গতকাল ছিল তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর জন্মদিন; ওর ২৩ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু ওর বয়স বাড়েনি, আর বাড়বে না। মাত্র ১৭ বছর ৫ মাসে আটকে আছে তার জীবনপ্রবাহ। যে জন্মদিনে আনন্দ–উচ্ছ্বাস ছাপিয়ে ওঠে মৃত্যুর বিভীষিকা, তা কেবলই হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে তোলে।
৫ অক্টোবর ১৯৯৫, ত্বকীর জন্ম। দিনটি ছিল বিজয়া দশমী। ঢাকের বাদ্যে যখন মোহাচ্ছন্ন আমাদের গঞ্জ-শহর, যখন ওঙ্কারে মুখরিত বিদায়ের আয়োজন; সে প্রগাঢ়-প্রসন্ন বিকেলে ত্বকীর জন্ম। খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত, উদ্ভাসিত কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়। কিন্তু না, ত্বকীর প্রতিজ্ঞা দুর্বোধ্য ছিল না। যে ছাড়পত্র হাতে তার আগমন, খুব কম সময়েই আমরা তার পাঠোদ্ধারে সক্ষম হয়েছিলাম। সুকান্তের দুর্নিবার আঠারো পেরোনোর আগেই সে যাত্রার করুণ পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
ত্বকীর এ লেভেলের পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার পথে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, পরীক্ষা কেমন হয়েছে। বলল, ৩ কম পাব। কথাটা ঠিক বোঝা গেল না। ৭ মার্চ যেদিন পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো, দেখলাম পদার্থবিজ্ঞানের তিন পর্বে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ত্বকী ২৯৭ পেয়েছে। এটি ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ নম্বর। কিন্তু তখন ত্বকী আর নেই। আগের দিন বিকেলে পাঠাগারে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে।
৮ মার্চ ২০১৩। সকাল সাড়ে নয়টা। নির্ঘুম চোখ। দুরাত ঘুম নেই। ৬ মার্চ বিকেলে নিখোঁজ হয়েছে ত্বকী। হঠাৎ একটি ফোন এল। ফোনে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বললেন, ‘কুমুদিনীর পাড়ে একটি লাশ পাওয়া গেছে; এটাকে কি আপনি দেখবেন?’ বাসায় তখন জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন; ফোনটা তাঁকে দিলাম। তিনি ‘আমাদের সেখানে যাওয়া উচিত’ বলে উঠে দাঁড়ালেন। কুমুদিনীর জায়গাটি আমাদের বাসার কাছেই। গাড়িতে পাঁচ মিনিটের পথ। ইতিমধ্যে অনেকেই সেখানে জড়ো হয়েছেন। দূর থেকে লাশটি দেখে মনে হলো এটি ত্বকীর নয়। হঠাৎই যেন বুকে চেপে থাকা একটি বিশাল পাথর অপসৃত হলো। কারণ ত্বকী ছিল হালকা-পাতলা ছিমছাম গড়নের। কিন্তু না, মুহূর্তেই সবকিছু বদলে গেল। দুদিন নদীতে থাকাতে চেনা যাচ্ছিল না। কাছে গিয়ে গায়ের জামা, প্যান্ট, সেন্ডেল দেখে বুঝলাম ফোরাতের কারবালা শীতলক্ষ্যার কুমুদিনীর পারে এসে নেমেছে। ফাল্গুনের সকালে এখানে নেমে এসেছে অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার।
এর এক বছর পর শীতলক্ষ্যায় একসঙ্গে সাতটি লাশ পড়েছে। এখনো পড়ছে। ত্বকী হত্যার পর থেকে শীতলক্ষ্যার পারে প্রায় ছয় বছর ধরে চলছে হাজারো প্রদীপ প্রজ্বালনের আয়োজন, আলোর-ভাসান। কিন্তু অন্ধকার কাটছে না। জিঘাংসার অন্ধকার ক্রমেই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছে। যে শীতলক্ষ্যার জলে হাজার বছর ধরে সর্ব পাপ থেকে মুক্তির স্বপ্নে স্নানে মিলিত হন লাখো নর-নারী, আজ সে নদী লাশের ভাগাড়। হন্তারকের শ্যেনদৃষ্টিতে আজ অপাপবিদ্ধ শীতলক্ষ্যা যেমন ব্যাধিগ্রস্ত, তেমনই ব্যাধি-আক্রান্ত হয়ে পড়েছে আমাদের চারপাশ। এ ব্যাধি প্রতিরোধের আগ্রহ আজ আর আমাদের রাষ্ট্রেরও নেই।
ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারদের বোর্ডপ্রধান বলেছেন, ‘ত্বকীকে মাথার তিন দিক থেকে আঘাত করা হয়েছে। এ আঘাতই তার মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু হত্যাকারীরা মৃত্যুটাকে ত্বরান্বিত করার জন্য গলা চেপে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করেছে।’ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দুজন ঘাতক বলেছে, গজারির লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করার পর ত্বকীর বুকের ওপর উঠে গলাটিপে শ্বাস রোধ করে তারা তাকে হত্যা করেছে। হত্যার পর লাশ গাড়িতে করে নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিয়েছে।
ত্বকী হত্যার তদন্তকারী সংস্থা র্যাবের কর্মকর্তারা হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর ৫ মার্চ ২০১৪ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ত্বকীকে নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের নেতৃত্বে তাদেরই টর্চার সেলে ১১ জন মিলে হত্যা করেছে। সেই সংবাদ সম্মেলনে হত্যার বিশদ বর্ণনা দিয়ে তাঁরা জানান কখন, কীভাবে, কোথায়, কেন এবং কারা কারা মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। তাঁরা সেই সম্মেলনে সংবাদকর্মীদের একটি খসড়া অভিযোগপত্র সরবরাহ করে বলেন, অচিরেই তা আদালতে পেশ করা হবে। কিন্তু তারপর পাঁচ বছর কেটে গেল, সে অভিযোগপত্র আজও আদালতে পেশ করা হলো না। ত্বকী হত্যার বিচারের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আছে।
অনেক সময় অপরাধের বিচার হয় না, অভিযোগপত্র দেওয়া হয় না ঘটনার রহস্য অনুদ্ঘাটনের কারণে, অপরাধী শনাক্ত হয় না বলে। কিন্তু ত্বকীর ক্ষেত্রে তার উল্টো। ত্বকীর ঘাতকেরা চিহ্নিত হওয়ার কারণেই এই হত্যার অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে না, বিচার বন্ধ করে রাখা হয়েছে। রাজনীতি আজ অক্টোপাসের মতো আমাদের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। যে রাজনীতির অন্তর্গত শক্তি গড়ে ওঠে মানুষকে ভিত্তি করে, সে রাজনীতিতে মানুষের আজ কোনো অধিকার নেই।
৩০ লাখ শহীদের রক্তে, লাখো মায়ের অশ্রুতে যে দেশ প্লাবিত হয়েছে, এখনো কান পাতলে যে মাটিতে সে কান্নার শব্দ শোনা যায়; সে মাটিতে ঘাতকেরা কীভাবে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়? ঘাতকদের চেহারা ও পোশাকে বদল এলেও তাদের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আজকে রাষ্ট্র থেকে তারা আনুকূল্য পায়, সরকার তাদের পেছনে দাঁড়ায়। রাজনীতি, সমাজ, রাষ্ট্রে দুর্বৃত্তরা গুরুত্ব পেলে মানুষ হেরে যায়। মানুষের হারে দেশেরই হার।
ত্বকী ছিল স্বপ্নবান কিশোর। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন দেখত, মানুষ একদিন এক কাতারে দাঁড়াবে, মানুষ বিজয়ী হবে। একটি কবিতায় ত্বকী লিখেছে, ‘যারা ধাবমান/ যারা পেছনেও নেতৃত্বে থাকে/ যারা ভয়ের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে/ তারা অপেক্ষায় আছে,/ তুমি ফিরে এসো,/ ফিরে এসো সেখান থেকে/ ফিরে এসো/ বাংলাদেশ আমার।’
আমরা জানি সেই বাংলাদেশ একদিন আসবে। ঘাতকের রক্তচোখ যতই ক্রূর হোক, তার চেহারা যতই ভয়ংকর আর বীভত্স হোক সে ভীত, সন্ত্রস্ত। অনিবার্য পরাজয়ের ভয় তাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তার আস্ফালন-চিত্কার মৃত্যুভয় তাড়াবারই ব্যর্থ প্রয়াস। ফাঁসির রজ্জু তার ঘিরে আছে চারপাশ। আমরা সেই বাংলাদেশেরই অপেক্ষায় আছি, যে বাংলাদেশ ঘাতকের নয়, মানুষের—অপরাজেয় মানুষের, ত্বকীদের।
রফিউর রাব্বি তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর বাবা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব