যেখানে নেপাল এগিয়ে আছে
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সাফল্য অনেক। নারীশিক্ষার হার বেড়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনেও তাদের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। কিন্তু বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে নেপালের মতো সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। জাতীয় পার্লামেন্ট, প্রাদেশিক পার্লামেন্ট ও স্থানীয় সরকারের সব স্তরে নারীর এক-তৃতীয়াংশ আসন নিশ্চিত করেছে দেশটি। তারা এমন বিধান করেছে যে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান পুরুষ হলে উপপ্রধান নারী হবেন। আবার প্রধান নারী হলে উপপ্রধান পুরুষ। বর্তমানে দেশটির প্রেসিডেন্ট নারী, বিদ্যাদেবী ভান্ডারি। ভাইস প্রেসিডেন্ট পুরুষ, নন্দ কুমার পুন। বাংলাদেশে নারী সরকারপ্রধান, সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও স্পিকার হলেও রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি পদে এখনো কোনো নারী আসেননি।
২৭৫ সদস্যের নেপালি পার্লামেন্টে নারী সদস্য ৯১ জন। নেপালের দ্বৈত নির্বাচনব্যবস্থা। পার্লামেন্টের ১৬৫ জন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। বাকি ১১০টি আসনে আনুপাতিক হারে। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলকে ন্যূনতম ৫ শতাংশ ভোট পেতে হয়।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের একটি সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নেপালের বিভিন্ন শহর ঘুরে মনে হয়েছে, আসনের বিচারে নয়, সামাজিক মাপকাঠিতেও সেখানে নারীর অবস্থান উঁচুতে। অফিস, বাজারসহ সবখানেই নারীরা সমতালে এগিয়ে চলেছে। ব্যতিক্রমীভাবে নেপালে নারী-পুরুষের আনুপাতিক হার ৫০ দশমিক ৪ ও ৪৯ দশমিক ৬। অর্থাৎ পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। নেপালের যেখানেই গিয়েছি সবকিছু সুশৃঙ্খল, সাজানো–গোছানো। তাদের আড়ম্বর নেই। আন্তরিকতা আছে। নেপালের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় সমান। যদিও নেপালের জনসংখ্যা মাত্র ৩ কোটি।
নেপালেও নারীর প্রতি সহিংসতা আছে। বৈষম্য আছে। তবে সেখানে নারী নির্যাতনবিরোধী আইন বেশ কড়া। একটি উদাহরণ দিই। গত অক্টোবরে নেপালের পার্লামেন্টের স্পিকার কৃষ্ণ বাহাদুর মাহরার বিরুদ্ধে মি টুর অভিযোগ করেন পার্লামেন্ট সচিবালয়েরই এক নারী কর্মকর্তা। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এখনো িতনি কারাগারে। একদা মাওবাদী এই নেতা আগের সরকারে উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু আইন তাঁকে রেহাই দেয়নি। মামলা নিষ্পত্তির আগেই পদত্যাগ করতে হয়েছে।
এ অবস্থায় নেপালের পার্লামেন্ট পরিচালনার দায়িত্বও এসে পড়েছে একজন নারীর ওপর। ডেপুটি স্পিকার শিবা মায়া তুমবাহালি। তিনি বিরোধী দল নেপাল কংগ্রেস পার্টি থেকে নির্বাচিত। নেপালের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিও ছিলেন নারী, সুশীলা কার্কি।
নেপালে শেষ নভেম্বরে আবহাওয়া ছিল চমৎকার। না বেশি শীত, না উষ্ণ। পথে, রেস্তোরাঁয়, হোটেলে, পর্যটনকেন্দ্রে যেখানে গিয়েছি, সেখানেই দেখেছি শত শত বিদেশি পর্যটক। বেশির ভাগ ইউরোপীয় ও চীনা। একদা দিল্লিনির্ভর নেপাল সাম্প্রতিক কালে বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকছে। অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সিমেন্ট, বিমান পরিবহনসহ নেপালের অনেক খাতে চীন বিনিয়োগ করছে। চীন-নেপাল সীমান্তে বর্তমানে ছয়টি সড়কপথ আছে। নতুন করে ট্রেন লাইন তৈরি হচ্ছে। নেপাল–চীন ঘনিষ্ঠতা নিয়ে স্থানীয় লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অস্বস্তিও কম নয়। তাঁদের মতে, চীনের বিনিয়োগে আপত্তি নেই। কিন্তু দেশটি যদি কর্তৃত্ববাদী শাসন এখানে ‘রপ্তানি’ করতে চায়, সেটি নেপালিরা মেনে নেবে না।
অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরের পর ছয়জন তিব্বতি শরণার্থীকে নেপাল ফেরত পাঠায়। এ নিয়ে দেশে–বিদেশে বেশ সমালোচনা হয়েছে। আরেক পর্যবেক্ষক জানিয়েছেন, ভারতের বৈরী আচরণের কারণেই নেপাল চীনের দিকে ঝুঁকছে। সম্প্রতি ভারতের নতুন মানচিত্রে কালাপানিকে তাদের অংশ দেখানোয় নেপাল ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতা অবশ্য বলেছেন, ‘আমরা চীন বা ভারত কারও দিকে ঝুঁকছি না; স্বতন্ত্র অবস্থানে আছি।’
মাঝখানে থাকায় নেপাল দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে দর–কষাকষি করতে পারছে। তাদের এক সীমান্ত ভারতের সঙ্গে, আরেক সীমান্ত চীনের সঙ্গে। কিন্তু বাংলাদেশ পারছে না। আমাদের তিন দিকে ভারত। চীনের সঙ্গে কোনো সীমান্ত নেই। দর–কষাকষির সুযোগও কম।
বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে নেপালিদের ধারণা বেশ উঁচু। ঢাকা থেকে এসেছি শুনে সাগ্রহে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। কাঠমান্ডুর থামেল এলাকার দোকানে গিয়ে দেখেছি, নেপালি বিক্রেতারা একটি-দুটি বাংলা শব্দও বলছেন। দুই দেশের মানুষের পোশাক ও চেহারায় তেমন মিল না থাকলেও ভাষায় মিল আছে। বর্তমানে বাংলাদেশে নেপালের চার হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, বেশির ভাগ মেডিকেলে। কিছু প্রকৌশল ও অন্যান্য বিষয়ে। এ নিয়ে নেপালিদের মধ্যে একধরনের কৃতজ্ঞতাবোধ লক্ষ করলাম। একজন কর্মকর্তা বললেন, চীনের মেডিকেল কলেজেও নেপালের অনেক ছেলেমেয়ে পড়েন। কিন্তু ফিরে এসে মেডিকেল কাউন্সিলের স্বীকৃতি পান না। বাংলাদেশ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা অনায়াসে পেয়ে যান। আমাদের হতাশাজনক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেও এই আশার কথাটি শুনে ভালো লাগল।
নেপালিদের আক্ষেপ, ২০১৫ সালের ভূমিকম্প ও ২০১৮ সালে ইউএস-বাংলার একটি বিমান দুর্ঘটনার পর দেশটিতে বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। দুর্ঘটনার আগে বাংলাদেশ থেকে বছরে ৫০ হাজারের কাছাকাছি পর্যটক যেত। গত বছর সেটি নেমে এসেছে ২৬ হাজারে।
নেপাল সরকার বিদেশি পর্যটক বাড়াতে ভিশন ২০২০ ঘোষণা করেছে। পর্যটকসংখ্যা বাড়িয়ে বর্তমান ১৩ লাখ থেকে ২০ লাখে উন্নীত করতে চায়। তারা আশা করছে, আগামী বছর বাংলাদেশ থেকেও ১ লাখ পর্যটক যাবে সেখানে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো একযোগে কাজ করছে। নেপালের পোখারা ও লুম্বিনি বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক রূপ নিচ্ছে। নেপালিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কবে বাংলাদেশের সৈয়দপুর আঞ্চলিক বিমানবন্দরে রূপ নেবে। বিমানের পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ তৈরিরও চেষ্টা চলছে। দুই সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। মাঝখানে ভারত। ভুটান রাজি না হলে তিন দেশের মধ্যে যান চলাচল শুরু হতে পারে।
নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের বহু ক্ষেত্রে মিল আছে। দুটি দেশেই দারিদ্র্য, বেকারত্ব প্রকট। তবে অমিল হলো ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত’ নেপালে রাজনৈতিক স্থিতি এসেছে। মতপার্থক্য সত্ত্বেও সরকার ও বিরোধী দল একযোগে কাজ করছে। বাংলাদেশে একধরনের গুমোট অবস্থা বিরাজ করছে। কাঠমান্ডুতে পৌঁছে বুঝতে পারি পেঁয়াজের ঝাঁজ নেপালেও পৌঁছেছে। বাংলাদেশের মতো নেপালও ভারতের ওপর অধিক নির্ভরশীল ছিল।
আরেকটি ক্ষেত্রে মিল হলো, দুটি দেশেই প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতি প্রকট। আবার দুই দেশই দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে হাঁটছে। নেপাল ২০২৪ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে চাইছে।
নেপালের চেয়ে বাংলাদেশে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বেশি। মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ুও বেশি। আবার অনেকগুলো সূচকে নেপাল এগিয়ে আছে। কোনো দেশের মানুষ ভালো আছে কি না, সেটি সব সময় জিডিপি বা মাথাপিছু আয় দেখে বোঝা যায় না। বরং দেশটির মানুষের চেহারা, জীবন-জীবিকার ধরন, নারী-পুরুষের সমতালে চলা দেখে বোঝা যায়। নেপালের মানুষের মধ্যে একধরনের প্রশান্তি লক্ষ করেছি। কোনো অস্থিরতা নেই। অসুস্থ প্রতিযোগিতা নেই। হতে পারে জনসংখ্যা কম থাকার কারণেই এটি হয়েছে।
এর আগে ২০১১ সালে নেপালে গিয়েছিলাম। সে সময়ে এত সব উন্নয়নযজ্ঞ চোখে পড়েনি। এখন সেখানে বড় বড় উঁচু ভবন হয়েছে। রাস্তাঘাটগুলো প্রশস্ত হয়েছে, পর্যটনকেন্দ্রগুলো পরিচ্ছন্ন, সুসজ্জিত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশে নিয়োজিত নেপালি রাষ্ট্রদূত বংশীধর মিশ্র জানান, ২০১৫ সালের ভূমিকম্প ছিল নেপালিদের জন্য ওয়েক আপ কল বা জেগে ওঠার ডাক। এরপরই সরকার, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এই চেতনা এসেছে যে দ্রুত ধ্বংসের ক্ষত মুছে ফেলতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই সংবাদমাধ্যম নিরঙ্কুশ স্বাধীন নয়। তারপরও নেপাল কিছুটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে আছে ধারণা করি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ যেখানে চার ধাপ পিছিয়ে ১৫০তম স্থান পেয়েছে, সেখানে নেপালের অবস্থান ১০৬।
ভারত ও পাকিস্তানের সূচক যথাক্রমে ১৪০ ও ১৪৭। ভুটান চার ধাপ এগিয়ে ৮০তম স্থান এবং মালদ্বীপ ১১৭ থেকে ৯৮-এ।
৮ নভেম্বর নেপালি টাইমস-এ CENSURING CENSORSHIP শিরোনামে সম্পাদকীয় দেখে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। নেপাল সরকার মিডিয়া কাউন্সিল আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, সাংবাদিক ইউনিয়নের আন্দোলনের কারণে সেটি স্থগিত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ঠেকাতে পারেননি।
নেপালি টাইমস-এর ওই সম্পাদকীয়র কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি, যাতে পাঠক সাহসী সাংবাদিকতার কিছুটা প্রমাণ পাবেন। এতে বলা হয়: ‘জনগণের আবেগকে পুঁজি করে বিশ্বব্যাপী যেসব নেতা নির্বাচিত হন, তাঁরা ভাবেন যে সাংবাদিকদের হত্যা করার প্রয়োজন নেই। সাংবাদিকতা হত্যা করতে পারলে সেটি অধিক কার্যকর হবে। তাঁরা সংবাদমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা ধ্বংস করেন, যাতে নাগরিকেরা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে না পারে এবং শাসকেরা অন্যায় করেও অনায়াসে পার পেয়ে যেতে পারেন।...গত বছর নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে একের পর এক ব্যবস্থা নিয়েছে। এটি কোনো আকস্মিক, দ্রুত অভিযান ছিল না, পর্যায়ক্রমে চাপ বাড়িয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো চীনের মতো নির্যাতন ও হত্যার পথে না গিয়ে এমন ব্যবস্থা করা, যাতে আমাদের স্বাধীনতা পরতে পরতে চলে যাবে, কিন্তু আমরা টেরও পাব না, সেটি কীভাবে গেল।’
নেপালি টাইমস-এর এই সম্পাদকীয় মন্তব্য বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্যই সত্য।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি