রবিউল হুসাইন ভাই, স্যালুট
কবি রবিউল হুসাইন ভাইয়ের সঙ্গে কবে কীভাবে প্রথম দেখা হয়েছিল, মনে পড়ে না। কিন্তু মনে হয় যেন জন্ম-জন্মান্তর থেকে তিনি আমার বড় ভাই। আশির দশকে যখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন শহীদ স্মৃতি হল থেকে গ্রিন রোডে আলাউদ্দিনের মিষ্টির দোকান পেরিয়ে গ্রিন সুপার মার্কেটের পেছনের গলির শেষ মাথায় গেলে শহীদুল্লাহ অ্যাসোসিয়েটসে পৌঁছে যাওয়া যেত। দোতলায় রবিউল হুসাইনের কক্ষ। আর্কিটেক্টের রুম যেমন হয়। দু-চারটা কাগজের তৈরি ভবনের মডেল। অফিসের আরেক কোণে হয়তো ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িংয়ের সেই টেবিল, যাতে স্কেল ইত্যাদি সংযুক্ত। আমার অত কম বয়সে এত বড়, এত খ্যাতিমান মানুষটার কাছে কেন যেতাম? অবশ্যই চাঁদা নিতে, প্রধানত বিজ্ঞাপনের আকারে। কোনো কবিতাপত্র বেরোবে, কিংবা বুয়েটের সমাপনী স্মরণিকা, কিংবা কোনো আত্মীয়ার শিক্ষাসফর ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন লাগবে, তো চলো যাই স্থপতি রবিউল হুসাইনের কাছে। তিনি কারও না কারও কাছ থেকে বিজ্ঞাপন জুটিয়ে দিতেন। কিন্তু রবিউল হুসাইনই কেন? কারণ তিনি বুয়েটের বড় ভাই। কারণ তিনি কবিতা লেখেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণটা ছিল, তিনি মানুষ হিসেবে ভালো, একটু বেশিই ভালো, ‘না’ করতে পারতেন না।
আরেকটা দৃশ্য আমার খুব মনে পড়ে। আমাদের বুয়েটের বড় ভাই মোজাম্মেল বাবু, আমাদের কবি বন্ধু তারিক সুজাত আর বড় ভাই শিল্পী ইউসুফ হাসানের পেছনে পেছনে আমি ধানমন্ডি ৪ নম্বরের মাঠের কাছে একটা দোতলা অফিস ভবনের বারান্দায় হাঁটছি, রবিউল হুসাইনের কাছে যাচ্ছি, শিল্পী কাজী হাসান হাবিবের প্রদর্শনী হবে অথবা তাঁর স্মরণে কিছু একটা করা হবে।
তিন কবি—রবিউল হুসাইন, বেলাল চৌধুরী আর রফিক আজাদ ছিলেন একটা ত্রয়ী। তিনজনই বিদায় নিলেন। আর যদি বলি, চতুষ্কোণ, তাহলে চার নম্বর কোণটা ছিলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। সিরাজী ভাই আছেন, লিখছেন, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক এখন। কবি রবিউল হুসাইন চলে গেলেন ৭৬ বছর বয়সে, আজ ২৬ নভেম্বর ২০১৯ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সকালবেলা তিনি পৃথিবীকে বিদায় জানান। আমি তাঁর ২২ বছরের ছোট। তার মানে যখন কুড়ি বছর বয়সের আমি তাঁর কাছে যেতাম, তিনি ছিলেন ৪২। এত পিচ্চি একটা ছেলেকে তিনি যে পাত্তা দিতেন, তা তাঁর মহানুভবতা।
১৯৮৭ সালে জাতীয় কবিতা উৎসব হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি গমগম করত। আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছি। তারই অংশ হিসেবে হচ্ছে কবিতা উৎসব। অবশ্যই এর খরচ তোলার প্রধান ভার রবিউল হুসাইনের।
রবিউল ভাই ছিলেন মাটির মানুষ। কিন্তু তাঁর পোশাক-আশাকে একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। একটা পশমি কোট, কালো প্যান্ট, পায়ে জুতা, আর কাঁধে ঝোলানো মাফলার তাঁকে অনন্য করে রাখত। পাইপ টানতেন। জুলফি বড়। জুলফিতে সাদার আঁচড়। বড় সুদর্শন মানুষটিকে আরও সুন্দর করত তাঁর অমায়িক ব্যবহার।
তিনি চিত্রকলা নিয়ে লিখতেন। কবিতা লিখতেন। একদিন তাঁর একটা কবিতা পড়ে তাঁকে ফোন করলাম। রবিউল ভাই, আপনার এই কবিতাটা দারুণ হয়েছে। কবিতার বিষয় হলো, এক মধ্যবয়সী নারী, যাঁর ছেলেপুলে বড় হয়ে গেছে, সকালবেলা বেরিয়েছেন রিকশায়, রাস্তার মোড়ে একটা বখাটে ছেলে তাঁকে দেখে চোখ টিপেছে। মহিলার মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে কবিতাটা ভালো লাগল আমার। এই নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ দুই ভাই গল্প করলাম।
স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর তাঁর একটা গল্পের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। নির্ঝর ভাই বলেছিলেন, ‘তুমি জানো, বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ মানুষের নাম রবিউল হুসাইন। তুমি জানো না তাঁর মাথায় কী উদ্ভট উদ্ভট আইডিয়া খেলা করে। তিনি একটা গল্প লিখেছেন, পুরোটা ক্যাসেট প্লেয়ারের রিউইন্ড করার মতো। মানে, শেষ লাইনটা সবার আগে লিখেছেন। ধরা যাক, এমন, সকাল সাতটায় তিনি মারা গেলেন। পোনে সাতটায় তিনি নাশতা করেছেন। সাড়ে ছটায় তিনি দাঁত ব্রাশ করেছেন। ছটায় ঘুম থেকে উঠেছেন। তার আগের ৭টা ঘণ্টা ঘুমিয়ে ছিলেন। রাতে ১১টায় ঘুমুতে যাওয়ার আগে তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছেন। এইভাবে মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে গল্প শেষ হবে। বুঝতে পারছ?’
আমি হা হয়ে গেলাম। সময় তো কেবল একদিকে যেতে পারে না। অন্য দিকেও যেতে পারে। সেটা ব্যবহার করে গল্প লেখা এই বাংলাদেশে কেবল স্থপতি রবিউল হুসাইনের পক্ষেই সম্ভব ছিল।
রবিউল ভাই একদিন আদেশ করলেন, ‘শোনো, অমুক প্রকাশককে একটা পাণ্ডুলিপি দিবা।’ আমি বললাম, জি দেব।
ঢাকা শহরে কয়েকজন বড় ভাই আছেন আমার, যাঁদের কথামাত্রই আমার জন্য হুকুম। আমি সামরিক কায়দায় সেসব হুকুম পালন করি। রবিউল ভাই ছিলেন তেমনি বড় ভাই।
বছর দেড়েক আগে বললেন, ‘শোনো, বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের বৈঠক ছিল, প্রধানমন্ত্রী তো তোমার “আলো-আঁধারের যাত্রী” বইটা নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললেন। তিনি খুব পছন্দ করেছেন বইটা। শোনো, আমার তখন খুব গর্ব হলো।’
আমি বললাম, আপনি কী বললেন?
‘আমি বলেছি, আনিস তো আমাদেরই ছেলে, আমাদের ছোট ভাই।’
আমি খুব খুশি হলাম। বললাম, মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি রবিউল ভাইয়ের লোক।
রবিউল হুসাইন বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সব সময় ছিলেন, সবার আগেই থাকতেন, কিন্তু নেতা হতে চাইতেন না। তিনি পদাবলী নামের কবিতা সংগঠন করেছেন, অবশ্যই জাতীয় কবিতা পরিষদ করতেন, স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি ছিলেন; এবং স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশের নিজস্ব স্থাপত্য রীতি ও ঐতিহ্য নির্মাণের ও বিনির্মাণের একজন অগ্রণী কর্মযোদ্ধা ছিলেন। ছিলেন শিল্পের সমালোচক এবং পৃষ্ঠপোষক। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি। সর্বশেষ বোধ হয় দেখা হয়েছিল গত বছর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শিশু-কিশোর সমাবেশে।
কিন্তু সব ছাপিয়ে মনে হয়, খুব ভালো একটা মানুষ ছিলেন। ভিড়ের মধ্যেই সাধারণত তাঁর সঙ্গে দেখা হতো, হয়তো শহীদ মিনারে, কোনো গুণী মানুষকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজনের ভিড়ে, চোখ পড়লেই ডাকতেন, ‘এদিকে আসো।’ নতুন কিছু করতেন। হয়তো এক আঙুল দিয়ে স্যালুট করতেন, কখনো দুই আঙুল দিয়ে হ্যান্ডশেক করতেন। মেরিনাকেও ডাকতেন, ‘এদিকে আসো, দুই আঙুল দিয়ে হ্যান্ডশেক করো। আজকে থেকে এটা চালু হলো।’
এনামুল করিম নির্ঝর ঠিকই বলেছেন, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে সৃজনশীল আইডিয়ার মানুষ।
নিঃসঙ্গ ছিলেন। একবার বাথরুমে পড়ে গিয়ে সারা রাত সেখানেই ছিলেন, অচেতন। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে বেঁচে ফিরে আসেন। প্রায় নিরামিষ জীবন এরপর তাঁকে যাপন করতে হয়েছে।
কিন্তু মুখের হাসিটি তার শেষ দিন পর্যন্ত অনির্বাণ ছিল। প্রাণের শক্তির যে ভরভরন্ত রূপ ছিল তাঁর জীবনযাপনে, তা মলিন হয়নি।
সাদা জুলফি, মুখে হাসি, কোটে দামি টোব্যাকোর সুগন্ধ, মাথার মধ্যে দেশপ্রেম, আর কিলবিল করা আইডিয়া, কবিতার, শিল্পের, স্থাপত্যের—আমার স্মৃতিতে এ-ই হলেন রবিউল হুসাইন, এই চিত্রকল্পটাই স্মৃতিতে চির অটুট রইবে।
ভাই, রবিউল ভাই, আজ অগ্রহায়ণের এই রোদমাখা সকালে আপনাকে সালাম।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক।