যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ঢেউ ও আমাদের কীর্তিকারখানা

শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় জাতীয়ভাবে যে শিক্ষাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, এক কথায় তারই নাম শিক্ষাক্রম।

শিক্ষাক্রম উন্নয়নের গোড়ার কথা
অপ্রাতিষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল) শিক্ষার কোনো শিক্ষাক্রম থাকে না; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পূর্ণ আনুষ্ঠানিক (ফরমাল) এবং উপ-আনুষ্ঠানিক (নন-ফরমাল), উভয় রূপেই শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়। পূর্ণ আনুষ্ঠানিক শিক্ষার শিক্ষাক্রম প্রথম দিকে ছিল বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) ভিত্তিক। পরে শিক্ষার উদ্দেশ্যের (অবজেকটিভস) ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করা হয়। আমেরিকান শিক্ষামনোবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম (১৯৫৬) উদ্ভাবিত তিনটি প্রধান ক্ষেত্রের (চিন্তন, ভাবাবেগ ও মনোপেশিজ) সব উদ্দেশ্য অর্জন করাই স্কুলপর্যায়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য শ্রেয়। শিক্ষার সব উদ্দেশ্যকে শিখনফল (লার্নিং আউটকাম) নামক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, সহজে পরিমাপ ও মূল্যায়নযোগ্য এককে ভাগ করে শিক্ষাক্রম তৈরি ও উন্নয়ন করা হচ্ছে প্রায় ৬০ বছর আগে থেকে। বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য এ ধারায় আজও কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, তথা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য কিছুটা সংকীর্ণ। পেশাভিত্তিক যোগ্যতা (কম্পিটেন্সি) অর্জনই এ শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। তাই সারা বিশ্বে শিক্ষকতা, চিকিৎসাশাস্ত্র, নার্সিং, গাড়ি চালনা ইত্যাদি কারিগরি ও পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ চলে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের আওতায়। কর্মে যোগ্য হওয়ার জন্য দক্ষতা পুরোপুরি অর্জন করতে হয় বলে এসব প্রশিক্ষণ কোর্সের শিখন হতে হয় ‘ওস্তাদি শিখন’ (মাস্টারি লার্নিং) পর্যায়ের; সাধারণ শিক্ষার মতো ৩৩ থেকে ৪০ শতাংশ শেখা হলেই পাস করা যায় না। শিখন সম্পূর্ণ করতে যতবার অনুশীলন করা দরকার, পেশায় পটুত্ব অর্জনের জন্য ততবারই তা করতে হয়।

১৯৯০-এর দশকে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা এবং বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণে ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) স্কুলসহ শিক্ষার সব স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষার ধারণা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ওইসিডির ১৯৯৫ সালের রিপোর্টে দক্ষতা ও যোগ্যতাকে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। সংস্থাটি ১৯৯৭ সালে পিসা (প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট) উদ্ভাবন করে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করে।

ফ্রান্সে ১৯৯২ সালে এবং ফরাসি ভাষা-অধ্যুষিত বেলজিয়ামে ১৯৯৪ সালে স্কুলশিক্ষায় এ পদ্ধতির প্রচলন হয়। ওইসিডির সদস্যদেশগুলোয় ১৯৯৯ সালে এবং ওইসিডির আর্থিক সাহায্যপুষ্ট ফরাসি ভাষা-অধ্যুষিত আফ্রিকান দেশগুলোয় ২০০১ সালে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। ইদানীং যোগ্যতার সংজ্ঞা শুধু দক্ষতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন ‘যোগ্যতা’ বলতে স্পষ্টভাবে বর্ণিত, পরিমাপযোগ্য ও স্থানান্তরযোগ্য সব উদ্দেশ্যকেই বোঝানো হয়। তা ছাড়া শিখন-শেখানোর প্রক্রিয়ায় সব শিক্ষার্থীর ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিক চাহিদাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। তা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) বিধৃত অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাও যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষায় ধারণ করা হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ‘নো চাইল্ড লেফট বিহাইন্ড’ শীর্ষক শিক্ষা আইন ২০০১-এ অন্তর্ভুক্ত ছিল। শিখনকালে অর্থপূর্ণ মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দান (স্কাফোল্ড) করে শিখনপ্রক্রিয়া সফলতার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়াও এখন ‘যোগ্যতা’র অন্তর্গত। তাই যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষা এখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এশিয়ায় এর নাম দেওয়া হচ্ছে টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি কম্পিটেন্সিস; আমেরিকায় স্লোগানের মতো বলা হচ্ছে ‘কম্পিটেন্সি ওয়ার্কস’।

যোগ্যতার নির্যাস নষ্ট হওয়ার ভয়!
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের ঢেউকে ধারণ করে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমকেও যোগ্যতাভিত্তিক করা এখন সময়ের দাবি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (জাশিপাবো) ১৯৯২ সাল থেকেই যোগ্যতাভিত্তিক আদলে প্রস্তুত ‘আবশ্যকীয় শিখনক্রম’ শীর্ষক শিক্ষাক্রম প্রাথমিক স্তরে বাস্তবায়ন করে আসছে। বাস্তবে ‘যোগ্যতা’ শব্দটি কম গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহৃত হলেও প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে প্রাথমিকের চেয়ে বেশি যোগ্যতা-উপাদান বিদ্যমান (শিক্ষাস্তরে যত ওপরে ওঠা যাবে, যোগ্যতা-উপাদান অবধারিতভাবে তত বাড়তে থাকবে)। তবে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমকেও প্রাথমিকের সঙ্গে মিলিয়ে ‘যোগ্যতাভিত্তিক আদলে’ সাজাতে হবে। কিন্তু জাশিপাবোর মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইংয়ের কিছু নব্য ‘শিক্ষাক্রমবিশারদ’ প্রচার করে বেড়াচ্ছেন, ‘শিখনফল’ ব্যবহারে নাকি যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের নির্যাস নষ্ট হয়ে যেতে পারে! কিন্তু শিখনফলের মতো জরুরি ধাপে না গেলে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নই করা যাবে না।

অভিজ্ঞতাজাত শিখন (এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং): গুরুগৃহ নাকি ঠুলই পদ্ধতি
জাশিপাবোর মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইংয়ের সেসব ‘শিক্ষাক্রমবিশারদ’ আমাদের মতো শিক্ষাক্রমের একাডেমিশিয়ানদেরও ঝাঁকুনি দিয়ে বোঝাতে চাইছেন: এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং নামে তাঁরা একটা নতুন ধারণার আওতায় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করছেন; এখানে শিখনফলের কোনো স্থান নেই। এই অর্বাচীনেরা জানেন না যে এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিংয়ের মূল বিষয় ‘করে শেখা’-এর (লার্নিং বাই ডুয়িং) কথা কয়েক হাজার বছর আগে অ্যারিস্টটল বলে গেছেন। ডেভিড কোব ১৯৮৪ সালে একই ধারণাকে একটু বিস্তৃত করেছেন মাত্র। কোব নির্দেশিত মডেলে চারটি স্তর আছে: যথা-১) বাস্তব অভিজ্ঞতা (কংক্রিট এক্সপেরিয়েন্স), ২) চিন্তাশীল পর্যবেক্ষণ (রিফ্লেকটিভ অবজারভেশন), ৩) বিমূর্ত ধারণায়ন (অ্যাবস্ট্রাক্ট কনসেপচুয়ালাইজেশন) এবং ৪) সক্রিয় পরীক্ষণ (অ্যাকটিভ এক্সপেরিমেন্টেশন)। আমার মনে হয় মডেলটির আরেকটু ঘষামাজার দরকার আছে। কারণ, চিন্তাশীল পর্যবেক্ষণ সক্রিয় পরীক্ষণের পরে বেশি কার্যকর হওয়ার কথা; আর বিমূর্ত ধারণায়ন সক্রিয় পরীক্ষণের আগে কিছুটা দরকার হলেও পরে দরকার হবে আরও বেশি।

যা হোক, এমন অভিজ্ঞতাজাত শিখন আমাদের এলাকায় ‘গুরুগৃহে’ একসময় প্রচলিত ছিল। কিন্তু সে পদ্ধতি প্রাথমিক-মাধ্যমিক (প্রাক্‌-বিশ্ববিদ্যালয়) স্তরের কয়েক কোটি শিক্ষার্থীর জন্য যথেষ্ট হলে তো আর জাতীয় শিক্ষাক্রম বা স্কুল—কোনোটারই দরকার পড়ত না! বাল্যকালে আমরা বাঁশের চিকন আগার টুকরার নলের মধ্যে একটি হাতলসহ শক্ত কাঠি ভরে ‘ঠুলই’ বানাতাম। জঙ্গলের দাতই গোটা (এক প্রকার উদ্ভিদজাতীয় গাছের ফল) ছিল ‘ঠুলই’-এর গুলি। এই ঠুলই পাখির দিকে তাক করে ‘গুলি’ ছুড়লে গুলির চেয়ে ‘ঠুস’ শব্দের ভয়ে পাখি উড়ে যেত; এতেই আমাদের সাফল্য এবং আনন্দ! এখন আমরা যদি শিক্ষার্থীদের আর্চারি শেখাতে বন্দুক না দিয়ে প্রথম ঠুলই দিয়ে ‘অভিজ্ঞতা অর্জন’ করতে বলি, তবে দেখা যাবে, অন্যান্য জাতি শুরু থেকেই বন্দুক দিয়ে অনুশীলন করায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমাদের ঠুলই পার্টি বরাবরই ‘হারু পার্টি’ হিসেবে ফিরে আসবে। বাস্তবে আমাদের দ্বিতীয় আবর্তনের শিক্ষাক্রম (১৯৯২-৯৫) থেকেই এ মডেল আংশিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে, এখন শিখনফল বাদ দিয়ে শুধু এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং পদ্ধতিকে ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ নাম দিয়ে সব সমস্যার সমাধান প্রচেষ্টায় সমস্যা আরও বাড়তে বাধ্য।

জাতীয় শিক্ষাক্রমের সঙ্গে নেই শিক্ষাক্রমবোদ্ধারা
‘যার কাজ তারই সাজে, আনাড়ির লাঠি বাজে’! অত্যন্ত দুঃখের বিষয়: জাশিপাবোর গত প্রায় ৩৮ বছরের ইতিহাসে সেখানে যোগ্যদের স্থান হয়েছে খুবই কম। যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের অধিকাংশই শিক্ষা কার্যক্রম তেমন বুঝতেন না। জাতীয় শিক্ষাক্রম নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে শিক্ষাক্রমবোদ্ধাদেরই যদি দূরে ঠেলে দেওয়া হয়, কীভাবে আমরা ভালো কিছু আশা করতে পারি।

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা শিক্ষাক্রম গবেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (বিসিএস শিক্ষা)। ই-মেইল: [email protected]