত হওয়া?
সম্ভবত এই কারণে যে এবারের মতো এত তিক্ত, এত কদর্য, এত বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে আগে দেখা যায়নি। বিজেপি প্রচারকে যেভাবে ধর্মীয় মেরুকরণের নামাবলিতে মুড়ে দিতে চেয়েছিল, কেজরিওয়ালের এই স্লোগানগুলো ছিল সম্ভবত তারই উত্তর।
তা-ই যদি না হবে, কেন তিনি তাহলে ওই মঞ্চ থেকে ‘ভগবান হনুমানজিকে’ স্মরণ করবেন? কেন হ্যাটট্রিক নিশ্চিত করে সন্ধ্যায় কনট প্লেসের প্রাচীন হনুমানজির মন্দিরে যাবেন প্রণাম করতে? শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে? ওই মন্দিরে মাথা ঠেকিয়েই তিনি নির্বাচনী মনোনয়নপত্র দাখিল করতে গিয়েছিলেন। আসলে তা করেছিলেন নিজে কতটা ধার্মিক, তা বোঝাতে নয়; করেছিলেন হিন্দুত্ববাদী বিজেপিকে বোঝাতে, তিনিও প্রকৃত হিন্দু। আরও বোঝাতে চেয়েছিলেন, প্রকৃত হিন্দু কখনো হিন্দুস্তানের শত্রু হতে পারে না।
এভাবে নরম হিন্দুত্বের নামাবলি তাঁকে জড়াতে বাধ্য করেছিল কিন্তু বিজেপিই। দলে বাড়তি যোশ আমদানি করতে অমিত শাহ প্রচারের ন্যারেটিভ বদলে দেওয়ার পর কেজরিওয়াল হয়ে গিয়েছিলেন হিন্দুস্তানবিরোধীদের ‘মদদদার’। টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের প্রশ্রয়দাতা। প্রকারান্তরে পাকিস্তানের ‘দালাল’। শাহিনবাগের বিরুদ্ধে কেন তিনি রা কাড়ছেন না, অবরোধ সরাতে কেন পুলিশকে বলছেন না, এমন ধরনের কথা তাঁকে শুনতে হয়েছিল। শুনতে হয়েছিল, তিনি ‘টেররিস্ট’। কেন টেররিস্ট, তার ব্যাখ্যা শুনিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেছিলেন, সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের অনেক প্রমাণ নাকি তাঁদের কাছে রয়েছে। কেজরিওয়াল সব শুনেছেন। কিন্তু সেই অর্থে জবাব দেননি। বরং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে জনতার কাছে পাল্টা জানতে চেয়েছেন, ‘আপনারাই বলুন, আমি সন্ত্রাসবাদী কি না। যদি মনে হয় তা-ই, তাহলে আমাকে ভোট দিতে হবে না।’ রাফাল নিয়ে কংগ্রেস যখন ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগানে দেশ কাঁপাচ্ছিল, লোকসভার ভোটের সময় মোদি তখন ঠিক এইভাবেই জানতে চাইতেন, ‘আপনারাই বলুন, আপনাদের চৌকিদার চোর কি না?’ জনতা চেঁচিয়ে ‘না’ বলত। মোদি বারবার তিনবার জানতে চাইতেন। কেজরিওয়ালের কথা শুনেও জনতা বলেছে, ‘না। আপনি সন্ত্রাসবাদী নন। আপনি দেশভক্ত।’
কেজরিওয়াল শেখালেন, ভেবেচিন্তে ভোটের যে ন্যারেটিভ তৈরি হয়, সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়া ভুল। বিজেপির ন্যারেটিভে তাই তিনি পা দেননি। আবার সেই মোদির কাছ থেকে ধার করে তিনি প্রচারে জনতার কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘কাকে ভোট দেবেন? নামকে (মোদি), নাকি কাজকে?’
উন্নয়নের এই ন্যারেটিভ তিনি ঠিক করেছিলেন ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে কথা বলে। সেই প্রশান্ত কিশোর, যাঁর সংস্থা অর্থের বিনিময়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের ভোটের স্ট্র্যাটেজি তৈরিতে সাহায্য করেছেন ও করছেন। বিজেপি গোটা প্রচারকে হিন্দুস্তান-পাকিস্তানে টেনে আনলেও সেই ফাঁদে পা না দিয়ে কেজরিওয়াল উন্নয়ন ও নাগরিক পরিষেবার গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকেছেন। পায়ে পা লাগিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে, উপরাজ্যপালের সঙ্গে সংঘাত করেছেন প্রথম তিন সাড়ে তিন বছর। আচমকাই সংঘাতের রাজনীতি থেকে সরে এসে সীমিত সামর্থ্যে যতটুকু দেওয়া যায়, গরিবদের জন্য মধ্যবিত্তের জন্য সেটুকুই দিতে চেয়েছেন। মাসে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ, ২০ হাজার লিটার পর্যন্ত পানি ফ্রি করে দিয়েছেন। নারীদের সরকারি বাসভ্রমণ ফ্রি করে দিয়েছেন। মেট্রোরেলেও তেমনই করতে চেয়েছিলেন। মেট্রো কর্তৃপক্ষের বাধায় পারেননি। সরকারি বাসে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মার্শাল নিযুক্ত করেছেন। রাস্তায় রাস্তায় সিসিটিভি বসিয়েছেন। এসবের পাশাপাশি নজর দিয়েছেন সরকারি হাসপাতাল ও সরকারি স্কুলগুলোর দিকে। রাজ্য সরকারি হাসপাতালে নিযুক্তি দিয়েছেন ডাক্তারদের। বাড়িয়েছেন বেডের সংখ্যা। চিকিৎসা পরিষেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন মহল্লায় মহল্লায় ক্লিনিক খুলে। স্কুলগুলোর হাল ভালো করার পাশাপাশি শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। ঘরে বসে মানুষ যাতে বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা পেতে পারে, তার ব্যবস্থা করে দালালরাজ প্রায় তুলেই দিয়েছেন। নিজে দিল্লিবাসী বলে বলতে পারি, এমনটা আগে কখনো দেখিনি।
প্রতিশ্রুতি হয়তো আরও অনেক কিছুই ছিল। সব পূরণ করতে পারেননি। কিন্তু দিল্লির মানুষ দেখেছে, কেজরিওয়াল সরকারের অন্তত সদিচ্ছা আছে। সত্যিই কিছু করতে চায়। সাধারণ মানুষকে সুরাহা দিতে চায়। মানুষ তাই তাদের বিমুখ করেনি। রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে ২১ বছরের অজানা-অচেনা বিজেপির ওপর ভরসা না রেখে ঘরের মানুষ চেনা কেজরিওয়ালকেই তাঁরা কাছে টেনে নিয়েছেন।
তা ছাড়া মানুষ বুঝেছে, আর যা-ই হোক, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হতে আসবেন না। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও কেজরিওয়াল নিজেকে বদলাননি। টানা পাঁচ বছর পরও শীতকালে তাঁর সোয়েটার ও মাফলার অপরিবর্তিত। গরমকালে বুশ শার্ট ও পায়ে চটি, শীতে ফুলহাতা সোয়েটারের সঙ্গে জুতা। একবারের জন্যও ‘স্যুটেড-বুটেড’ মুখ্যমন্ত্রীকে দিল্লিবাসী দেখেনি। দুর্নীতির অভিযোগ ভুলেও কেউ তোলেনি। আগাপাছতলা পারিবারিক মুখ্যমন্ত্রীকেই মানুষ দেখে আসছে। মঙ্গলবার বিকেলে ধন্যবাদ জানাতে জনতার মধ্যে হাজির হয়েছিলেন স্ত্রী, কন্যা ও পুত্রকে নিয়ে। জনতাকে জানাতে দ্বিধা করেননি, ১১ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার তাঁর স্ত্রীর জন্মদিন। বলেছেন, মঙ্গলবার ‘ভগবান হনুমানজিরও দিন’। তিনিও তাঁকে আশীর্বাদ করেছেন। আর বলেছেন, জন্মদিন উপলক্ষে কাটার জন্য কেক তিনি আনেননি।
এই সহজ সরল আটপৌরে পারিবারিক রাজনীতিই কেজরিওয়ালের হাতিয়ার। দলের নাম তাঁরই দেওয়া। আম আদমি পার্টি। নিজের যাপিত জীবনকেও তিনি সাধারণের পর্যায়েই রেখে দিয়েছেন। এটাও তো একরকম শিক্ষাই।
লেখক প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি