রওনা হলাম, পৌঁছাতে পারব তো!
‘তুই আমারে ঠ্যালা দিলি ক্যান? যা কাইল হরতাল!’—হরতাল নিয়ে এমন তামাশার কথার জন্ম খালি খালি হয় নাই। বছর কয়েক আগেও বাজারে এই জিনিসের খুব চাহিদা ছিল। তখন হরতালের ডাক দেওয়ার জন্য বড় কোনো দল বা সংগঠন হওয়া জরুরি ছিল না। মোটামুটি একটা অর্গানাইজড ফোর্স হলেই চলত। ওই ফোর্সের মুখপাত্র রাম কি শ্যাম, যদু কি মধু, তা দেখার দরকার পড়ত না। কেউ একজন হলেই হলো। সে বললেই হলো, ‘কাল হরতাল’। টাইমলি মহাসমারোহে উৎসবমুখর পরিবেশে হরতাল শুরু হয়ে যেত। লোকজন ছুটির আমেজে বিছানায় গা এলিয়ে পড়ত। ঘর থেকে বের হতো না। অনেকে বাড়িতে একটু ভালোমন্দ পাকশাক করত। রাস্তায় গাড়ি–ঘোড়া বের হতো না। পোলাপান মহাসড়কে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে নেমে পড়ত। যাদের বল–ব্যাট ছিল না, তারা হাডুডু বা কাবাডি খেলত।
দিন বদলেছে। আমরা আগের চেয়ে শিক্ষিত হয়েছি। আমাদের নাগরিক বোধ এবং সচেতনতা বেড়েছে। এই সব কারণে এখন আমরা হরতাল পছন্দ করি না। আমরা আর বলি না, ‘যা কাইল হরতাল!’ আমরা এখন অনেক স্মার্ট। ‘কাল’, ‘পরশু’র মধ্যে আর আমরা নাই। আমরা ‘নগদের লাইনে’ চলে এসেছি। এখন আমরা ‘ধর তক্তা মার প্যারাক’ কায়দায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে রাস্তা আটকে দেওয়া শিখেছি। রাজপথকে আমরা সেই মোগল আমল থেকে ‘বাবার সম্পত্তি’ মনে করে এসেছি। এ কারণে যখন ইচ্ছা তখন রাজপথ আটকে দেওয়াকে আমরা আমাদের ‘পৈতৃক অধিকার’ বলে মনে করি। রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি থমকে থাক। রোগী, বৃদ্ধ, শিশুসহ লাখ লাখ যাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁত কেটকি মেরে পড়ে থাক। অ্যাম্বুলেন্সে দু–চারজন রোগী মরে পড়ে থাক। এগুলোকে আমরা ‘কোলাটেরাল ড্যামেজ’ (আনুষঙ্গিক ক্ষতি) বলে মেনে নিয়েছি। জীবন মানে যুদ্ধ। আর যুদ্ধ মানে আনুষঙ্গিক ক্ষতি। এই ক্ষতি আন্তর্জাতিকভাবে মেনে নেওয়ার চল আছে।
দাপ্তরিক কাজে গতকাল গাজীপুর যেতে গিয়ে এই আনুষঙ্গিক ক্ষতির মুখে পড়তে হলো। সকালে বাসে চেপেছি। বাস বিমানবন্দরের কাছাকাছি যাওয়ার পর আর এগোয় না। আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা গেল। গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে। নেমে গেলাম। আমাকে গাজীপুর যেতেই হবে। ভাবলাম হাঁটতে থাকি। সামনে যদি কোনো বিকল্প কিছু মেলে। এক মাইল হাঁটার পরও মিলল না। হাজার হাজার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জানা গেল, ইজতেমা নিয়ে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের নেতৃত্বের কোন্দলের জের ধরে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়েছে। দুই পক্ষই রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। টঙ্গী থেকে মহাখালী পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ। সেই অবরোধের কারণে রাজধানীর লোকাল বাসের সঙ্গে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসও আটকা পড়ে আছে। পুলিশ উভয় পক্ষকে সরিয়ে দিতে সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। ঘণ্টা দু-এক কোশেশ করার পর বুঝলাম, হবে না। হাঁটতে হাঁটতে স্থির নিশ্চল যানসমুদ্র দেখতে দেখতে ফিরে এলাম।
বিমানবন্দর সড়কে গাড়ি-ঘোড়ার চলাচলতি আটকে দেওয়ার ঘটনা নতুন না। কিছুদিন পরপরই এখানে এই দৃশ্য দেখা যায়। যারা রাস্তা আটকায়, আমরা সাধারণত তাদের ‘আন্দোলনকারী’ বলি। আমাদের কেউ ‘আন্দোলনকারীদের’ পক্ষে থাকি, কেউ বিপক্ষে থাকি। কিন্তু তাদের রাজপথ আটকানোর বিপক্ষে থাকি না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যান চলাচল বন্ধ থাকলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু অল্প কিছু মানুষের স্বার্থগত বিষয় নিয়ে মনুষ্যসৃষ্ট এই দুর্যোগকেও যে মেনে নেওয়া যায়, সেটা এক অভিনব বিষয়।
সভ্য দুনিয়ার কোন দেশে বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এভাবে ‘হয় কথায় নয় কথায়’ মহাসড়ক আটকে লাখ লাখ মানুষকে বিপদে ফেলা হয়, তা জানতে গুগলে সার্চ দিয়েছিলাম। গুগল জবাব দিতে না পেরে মনে হলো খানিক লজ্জা পেয়েছে। আমাদের যেহেতু লজ্জা–শরম সামান্য কম, সেহেতু এ নিয়ে আমাদের টেনশনও কম। গতকাল বেলা একটায় বা দুইটায় যে ভদ্রলোকের ফ্লাইট ছিল, যদি সকালে গাজীপুর থেকে রওনা দিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি কোন কায়দায় বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছিলেন, তা জানতে বড় ইচ্ছে করে। বিমানবন্দরের গুরুত্বের কথা ভাবলে সেখানে যাওয়া–আসার জন্য বিকল্প সড়ক রাখার কথা ভাবা যেতে পারে। সরকার হয়তো সড়কের নকশা সংস্কার করে সেই বিকল্প সড়ক তৈরি করতেও পারে। কিন্তু কথায় কথায় মহাসড়ক অবরোধ করা লোকজনের চিন্তা–চেতনার নকশাবদল করবে কে?
সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহ–সম্পাদক
[email protected]