রাজনীতি যখন বিরাজনীতিকরণের খপ্পরে


বিএনপি-জামায়াতের বাইরে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক বিকল্প তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সরকারের কোনো বিকল্প নেই—অলিখিত কিন্তু বহুল চর্চিত একটি বয়ান। মূল এ বয়ানকে শক্তিশালী করতে আবার দেওয়া হয় ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুন’তত্ত্ব। এ তত্ত্বের আওতায় নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা পরিবর্তনের ধারাকে পুরোপুরি বন্ধ রাখার নতুন নতুন বয়ানও হাজির করা হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, তারুণ্যকে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ায় নিতে পারলেই কেল্লা ফতে! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ব্যাপক কর্মসংস্থান, জীবনমানের অর্থবহ উন্নয়ন, নাগরিক জীবনে স্বস্তি, স্বাস্থ্যে সুরক্ষা, শিক্ষা, আবাসন, পরিবহন খাতে বোধগম্য উন্নতি, নাগরিক নিরাপত্তা, প্রাণ ও পরিবেশের টেকসই উন্নয়ন করা না গেলে চাপিয়ে দেওয়া কোনো রাজনৈতিক বয়ানই বেশি দিন টিকিয়ে রাখা যায় না। আমাদের তরুণেরা দীর্ঘ বেকারত্বের জ্বলন্ত উনুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে। তাই চাওয়া–পাওয়ার হিসাব চাইতে শুরু করেছে তারুণ্য। বৈশ্বিক ও স্থানীয় প্রেক্ষাপটও তৈরি হয়ে গেছে। চারদিকে তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার তাগাদা।

একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সব সময় বিকল্প থাকে না, বিকল্প তৈরি করে নিতে হয়। এ বিকল্প তৈরি করাটাও বুদ্ধিজীবীদের একটা দায়িত্ব। বিশ্বের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইতিহাসগুলো সব সময় ‘আগে থেকেই বর্তমান’ বিকল্পকেন্দ্রিক ছিল না। বরং জনস্বার্থকেন্দ্রিক দাবিদাওয়া, চাওয়া–পাওয়ার পরিপক্বতা, রাষ্ট্রসংস্কার কাঠামোর নতুন লক্ষ্য, রাজনীতি মানুষকে কী দেবে, নেতারা মানুষের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করবেন—এসব বোঝাপড়া মিলেই তৈরি হয় একেকটা রাজনৈতিক বিকল্প।

জবাবদিহিহীন কর্তৃত্বপরায়ণ রাজনীতির বিরুদ্ধে নাগরিক জাগরণ শুরু হলে তার আচরণ ও চরিত্র, নতুন রাষ্ট্রনৈতিক লক্ষ্য ও গন্তব্যগুলোর নাগরিক গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে আর অতীত ব্যর্থতার আলোকে তৈরি হবে নতুন নেতা। এ পথ বন্ধের ফল হয় অশুভ। ত্বরান্বিত হয় অগণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ, ক্ষমতাবলয়ের অভিজাতের বিপরীতে উদ্ভব হয় পাল্টা সুবিধাবাদী এলিট কিংবা তৃতীয় শক্তি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসও এ চক্রের বাইরে নয়। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রবর্তনের সংগ্রামের মধ্যেই বের করে আনতে হবে বিকল্প। অন্যথায় রেজিম পরিবর্তন হলেও নতুন গজিয়ে ওঠা অভিজাত ও দুর্বৃত্তদের স্বার্থচিন্তার কাছে আবারও হারিয়ে যাবে মানবিক রাষ্ট্র গড়ার আকাঙ্ক্ষা।

সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে যে দুটো হলে সুস্থ নির্বাচন হয়েছে বলা হয়, সেখানে নতুন ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পেছনে পড়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল তৃতীয় কিংবা চতুর্থ হয়েছিল। অর্থাৎ বিকল্প তৈরির প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সহজাতভাবেই আছে।

কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতাসীন দল তার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিকল্প না থাকার বয়ান তুলবে, তবে বুদ্ধিজীবীরাও যদি হুবহু একই বয়ান প্রতিষ্ঠার হাওয়া তোলেন, তাহলে বুঝতে হবে তাঁরা সুবিধাভোগী ও কতৃত্ববাদের সহায়ক। স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নাগরিক তাঁর পছন্দ অনুযায়ী যাকে ইচ্ছা তাকে বিকল্প হিসেবে বেছে নেবেন, এটাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার বিকশকালে দুই চোরের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ‘ছোট’টিকে নির্বাচিত করার লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দীর্ঘ পথ হাঁটতে দিলে ধীরে ধীরে জবাবদিহির সংস্কৃতি বিকশিত হয়ে যোগ্য নেতা গড়ে ওঠার পথ তৈরি হয়।

সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে যে দুটো হলে সুস্থ নির্বাচন হয়েছে বলা হয়, সেখানে নতুন ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পেছনে পড়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল তৃতীয় কিংবা চতুর্থ হয়েছিল। অর্থাৎ বিকল্প তৈরির প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সহজাতভাবেই আছে। বিকল্পের বয়ান আসলে শুধু বিএনপি-জামায়াতকে দমিয়ে রাখা নয়, বরং নতুনকেও আটকে দেওয়ার চেষ্টা, বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোর সুফল হাতছাড়া না করার অভিজাত বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল। এ জন্যই অভিজাতদের গুম, খুন, পাচার, খেলাপি ঋণ, অতিখরচ, অপখরচ, চাঞ্চল্যকর দুর্নীতি, নির্বাচনী অনাচার, ডিজিটাল নিপীড়নমূলক কালো আইনের প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না!

যখন একটি দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকে না, তখন চিন্তাশীলদের মূল কাজ বিরোধী দল তৈরিতে সর্বোচ্চ সহায়তা করা। অন্যথায় ক্ষমতাসীন দলটি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে দেশের সব প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও অর্জনকে খেয়ে ফেলে। অভিজাতদের জন্য রাজনৈতিক ‘বয়ান’ তৈরি করে বিরোধী রাজনীতিকে ডি-লেজিটিমাইট করার ফল কোনো দেশেই ভালো হয়নি। বাংলাদেশে অভিজাতদের চাপিয়ে দেওয়া বয়ানের মাধ্যমেই শেখ হাসিনা সরকার ক্রমেই সর্বেসর্বা কর্তৃত্বপরায়ণ (অথরেটারিয়ান থেকে টোটালিটারিয়ান) হয়ে উঠছে।

কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন!
বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রবলভাবে একটি রাজনৈতিক ঘটনা। উন্নয়ন এখানে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের বোঝাপড়া কিংবা দায়বদ্ধতার ফল নয় বরং ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীর বৈধ-অবৈধ উপার্জন, প্রভাব ও ক্ষমতা তৈরি, অভিজাত হওয়ার পথ। উন্নয়ন এখানে ক্ষমতা-প্রতিপত্তি প্রদর্শনের এক দীর্ঘ জঞ্জালপূর্ণ দুর্নীতি প্রক্রিয়ার ফল। বাংলাদেশের উন্নয়নে উন্নত শিক্ষা, উন্নত স্বাস্থ্য, নিরাপদ আবাসন, সামাজিক উত্তরণ, বার্ধক্য সুরক্ষা, উন্নত কাজের পরিবেশ কিংবা টেকসই পরিবেশকেন্দ্রিক বিষয় আলোচ্য নয়।

উচ্চ প্রবৃদ্ধি বর্তমান ‘ডিজিটাল’ সরকারের প্রধানতম বয়ান। এ বয়ানের ওপর দাঁড়িয়ে দেশের টাকায় পদ্মা সেতুসহ বেশ কিছু অতিদরকারি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রশংসিত উদ্যোগ চলছে। তবে বাস্তবায়নে ধীরতা, অপখরচ, অতিখরচ, মানহীন কাজের কারণে উপর্যুপরি ব্যয় ও দুর্নীতির জন্য নাগরিকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। ক্ষোভের অন্য কারণ আমাদের প্রবৃদ্ধি আসলে কর্মহীন ও বৈষম্যমূলক।

বিআইডিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জনসংখ্যার ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ স্থায়ী কর্মসংস্থানহীন। বিশ্বব্যাংক গত অর্থবছরে ২% এবং চলতি অর্থবছরে মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করেছে। কোটিপতি ধনী বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে অথচ সানেম গবেষণায় দেখা যাচ্ছে মহামারিতে দারিদ্র্য দ্বিগুণ হয়ে ৪২ শতাংশে পৌছেছে। বিআইডিএস গবেষণা দেখিয়েছে, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ দারিদ্র্যবিরোধী লড়াইয়ের প্রায় ১৫টি বছর হারিয়ে গেছে।

২০২০ সালের জুলাইয়ে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ ছিল সারা বছরের রাজস্ব আয়ের ৮৭ শতাংশ! মাত্র এক বছরেই সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছিল ৫১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ধরন যা–ই হোক না কেন, অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়ানোর সুযোগ তেমন ছিল না। সরকার তবু নতুন ঋণ করছে।

এদিকে রিজার্ভ বেড়ে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব মাত্র আড়াই লাখ কোটি টাকা হওয়ায়, সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বাজেটের বাকি টাকার খোঁজে দিশেহারা হয়ে আছে সরকার। ২০২০ সালের জুলাইয়ে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ ছিল সারা বছরের রাজস্ব আয়ের ৮৭ শতাংশ! মাত্র এক বছরেই সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছিল ৫১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ধরন যা–ই হোক না কেন, অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়ানোর সুযোগ তেমন ছিল না। সরকার তবু নতুন ঋণ করছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, ছয় মাসের মধ্যেই ২০ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ঋণ করে ফেলেছে তারা। ফলে ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিক শেষে সরকারের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ জাতীয় বাজেটের প্রায় ৯৫ শতাংশ ছড়াবে, বছর শেষে তা শতভাগ অতিক্রম করবে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার মোট ৬১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল, আগের অর্থবছরে নিয়েছিল ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। টাকার খোঁজে হন্যে হয়ে সরকার সবাইকে হতভম্ব করে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে।

আইএমএফ কান্ট্রি রিপোর্ট-১২/২৯৯ অনুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ঋণ জিডিপি অনুপাত ছিল ৩২ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু নতুন আইএমএফ রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৯-এর শেষে ঋণ জিডিপি অনুপাত দেশের ইতিহাসের রেকর্ড ৩৬–এ উঠে গিয়েছিল। করোনাকালীন সংকটে অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ঋণ জিডিপি অনুপাত রেকর্ড ৪১ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে (আইএমএফ, ১২ জুন ২০২০)। তবে অর্থনীতি সমিতি সে সময়ে বলেছে, বাংলাদেশের মোট ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৫৩ শতাংশের সমান হয়ে গেছে! এরপরও সরকার শুধু এই অর্থবছরে ‘এডিবি’ থেকেই ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ নিতে যাচ্ছে!

বাজেটে মোট বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের লক্ষ্য প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। ঘোষিত বাজেটের ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ ঘাটতি ছিল। রাজস্ব আয়ের ঘাটতি মিলে বাস্তবে এ ঘাটতি ৫০ শতাংশ ছড়াবে। ফলে আক্ষরিক অর্থেই সংকটে পড়ে গেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি। ফলে খারিজ হয়ে যাচ্ছে ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের’ বয়ান। এ যেন উন্নয়ন নয় বরং ঋণ! এদিকে ত্রাণ, প্রণোদনা ও ঋণব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতির মুখে সরকারের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনাও আস্থার সংকটে পড়ে গেছে। উপরন্তু ২০২১ সালের ষষ্ঠ আদমশুমারির পরিসংখ্যানে প্রকৃত জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি না হয়ে সাড়ে ১৭ বা ১৮ কোটি হলে, মাথাপিছু আয়সহ যাবতীয় অর্থনৈতিক সূচক পাল্টে যাবে। এতে করে জিডিপির বিপরীতে মাথাপিছু আয় বাড়ার বয়ানও খারিজ হয়ে যাচ্ছে!

ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তারের পরে অভিজাত রাজনৈতিক বয়ানসর্বস্ব রাজনীতিতে গিয়ে সরকার শুধু বিরোধী দমনই করেনি, শুধু তরুণদেরই ক্ষুব্ধ করেনি বরং খোদ আওয়ামী লীগই পড়ে গেছে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ায়। নেতারা উপলব্ধি করছেন যে আজকে ‘আমলারা মাঠে খেলছেন, রাজনৈতিক নেতারা দর্শকের আসনে খেলা দেখছেন মাত্র!’ গণতন্ত্র নির্বাসনের সাক্ষাৎ প্রতিফলন এ আমলাতন্ত্র নির্ভরতা। জবাবদিহি ও যোগ্যতাহীনতার কালে আমলাতন্ত্রই সরকারের প্রধান ভরসা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর সাম্প্রতিক সহিংসতা তাই পাল্টা ভয়ের বহিঃপ্রকাশ।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ বইয়ের লেখক। faiz. [email protected]