যে বৈমানিক গাইতেন ভাটিয়ালি গান

ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ার
ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ার

আজ তাঁর জন্মদিন ও জন্মশতবার্ষিকী। কবি গোলাম মুস্তাফার জ্যেষ্ঠ পুত্র। পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশের প্রথম বাঙালি মুসলমান বৈমানিক ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ার। তাঁর জন্ম ১৯১৭ সালের ২৪ জুলাই যশোর জেলার কমলাপুরে। মায়ের নাম জমিলা খাতুন। প্রাথমিক শিক্ষা খাসিয়ারার ননীবাবুর পাঠশালায়, নিজ গ্রাম মনোহরপুর ও শৈলকুপায় প্রাইমারি স্কুলে। ১৯২৮ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি। ১৯৩৪ সাল অবধি হেয়ার স্কুলে পড়ে সেখান থেকেই ইন্ডিয়ান মার্চেন্ট নেভির ট্রেনিং জাহাজ ডাফরিনে পাস করে ১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসে আইএমএমটিএস ডাফরিনে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন ও তিন বছর পরে ট্রেনিং শেষ হলে এক্সট্রা ফার্স্ট ক্লাস সার্টিফিকেট পেয়ে ‘মোস্ট এফিশিয়েন্ট সিনিয়র ক্যাডেট ক্যাপ্টেন’ হিসেবে সাওয়ার প্রাইজ পান।

ক্যাপ্টেন আনোয়ার ছিলেন আমার আপন বড় ভাইয়েরই মতো। তাঁর হাসিমুখ, সুন্দর ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব ও সততার কোনো তুলনা ছিল না। এমন শান্ত-সুন্দর মুখশ্রীর মানুষ আর পাইনি। ভেবে পেতাম না এমন সুন্দর চেহারা কোনো বাঙালির হতে পারে? তাঁর কণ্ঠে ছিল উদাত্ত ভাটিয়ালি গান, মাঝেমধ্যে রুশ লোকগীতি, ‘ভলগা ভলগা, মাদার স্ট্রিম ও মাই ভলগা মাদার স্ট্রিম’ও গাইতেন। আমার আব্বাও তাঁর গান শুনে অতিশয় মুগ্ধ হতেন। চোখ বন্ধ করলেই যেন সেসব গান শুনতে পাই।

মুস্তাফা আনোয়ারের স্ত্রী সুস্মিতা যেমন সুন্দরী, তেমনি বিদ্যায় ও সংস্কৃতিতে অনন্যা। তিনি একাধিক গ্রন্থের লেখিকা। একবার কলকাতার ২৯ নম্বর সার্কাস অ্যাভিনিউতে তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাঁর আপ্যায়ন ও সেবার কোনো তুলনা ছিল না। বুঝতেই পারিনি আমি তাঁর রক্তের কেউ নই, এমনকি দেবরও নই। কী কোমল স্নেহছায়ায় কাটিয়েছি কয়েকটি দিন। তাঁর প্রতিটি কথা,
প্রতিটি স্নেহমাখা স্পর্শ আজও আমায় আন্দোলিত করে। যেমন করে তিনি ভালোবেসেছিলেন তাঁর স্বামী আনোয়ারকে, তেমনি তাঁর পরিবার, তাঁর ধর্ম ও তাঁর সংস্কৃতিকে।

এই সঙ্গেই মনে পড়ছে মন্টু ভাইয়ের [চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার] কথা। মুস্তাফা আনোয়ারের ভাই। সম্ভবত তিনি আমার বড় ভাইয়ের চেয়ে দু-এক মাস বড়, অথচ দারুণ বন্ধুত্ব আমাদের মধ্যে। দুজনই গান গাই, দুজনই দুজনকে ভালোবাসি। একবার একটি মেয়েকে পছন্দ হলো মন্টু ভাইয়ের। মেয়েটি ভারী সুন্দরী। দুজনে একসঙ্গে রোজ ছবি আঁকতে বেরিয়ে যায়, আর আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। সুস্মিতা ভাবি বুদ্ধিমতী। ভাবলেন, মুসলমান ঘরে দুই হিন্দু বউ চলবে না। মেয়েটিকে মিষ্টি কথায় বিদায় দিলেন। একদিন মন্টু ভাই সকালবেলা গুনগুন করছেন কে এল সায়গলের গাওয়া, ‘ম্যায় কেয়া জানু কেয়া জাদু হ্যায়’। একজন ভিখারিনী তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠে বেল বাজালেন। জানালেন, আমি ভিখারিনী নই। শুধু একনজর দেখতে এসেছি সেই ভদ্রলোককে, যিনি ওই গান গাচ্ছিলেন। সুস্মিতা ভাবি আমল দিলেন না, তাঁকে বিদায় করলেন। মন্টু ভাই যদি গানই করতেন, তিনি হতেন একজন সেরা কণ্ঠশিল্পী। ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ারের ক্ষেত্রেও তা-ই। উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁরা দুজন—মুস্তাফা আজিজ, মুস্তাফা পাশা, পেয়েছিলেন পিতার কাব্য, শিল্প ও সংগীতগুণ। জ্যোৎস্না, হাসনা ও হেনা—কবির তিন মেয়েও ব্যতিক্রম নন। পরিবারটি বাংলাদেশের গৌরব।

মুস্তাফা আনোয়ার সম্বন্ধে আরও বলি। জাহাজে কর্মরত অবস্থায় তাঁর মায়ের মৃত্যু ঘটলে এবং খুব বেশি সমুদ্র বায়ুজলাক্রান্ত হওয়ার কারণে ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসে জাহাজের চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে সিভিল এয়ার রিজার্ভ কোরের জন্য মনোনীত হয়ে ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে বিহার ফ্লাইং ক্লাবে যোগদান করেন। ১৯৪১ সালে লাহোরের অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ২৩ মে ১৯৪১ সালে আইটিএসের ট্রেনিং শেষ করে জোতপুরের এলিমেন্টারি ফ্লাইং ট্রেনিং স্কুলে যোগদান করেন। অনেক ট্রেনিংয়ের পর ১৯৪৬ সালে  ফ্লাইং অফিসার হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ডালমিয়া জৈন এয়ারওয়েজে জুনিয়র ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দেন। জুলাই মাসে ক্যাপ্টেন হিসেবে উন্নীত, ১৯৫০-এ সিনিয়র ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগদান, ১৯৫৭ সালে ডিসি ফোরের ক্যাপ্টেন, ১৯৫৮ সালে ভিসকাউন্টে কমান্ডার হিসেবে
উন্নীত, ১৯৫৯ সালে পিআইএ ভিসকাউন্টে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগদান। ১৪ আগস্ট ১৯৫৯ সাল তাঁর জীবনের শেষ দিন। তাঁর মৃত্যুর পর পাকিস্তান টাইমস-এ লেখা হয়েছিল: মুস্তাফা প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার ঘণ্টা বিমান চালিয়েছেন, এটা একটা রেকর্ড; আর কোনো পাকিস্তানি এই রেকর্ড অর্জন করতে পারেননি।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।