বাংলাদেশে হঠাৎ হঠাৎ একসঙ্গে অনেক মানুষ খেপে গিয়ে শোরগোল শুরু করে। ফলে যে সরকার সাধারণত জনগণের বিক্ষোভ–প্রতিবাদ ও দাবিদাওয়ার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না, সেই সরকারও একটু নড়েচড়ে উঠতে বাধ্য হয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের প্রবল আন্দোলনের সময় এ রকম দেখা গেছে। বিক্ষোভ–প্রতিবাদের মুখে সরকার সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন করে কঠোরতর শাস্তির বিধান করেছিল। (অবশ্য পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের বিরোধিতার কারণে সংশোধিত আইনটি কার্যকর করতে পারেনি। যাক, সে অন্য প্রসঙ্গ। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে)।
বছর দুয়েক পর জনগণের বিক্ষোভ–প্রতিবাদের কারণে সরকারকে আবারও নড়েচড়ে উঠতে দেখা গেল। বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন এই বলে যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ১২ অক্টোবর আইন সংশোধনের প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করা হবে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, আইনমন্ত্রী বলেছেন, সরকার উদ্যোগটি নিয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। ফলে বোঝা যাচ্ছে, দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ–প্রতিবাদ সরকারকে সত্যিই নাড়া দিয়েছে।
নতুন আইন প্রণয়ন কিংবা বিদ্যমান আইন সংশোধন করার পেছনের কারণ যদি হয় জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষা ও দাবির প্রতি সরকারের আন্তরিক সায়; তাহলে সেটাকে সরকারের গণমুখী আচরণ বলে স্বীকার করতে হয় এবং সে জন্য সরকার ধন্যবাদ পেতে পারে। কিন্তু বিক্ষোভ–প্রতিবাদের চাপের মুখে জনসাধারণকে তাৎক্ষণিকভাবে শান্ত করার কৌশল হিসেবে যদি সে রকম কিছু করা হয়, তাহলে সেটাকে সরকারের পপুলিস্ট বা লোকরঞ্জনবাদী আচরণ হিসেবে চিনে নিতে কষ্ট হয় না। চলমান ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ আন্দোলনের মুখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার সরকারি উদ্যোগকে দ্বিতীয় ধরনের আচরণ বলে অনেকেরই মনে হতে পারে।
কিন্তু তা যদি না–ও হয়, অর্থাৎ সরকার যদি আন্তরিকভাবেই উপলব্ধি করে থাকে যে ধর্ষণের বাড়বাড়ন্ত কমানোর উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরি হয়ে উঠেছে এবং সে জন্য ধর্ষণের শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডে উন্নীত করাই সঠিক ও দরকারি পন্থা, তাহলে আমরা বলব এ রকম চিন্তাধারা ঠিক নয় এবং এই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না।
আমরা এ কথা বলছি প্রথমত, বাংলাদেশে আইন প্রয়োগ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হতাশাব্যঞ্জক অভিজ্ঞতা থেকে। দ্বিতীয়ত, এই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকে যে যথাযথ প্রয়োগের নিশ্চয়তা নেই এমন আইন যত কঠোরই হোক না কেন, তা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। আমরা যদি প্রায় দুই দশকে বাংলাদেশে ধর্ষণ ও নারী–শিশুর প্রতি অন্যান্য অপরাধের মামলাগুলোর খতিয়ানের দিকে তাকাই, তাহলে যারপরনাই হতাশ হতে হয়। সরকারের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার যে তথ্য–উপাত্ত রেকর্ড করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ২০০১ থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত নারী–শিশু নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলোর মাত্র ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশের ক্ষেত্রে আদালতের রায় ঘোষিত হয়েছে। আর এসব মামলার মধ্যে দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশের ক্ষেত্রে।
অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রায় দুই দশক ধরে যত ধর্ষণ ঘটেছে, নারী–শিশুর ওপর যত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের ৯৯ দশমিক ২৩ শতাংশই কোনো শাস্তি পায়নি। এটাকেই বলে বিচারহীনতা বা ইমপিউনিটির সংস্কৃতি: প্রায় শতভাগ ধর্ষক ও নারী–শিশু নির্যাতক বিচার ও শাস্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে। কিন্তু এই দেশে কি ধর্ষণ ও নারী–শিশুর ওপর অন্যান্য অপরাধের বিচার করার জন্য কোনো আইন নেই?
আছে, আইন যথাস্থানেই আছে। সে আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধানও আছে। এমনকি ধর্ষণের সময় বা তার পরে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ডের বিধানও বলবৎ আছে। কিন্তু এই বিধানেও কি ধর্ষক–খুনিরা শাস্তি পাচ্ছে? পেলে কতজন? কত শতাংশ?
সুতরাং আইন সংশোধন করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হতে পারে না। জনবিক্ষোভের মুখে সাড়ম্বরে আইন সংশোধন করে শাস্তির মাত্রা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে সাময়িক লোকরঞ্জন ঘটানো যেতে পারে, প্রকৃত সমস্যার সমাধান এভাবে সম্ভব হবে না।
শুধু ধর্ষণ নয়, সব ধরনের ফৌজদারি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার উপযোগী আইন বাংলাদেশে আছে। সরকার যদি অপরাধপ্রবণতার রাশ টেনে ধরতে আন্তরিকভাবেই চায়, তাহলে প্রথমেই রাজনীতি ঠিক করতে হবে। রাজনীতি কথাটা বলা হচ্ছে বৃহত্তর অর্থে; সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং জনসাধারণের কল্যাণ সাধনের দায়িত্ববোধ হলো রাজনীতি। রাজনৈতিক ক্ষমতার আশ্রয়–প্রশ্রয়ে অপরাধবৃত্তির যে বাড়বাড়ন্ত বাংলাদেশের সমাজকে পর্যুদস্ত করে চলেছে, তার অবসানের জন্য রাজনীতিটাকেই ঠিক করতে হবে সবকিছুর আগে। রাজনীতি ঠিক হলে আইন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কাজ করবে, অন্যথা নয়।
সাধারণ মানুষ আইন ভঙ্গ করলে পার পায় না, পার পায় ক্ষমতার ছায়ায় লালিতপালিত অপরাধীরা। রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারাই আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে ওঠে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্মদাতা হলো রাজনীতি। সুতরাং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক