লাগাতার অবরোধ ও হরতালের মতো কর্মসূচির কারণে দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলো যখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে, যখন অভিভাবক থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী এমনকি শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং নিশ্চিত করতে পারেন না যে পরের পরীক্ষাটি কবে হবে, ঠিক সেই সময়েই আমাদের উপস্থিত হতে হয়েছিল জাপানের হোক্কাইডোতে অবস্থিত কেইসে মাধ্যমিক স্কুলের একটি আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক বনভূমি সংরক্ষণ ফোরামে। আমার মতো আরও অনেকেই ওই ফোরামে গিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীদের গবেষণা বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য এবং তাদের কমিউনিকেশন দক্ষতা বাড়ানোর জন্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে না করতেই কানে ভেসে এল বাদ্যযন্ত্রের সুরেলা আওয়াজ। কাছে গিয়ে দেখলাম, কতিপয় খুদে ছাত্রছাত্রী নিমগ্নচিত্তে বাজিয়ে চলেছে তাদের মিউজিক ক্লাসে। আর এই ক্লাসটি জাপানের প্রায় সব স্কুলেই নেওয়া হয়ে থাকে শুধু সাংস্কৃতিক চর্চাকে ছোটবেলা থেকেই সুসংগঠিত আর লালন করার জন্য। আমরা যে উপলক্ষে স্কুলটিতে গিয়েছিলাম, তার মূল লক্ষ্য ছিল সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের আসন্ন ফোরামের প্রস্তুতি পর্ব।
ভাবতে অবাক লাগল, আমাদের দেশের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যখন লাগাতার হরতাল কিংবা সহিংসতা বন্ধের আশা করছে, পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে চরম অনিশ্চয়তায়, ঠিক তখন জাপানের এই ছাত্রছাত্রীরা প্রস্তুত হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ে গবেষণার লক্ষ্যে, এমনকি এই গবেষণাকে সফল করতে স্কুল কর্তৃপক্ষ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ছাত্রছাত্রীদের গ্রেট ব্রিটেন থেকে শুরু করে অনেক দেশে দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময় ধরে ঘুরিয়েছে শুধু পর্যবেক্ষণ করার জন্য—সেখানকার বনভূমি, পশুপাখি—আর সবুজ রক্ষার নীতিমালার স্বরূপ বোঝার জন্য।
এখনই তারা বুঝে যাচ্ছে গবেষণার প্রাথমিক ধারণা এবং প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে। কষ্ট হচ্ছিল আমাদের দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এমনকি এ কথা বলতেও দ্বিধা নেই, বর্তমান বাংলাদেশে গবেষণা বলতে আসলে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝায়, এ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অনেক উঁচু শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেও নেই। এ ক্ষেত্রে খুদে শিক্ষার্থীদের কথা না হয় বাদই দিলাম, যার মূল কারণ শিক্ষার পরিবেশ-পলিসি। যদিও গণিত কিংবা বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আপাতদৃষ্টিতে এই অভাব অনেকখানি পূরণ করছে স্ব-উদ্যোগে, কিন্তু সরকার থেকে কি খুদে শিক্ষার্থীদের জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ গুরুত্বসহকারে নেওয়া হয়েছে দেশের সব স্কুল-কলেজের জন্য প্রকৃতপক্ষে যেখান থেকে একজন শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎ শিক্ষার জন্য দিকনির্দেশনা পাবে।
ওই ফোরামে যে বিষয়গুলো নিয়ে খুদে শিক্ষার্থীরা আলোকপাত করেছে, তা রীতিমতো প্রশংসার যোগ্য। তারা দেখিয়েছে কীভাবে জাপানের বর্তমান সবুজ বনভূমিকে আরও প্রাকৃতিক করা যায়, কিংবা অন্য দেশ থেকে কীভাবে কাঠ আমদানি কমিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল করা যায়, কিংবা সবুজ সহাবস্থান গড়ে তোলা যায়। যে বিষয়টি আমাদের সব থেকে বেশি দৃষ্টি কেড়েছে, সেটি হলো মূল পর্বের আলোচনা পর্ব। যেখানে একদিকে বসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অন্যদিকে পরিবেশবিজ্ঞানী, আর তাঁদেরই মাঝখানে সগৌরবে কয়েকজন খুদে শিক্ষার্থী। সবাই শুধু তাদেরই কথা শুনছে, বড়রা কম কথা বলে তাদের কথা শুনতে বেশি আগ্রহী।
অথচ আমাদের দেশে এর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছোটদের অনুষ্ঠানে সেটা হোক শিক্ষামূলক কিংবা সাংস্কৃতিক; প্রধান আর বিশেষ অতিথিদের নিয়ে যে পরিমাণ ব্যতিব্যস্ততা পরিলক্ষিত হয়, সেখানে বড়দের দীর্ঘায়িত বক্তব্যের কারণে ছোটদের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তা ঠিক যেন আমরা অনুভবই করতে পারি না। অথচ সেই আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রধান শিক্ষক, শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি, বন বিভাগের সভাপতিসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যেন আজ শুধু এসেছেন শুনতেই, বলতে নয়।
এবার আসা যাক শিক্ষকদের দিকে। এখানকার একজন শিক্ষককে দেখলে বোঝার উপায় নেই তিনি যে একটি স্কুলের শিক্ষক; কারণ জাপানের সর্বস্তরের শিক্ষকদের বেতনকাঠামো থেকে শুরু করে সমাজের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা তারা পেয়ে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, সমাজে একজন শিক্ষকের মূল্য এখানে অনেক বেশি; যার দরুন একজন শিক্ষক এখানে সর্বদাই সচেষ্ট থাকেন শিক্ষার্থীদের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান প্রদানে। কারণ, শিক্ষার্থীদের শুধু বইলব্ধ জ্ঞান ধারণ করলে কিছুই হবে না। তাকে সব রহস্যের ভেতরে গিয়ে জ্ঞান আহরণ করতে হবে, আর তা সাধারণত পেয়ে থাকে একজন শিক্ষকের মাধ্যমে।
এমনকি প্রত্যেক শিক্ষার্থী যেন সুন্দর পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, সে জন্য জাপান সরকার কতজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেমন হবে, সেটিরও রূপরেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেমন, একটি স্কুলে ছাত্রছাত্রী যদি ৭২০ জনের মতো হয়ে থাকে, তাহলে স্কুলের শিক্ষা প্রদানের জন্য কমপক্ষে ৭ হাজার ২০০ বর্গমিটার জায়গা থাকতে হবে। এভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে কী হবে, সেটিও নির্ধারণ করা আছে। তা ছাড়া, এখানে প্রাথমিক স্তর থেকেই নৈতিক শিক্ষা, প্রকৃতিগত শিক্ষা, সমাজ গঠনমূলক প্রায়োগিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার কারণে একজন শিক্ষার্থী ছোটবেলা থেকেই হয়ে ওঠে সামাজিক এবং সাংগঠনিক।
অথচ আমাদের দেশে রয়েছে তাদের থেকে সংখ্যায় শত গুণ বেশি ছাত্রছাত্রী। এত মেধাবী শিক্ষার্থী আমাদের দেশে থাকা সত্ত্বেও আমরা তাদের মুখে লেপে দিচ্ছি অন্ধকারের আবহ, ঠেলে দিচ্ছি অন্ধ কূপের মধ্যে দিনের পর দিন; এমনকি মৌলিক অধিকার শিক্ষাকেই পিষে মেরে ফেলছি কলুষিত রাজনৈতিক হানাহানিতে। শুধু তা-ই নয়, প্রাথমিক-মাধ্যমিকসহ সর্বস্তরের শিক্ষকদের এখানে জীবনযাপন করতে হয় দারিদ্র্যকে সঙ্গে নিয়ে। আর এই সত্যটাকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাও আমাদের সমাজ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে। অনিয়মই যেন এখানে সব নিয়ম। আর শুধু রাজনীতিই যেন সব—বাকি সব মিছে।
সজল চৌধুরী: বর্তমানে জাপানের হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিউম্যান এনভায়রনমেন্টাল সিস্টেম’-এর ওপর গবেষণারত। সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
[email protected]