রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে দেশে ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে চেষ্টা করেছিলেন। স্কুল থেকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে শান্তিনিকেতন শুধু শিক্ষাতেই নয়, বাঙালি সমাজের সংস্কৃতি ও রুচিতে যে সৌন্দর্যের মাত্রা যোগ করে, আপামর বাঙালি তা সাদরে গ্রহণ করেছিল। সেই শান্তিনিকেতনের মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে বোলপুর শহরে আর এক বাঙালি এখন বাঙালির ভাষায় একেবারেই বিপরীত মাত্রা যোগ করে বিখ্যাত হয়ে পড়েছেন। তিনি অনুব্রত মণ্ডল, বীরভূম জেলা তূণমূল কংগ্রেসের সভাপতি। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় তাঁর বক্তৃতা—‘বিরোধী দলের প্রার্থীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিন, পুলিশ বাধা দিতে এলে তাদের বোমা মারুন’—তাঁকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দেয়। কারণ, তাঁর ওই বক্তৃতার পরপরই এলাকার নির্দলীয় প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাড়িতে তূণমূলের কর্মীরা হামাল চালান, গুলিতে প্রার্থীর বাবা সাগর ঘোষ মারা যান। পুলিশ অবশ্য হিংসায় প্ররোচনা দেওয়ার অপরাধে অনুব্রতর বিরুদ্ধে কোনো মামলাই করেনি, বরং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় দাঁড়িয়ে অনুব্রতকে সার্টিফিকেট দিয়ে বলেছিলেন, ‘ও খুবই ভালো ছেলে, তবে ওর মাথায় অক্সিজেন কম যায়, তাই মাঝেমধ্যে উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলে।’
মমতা যাকে উল্টোপাল্টা কথা বলছেন, অনুব্রতর সেই ‘উল্টোপাল্টা কথা’ই এখন তূণমূল কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের মুখের ভাষা হয়ে রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। আর অনুব্রত এখন তাতে আরও মাত্রা যোগ করে চলেছেন। গত মঙ্গলবার রাতে বোলপুর নিচুপট্টিতে অনুব্রতর দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে প্রথমেই বাধা এল পুলিশের কাছ থেকে। তিনজন পুলিশ প্রথমে পরিচয় জেনে তারপর ভেতরে নিয়ে গেল। বাড়ির একতলায় একাধিক অনুগামী পরিবেষ্টিত হয়ে অনুব্রত মণ্ডল বসে আছেন। নিজেকে তাঁর ডাকনাম কেষ্ট বলেই পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। বিশাল চেহারা, বয়স ৫৬, মাথার চুল একদম কদমছাঁট, পরনে হাতাওয়ালা গেঞ্জি ও ধুতি, মুখে পান চলছে, সঙ্গে পানমসলা। আর অনবরত পাশেই রাখা পিকদানে পিক ফেলছেন। দুই হাতের আট আঙুলে আটটি আংটি। লেখাপড়া মাধ্যমিক ফেল পর্যন্ত। নিজেই জানান, দেবদ্বিজে ভক্তি প্রচুর।
মুখের পিক ফেলে অনুব্রত চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে বললেন, ‘পি সি সরকারের ম্যাজিক দেখেছেন? সব ভ্যানিশ করে দিত। এবারও ভ্যানিশ।’ ১৭ এপ্রিল উত্তরবঙ্গের ছয় জেলার সঙ্গেই বীরভূমের ১১ বিধানসভা কেন্দ্রেও ভোট। এই ভোটের সময় কে বা কারা ভ্যানিশ হয়ে যাবে? অনুব্রত তথা কেষ্টর ব্যাখ্যা, ‘বাম আমলে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সময় ভোটে কী হতো? সারা দিন বোমা, বন্দুক নিয়ে খুনোখুনি। কিন্তু সন্ধ্যায় বাম নেতারা বলতেন, ভ্যানিশ। কোথাও কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু হয়নি। সব ভ্যানিশ। এবারও দেখবেন, সব শান্তি, শান্তি। বীরভূমে কোথাও কোনো গণ্ডগোল হবে না। মানুষ তাঁদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। ম্যাজিক, ম্যাজিক। কিন্তু সিপিএমের আমলে এই বোমা-বন্দুক নিয়ে ম্যাজিক যারা দেখাত, তারাই তো এখন তূণমূলের আশ্রয়ে? আত্মবিশ্বাসে ভরপুর অনুব্রতর অকপট স্বীকারোক্তি, ‘সবাই নয়, তবে অনেকেই আমাদের দিকে এসেছে।’ তবে এর পরেই সতর্ক হয়ে তিনি যোগ করেন, ‘এরা এসেছে আমাদের উন্নয়নের কাজকর্ম দেখে।’ এই ‘উন্নয়নের’ আদর্শে উদ্বুদ্ধ কর্মীদের এখন অনুব্রত পাঠাচ্ছেন সেই সব মহল্লা বা বাড়িতে, যাঁদের ভোট বিরুদ্ধ পক্ষের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা। সঙ্গে অনুব্রতর বার্তা, ভোটের দিন বাড়ি থেকে বেরোনোর দরকার নেই। সেই সঙ্গে তারা বিরোধী ভোটদাতাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ‘গুড়ের বাতাসার রং’ চেনাচ্ছেন। বীরভূমে গুড়ের বাতাসার রং কালচে লাল, শুকিয়ে যাওয়া রক্তের রংও তাই। অনুব্রত কিছু আর বলবেন না, তবে যার বোঝার সে বুঝে যাবে।
এই ম্যাজিকের সুর কেটে যায় বীরভূমে গত পাঁচ বছরে রাজনৈতিক হানাহানির কথা মনে করলে। যার বেশির ভাগই তূণমূল কংগ্রেসের নিজেদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল। তূণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বীরভূমের মাটিতে কত খুন হয়েছে পাঁচ বছরে? অনুব্রত একটু চুপ। পরে বললেন, একজনও নয়। তারপর চাপ দেওয়ায় হিসাব করতে বসলেন, নানুরে তিনজন, রামপুরহাটে একজন, খয়রাসোলে দুজন—এভাবে ১১ জনে গিয়ে থামলেন তিনি। বিরোধী দলের হিসাবে সংখ্যাটা অবশ্যই অনেক বেশি। শান্তিনিকেতনের অদূরেই সাত্তোর গ্রাম। সেখানে দুই বছর ধরে প্রথমে সিপিএমের সঙ্গে, পরে বিজেপির সঙ্গে তূণমূলের খুনোখুনি চলেছে, লাশ পড়েছে একাধিক।
মধ্যযুগের বিশিষ্ট বৈষ্ণব কবি চণ্ডিদাসের জন্ম ও কর্মস্থান এই বীরভূমের নানুর। চণ্ডিদাসের বাণী ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ নানুরে ঢোকার পথে বড় তোরণের গায়ে উৎকীর্ণ। সেই নানুর বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রেমের বদলে রক্তপাতের জন্য বিখ্যাত। নানুরের তূণমূল নেতা কাজল শেখ এবং অনুব্রতর মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কাজল এখন চেষ্টা চালাচ্ছেন নানুরে তূণমূলের প্রার্থীকে হারাতে সিপিএমকে মদদ দিতে। অনুব্রতর কথায়, ‘কাজল একটা চোর, ডাকাত। ও কোনো সুবিধা করতে পারবে না। আর গোটা জেলায় দু বছর আগের বিজেপির বাড়বাড়ন্তের (যার জেরে সাত্তোরে বিজেপির সঙ্গে তূণমূলের খুনোখুনি) কারণ সিপিএম। এখানে বিজেপি বলে কিছু নেই। সবই সিপিএমের লোক। বিজেপিতে গিয়েছিল, এখন আবার সিপিএমে ফিরে এসেছে।’ অনুব্রতর এ কথার সত্যতা আছে। সিপিএমের লোকেরাও স্বীকার করছেন, তখন বিজেপি নিরাপত্তা দেবে আশা করে অনেক গ্রামেই লোকজন বিজেপিতে ভিড়েছিল। এখন ফিরে আসছে।
>সেই সঙ্গে তারা বিরোধী ভোটদাতাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ‘গুড়ের বাতাসার রং’ চেনাচ্ছেন। বীরভূমে গুড়ের বাতাসার রং কালচে লাল, শুকিয়ে যাওয়া রক্তের রংও তাই। অনুব্রত কিছু আর বলবেন না, তবে যার বোঝার সে বুঝে যাবে
বাস্তবিক, সন্ত্রাস ও বাহুবলের যে রাজনীতি এখন পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে যাদের নেতৃত্বে শিকড় গেড়েছে, সেই আরাবুল ইসলাম, ইকবাল আহমেদ, মনিরুল ইসলামরা অনুব্রতর কালচারেরই অনুগামী। বীরভূমেরই লাভপুর (সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মস্থান) এলাকার বিধায়ক তূণমূলের মনিরুল জনসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি নিজেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের তিন সমর্থককে খুন করেছেন। ওই খুনের মামলায় মনিরুলকে একবারের জন্যও পুলিশ ডেকে জেরা করেনি। বিশ্বভারতীর এক অধ্যাপক (অনুব্রতর ভয়ে তিনিও পরিচয় দিতে চাননি) মন্তব্য করেন, বীরভূম যেমন মানবপ্রেমের প্রবক্তা চণ্ডিদাস ও রবীন্দ্রনাথের জায়গা, তেমনই শক্তি ও তন্ত্রসাধনার পীঠস্থানও। তারাপীঠ, কঙ্কালীতলা, নলহাটির ললাটেশ্বরী মন্দির, সবই বহু প্রাচীন তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র। তন্ত্রের সঙ্গেই শবসাধনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অধ্যাপকের মন্তব্য, অনুব্রত সম্ভবত সেই তন্ত্রসাধনারই আধুনিক সংস্করণ।
রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।