২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

যেভাবে দেশ গণপিটুনিতে অভ্যস্ত হলো

২০১১ সাল থেকে পরের ৮ বছরে দেশে গণপিটুনিতে ৮০০ জন নিহত হয়েছেন।
প্রথম আলো

বিবিসি বাংলা সার্ভিস শুক্রবার গা শিউরে উঠার মতো তথ্য দিয়েছে। বাংলাদেশে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। বছরে গড়ে ১০০ জন করে লিঞ্চিং বা গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন। ছেলেধরা, ডাকাত ও চোর সন্দেহে ওই ব্যক্তিদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। উল্লেখ্য, রাজধানী ঢাকাতেই সন্তানদের স্কুল থেকে আনতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন এক স্কুলশিক্ষিকা। আরও আগে শবে বরাতের রাতে আমিনবাজারে ঘুরতে গিয়ে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন ছয় তরুণ। ব্রহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিপক্ষের কাটা পা নিয়ে উল্লাস করেছে এক দলের লোকেরা। নোয়াখালীতে পুলিশ আটক ব্যক্তিকে জনতার হাতে গণপিটুনির জন্য তুলে দিয়ে হত্যা করিয়ে নিয়েছিল।

আমাদের সমাজ ভয়ংকর অসহিষ্ণুতা ও উগ্রবাদের দিকে যাত্রা করেছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন—কোথাও কোনো সহনশীলতা নেই। এখানে কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে, এমনকি বুঝতেও রাজি নয়। বিভাজন ক্রমেই আতঙ্কজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে আইনের প্রতি গভীর অনাস্থা। গত এক দশকে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
গুজব ও সন্দেহের বশবর্তী হয়ে উন্মত্ত জনতা সন্দেহভাজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। যাঁকে মারা হচ্ছে তিনিও ওই বিক্ষুদ্ধ জনতার মতোই সাধারণ নাগরিক। এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলাকে এক অর্থে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও বলা যায়। বিচারবহির্ভূত হত্যা কেবল রাষ্ট্রই করছে না, সাধারণ নাগরিকেরাও করছে।

সন্দেহভাজনকে আইনের হাতে তুলে না দিয়ে জনসাধারণ নিজেরাই বিচারের দায়িত্ব নিয়েছে, যা পুরোপুরি আইনবহির্ভূত বিষয়। আইনের প্রতি জনসাধারণের আস্থা কমে গেলে হত্যা, ধর্ষণ, গণপিটুনির মতো বীভৎস ঘটনার প্রকোপ বাড়তে থাকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাইকোপ্যাথ বা মানসিকভাবে অসুস্থ না হলে, সহমর্মিতা না থাকলে, মানবিক গুণ হারিয়ে না ফেললে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষে সম্মিলিতভাবে কাউকে খুন করা সম্ভব নয়। হত্যা বা খুনের বিপরীতে সব সময়ই মানসিক বাধা কাজ করে। এই বাধা ভেঙে ফেলার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশেষ ধরনের পরিবেশ তৈরি করা হয়, যা জনসাধারণকে গণপিটুনির মতো সম্মিলিত ভয়ংকর অপরাধের দিকে নিয়ে যায়।

কানাডার ওয়াটার লু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টমাস হোমার ডিক্সন গণপিটুনির কারণ ও এর সঙ্গে জনসাধারণের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি সমাজের অমানবিকীকরণ ও সংঘাত বিশ্লেষণের একটি মডেল বা কাঠামো তৈরি করেছেন। তিনি মনে করেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের সবার না হলেও কারও কারও মধ্যে উন্মত্ত আচরণ করার প্রবণতা আছে। যদি পরিস্থিতি পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা যায়, তবে এই উন্মত্ত জনতা গণপিটুনির মতো অপরাধে জড়িয়ে যায়।

এই পরিকল্পিত পরিস্থিতিকে অধ্যাপক টমাস বলছেন আমানবিকীকরণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় সমাজ থেকে মানবিক গুণাবলি হারিয়ে যাবে। অন্যায়, দুর্নীতি করে কেউ অপরাধবোধে ভুগবে না। বরং ফলাও করে নিজের সাফল্য প্রচার করবে। সমাজে ইচ্ছাকৃতভাবেই বিভাজন তৈরি করা হবে। অহষ্ণিুতা বাড়তে থাকবে বিভাজনের কারণে। সমাজ ‘আমরা’ থেকে ‘আমরা বনাম ও তাহারা’তে পরিণত হবে। সমাজের এই পরিস্থিতি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে হতে পারে। তবে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিভাজনটাও রাজনীতিবিদেরাই মূলত করে থাকেন।

বিভাজিত সমাজে প্রকাশ্যে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর মৃতদেহ প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয় ভীতি সঞ্চারের জন্য। অনেক সময় মৃতদেহের ওপর উঠে নৃত্যও করা হয়। একদল মানুষ এর পক্ষে সাফাই তৈরি করে। বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে গণপিটুনির কারণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। যারা এ ধরনের গণপিটুনিতে অংশ নেয়, তাদের মধ্যে সাধারণত কোনো অপরাধবোধ কাজ করে না। বরং এরা মনে করে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে তারা সমাজ, রাষ্ট্র বা ধর্মকে সেবা করছে।

গণপিটুনির সঙ্গে রাষ্ট্রের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ভয়ভীতি ছড়ানোর গভীর সংযোগ আছে। ইউরোপের সামন্ত আমলে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডে এর ভয়াবহতা লক্ষ করা যায়। অতীতেও ছিল এর ধরনের হত্যাকাণ্ড। তখন ইউরোপে রাজতন্ত্রের সঙ্গে পোপতন্ত্রের আপসরফা হয়ে গিয়েছে। এর আগে একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজতন্ত্রের সঙ্গে পোপ ও ধর্মযাজকদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক লড়াই ছিল। লড়াই শেষে আপসরফায় রাজতন্ত্র ও পোপতন্ত্র একে অপরকের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। চার্চ অর্থের বিনিময়ে স্বর্গের সনদ বিতরণ শুরু করে। ওই সময় রাজতন্ত্র ও পোপতন্ত্রের ক্ষমতা কাঠামো বা শোষণ নিয়ে সমালোচনা করলেই নানা উপায়ে গণপিটুনির শিকার হতেন বিরোধী মতের লোকেরা। তবে ওই সময়ে গণপিটুনি ছিল রাষ্ট্র কর্তৃক অনেকটা অনুমোদিত।

অভিযুক্তদের উন্মত্ত জনসাধারণের হাতে ছেড়ে দেওয়া হতো। ডাইনি, কালোজাদুর অধিকারী, ধর্মদ্রোহী বা রাষ্ট্রদোহী বলে অনেককেই পাথর ছুড়ে বা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। আগুনে পোড়ানোর বা মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য নিয়ে যাওয়ার পথে নাগরিকেরা পাথর ছুড়ে মারত। এরপর প্রকাশ্যেই এসব সাজা কার্যকর করা হতো মহামতি যিশুকে হত্যার মতো করেই। যিশুকেও ক্রুশবিদ্ধ করার আগে রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকেরা পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন।

ইউরোপের রাষ্ট্র ও জনসাধারণের যৌথ হত্যাকাণ্ড ১৮ ও ১৯ শতকে আমেরিকায় এসে গণপিটুনি বা পাবলিক লিঞ্চিংয়ে পরিণত হয়। রাষ্ট্র এখানে অনুপস্থিত। ওই সময় অনেক কৃষ্ণাঙ্গকে প্রকাশ্যে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়।

ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা থেকে জানা যায়, রাষ্ট্র ও সমাজ পরিকল্পিতভাবেই জনসাধারণকে স্বার্থ হাসিলের জন্য গণপিটুনির দিকে এগিয়ে দেয়। অনেকের নিশ্চয়ই ‘বাইসাইকেল থিভস’ সিনেমার কথা মনে আছে। ইতালির মন্দাক্রান্ত সমাজে নিজের সাইকেলটি চুরির পর আন্তোনিও নিজেই একটি সাইকেল চুরির সিন্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি সাইকেল চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হন। ইতালির পুলিশ আন্তোনিওর সাইকেলটি খুঁজে দিতে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি, যা তাকে চুরির দিকে ঠেলে দেয়। ‘বাইসাইকেল থিভস’ সিনেমার একটি পরিষ্কার বার্তা আছে। তা হচ্ছে কারোরই পুলিশের ওপর আস্থা নেই। বরং রাষ্ট্র চুরি ও গণপিটুনির রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে।

অর্থনৈতিক দুরবস্থা, ভয়, গুম-আতঙ্ক জনসাধারণকে আইনের প্রতি আস্থাহীন করে তোলে। এই আস্থাহীনতা থেকে গণমনোবিকার দেখা দেয় সমাজে। অধ্যাপক টমাস যাকে বলছেন সাইকোপ্যাথি বা মানসিক বিকারগ্রস্ততা। এই বিকার থেকে গণপিটুনি ছাড়াও নানা ধরনের ভয়াবহ সব অপরাধ অহরহই ঘটতে থাকে। ইউরোপ–আমেরিকার ইতিহাস থেকে এমন ধারণাই পাওয়া যায়।

আমাদের সমাজেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রকাশ্য রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, কাটা পা নিয়ে প্রকাশ্যে উল্লাস বা ধর্ষণের দৃশ্য ধারণ করা গণমনোবিকারের স্পষ্ট লক্ষণ। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যখন বেআইনি হত্যাকে সমর্থন করা হয়, তখন সমাজের সেই উন্মত্ত অংশ গণপিটুনিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ধর্ম অবমাননা, ছেলেধরা, ডাকাত, চোর বলে যাকে খুশি তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। এ কারণেই ৮ বছরে ৮০০ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। তবে কেউ কেউ বলেন, প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে বেশি। নিশ্চিতভাবেই এই পরিস্থিতি উদ্বেগের, আতঙ্কের।


ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক