নভেম্বর যত এগিয়ে আসছে, আমি ততই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। আমার আমেরিকান বন্ধুরা বিভিন্ন মতামত জরিপের উল্লেখ করে ট্রাম্পের তুলনায় জো বাইডেনের এগিয়ে থাকার খবর দিচ্ছেন এবং বলছেন, মার্কিন জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে যথেষ্ট সক্ষম। কিন্তু একজন ব্রিটিশ নাগরিকের দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো পরিস্থিতি দেখে এবং আমি যে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে থাকি, সেই প্রতিষ্ঠানের গবেষণাচিত্র বিশ্লেষণ করে আমি উদ্বিগ্ন হতে বাধ্য হচ্ছি।
একজন ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে আমি চার বছর আগের ব্রেক্সিট ভোটের কথা স্মরণ করতে পারি। তখন গণভোটের আগে প্রায় সব জরিপেই দেখা গিয়েছিল ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের থাকাকেই ব্রিটিশরা সমর্থন করছে। কিন্তু গণভোটের ফল দেখা গিয়েছিল একেবারে উল্টো।
তুরস্ক, রাশিয়া, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডে কর্তৃত্ববাদী নেতারা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কীভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কারসাজির মাধ্যমে বিনষ্ট করে ফেলেছেন এবং একের পর এক কূটকৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছেন, তা নিয়ে যেসব পণ্ডিত গবেষণা করছেন, তাঁদের সঙ্গে একটি থিংকট্যাংকের পরিচালক হিসেবে আমার ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সেই সুবাদে আমি ধারণা করছি, ট্রাম্প এসব নেতার কৌশল আত্মস্থ করছেন এবং আগামী নির্বাচনে তিনি তাঁদের চেয়েও নোংরা পন্থা অবলম্বন করবেন।
ট্রাম্প প্রথম যে নোংরা পথটি বেছে নেবেন, সেটি হলো ইতিহাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা। এই অস্ত্র দিয়ে রক্ষণশীল এই নেতারা সমাজে বিভক্তি তৈরি করেন এবং সেই বিভক্তির মধ্য দিয়ে তাঁরা তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে সংহত করেন। নিজের ভোটার শিবিরকে শক্তপোক্ত করার জন্য কিছু ভোটারকে অপমান–অপদস্থ করতেও তাঁরা পিছপা হন না।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে প্রায়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ের কথা স্মরণ করতে দেখা যায়। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান একইভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের বিজয়মুখর অতীতের কথা বারবার বলেন। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান বারবার ঐতিহাসিক ট্রিয়ানোন চুক্তির উল্লেখ করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন প্যাক্স ব্রিটানিকার কথা বলেন। তাঁরা সবাই ইতিহাস টেনে পক্ষপাতমূলক ব্যাখ্যা দিতে থাকেন।
আরেকটি নোংরা পন্থা হলো ‘সত্য-উত্তর রাজনীতি’। এ পন্থায় এসব নেতা প্রোপাগান্ডা ভিডিও ছড়িয়ে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে তোলেন। বিশেষজ্ঞদের তুলে ধরা যেকোনো তথ্য–উপাত্তের সত্যতা তাঁরা সরাসরি নাকচ করে বক্তব্য দেন। অনেক ক্ষেত্রেই ভোটারদের পক্ষে তাঁদের যুক্তির গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
তৃতীয় কৌশল হলো নিজেই নিজের সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করা। ১৯৯০–এর দশকে তুরস্কের সরকারি ব্যবস্থা থেকে ‘ডিপ স্টেট’ কথাটির উদ্ভব হয়। এ অবস্থায় সরকারের অন্তরালে থাকা আরেকটি শক্তিকে খোদ সরকারের চেয়ে শক্তিশালী করে তোলা হয়। ট্রাম্প, এরদোয়ান, ওরবান, জনসন—এঁরা সবাই এই পথ বেছে নিয়েছেন। তাঁরা নিজ নিজ বাধ্যগত অনানুষ্ঠানিক গোষ্ঠীকে সরকারি কাজে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ করে দিচ্ছেন।
চতুর্থ কায়দাটি হলো বিরুদ্ধ মতের ভোটারদের দমিয়ে রাখা। কুর্দি ভোটারদের ক্ষমতাহীন করে রাখতে এরদোয়ান যেভাবে নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, ঠিক একইভাবে ট্রাম্প আফ্রিকান-আমেরিকান ভোটারদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটার যাতে ভোট দিতে না পারেন, সে জন্য তিনি ই-মেইল ভোটের বিরোধিতা করেছেন।
‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ শীর্ষক কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারভিত্তিক আন্দোলন হচ্ছে, সেটিকে কাজে লাগাতে চাইছেন ট্রাম্প। এ আন্দোলনকে শ্বেতাঙ্গবিরোধী হিসেবে তুলে ধরে শ্বেতাঙ্গদের মন বিষিয়ে তুলতে পারলে শ্বেতাঙ্গ ভোটাররা ট্রাম্পকে ভোট দেওয়াকে পবিত্র কর্তব্য বলে ভাববেন। এটি মাথায় রেখেই তিনি সাদা-কালোর মধ্যে ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টা করছেন।
এর বাইরে সম্প্রতি বেলারুশে যেভাবে প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো ভোট জালিয়াতি করেছেন, ট্রাম্প সে ধরনের মডেল বেছে নেবেন না, তা–ও জোর দিয়ে বলা যায় না।
এ অবস্থায় ট্রাম্পের সম্ভাব্য নোংরা কায়দা সম্পর্কে ভোটারদের ধারণা দেওয়াই ডেমোক্র্যাট শিবিরের প্রধান কাজ হওয়া উচিত।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
মার্ক লিওনার্ড: ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের পরিচালক