যে কারণে লকডাউন জারি রাখা জরুরি
সাধারণভাবে সবাই জানেন, কিংবা এত দিন ধরে আমাদের জানানো হয়েছে ‘সামাজিক দূরত্ব’ যা নিশ্চিত হবে ‘লকডাউন’-এর মধ্য দিয়ে, তার ভেতরেই কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রাণভোমরা নিহিত রয়েছে বলে মনে করা হয়েছে বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, যেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর ভরসা রাখার চেয়ে প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো এবং বিচ্ছিন্নকরণের মধ্য দিয়ে সংক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়াই হতে পারে দাওয়াই, সেখানে কেন লকডাউন শিথিল করার এই ঘোষণা, গ্রোথ কার্ভের যে বিন্দুতে সংক্রমণ স্থিতাবস্থায় আগায়, সেই বিন্দুতে পৌঁছানোর আগেই?
গত ৮ মার্চ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত প্রথম রোগীর ঘোষণার পর থেকে দেশি-বিদেশি বেশ কিছু পরিসংখ্যাননির্ভর অনুমিতি আমরা দেখেছি, যেখানে অনেক বড় সংখ্যার মৃত্যু ও সংক্রমণের আশঙ্কা করা হয়েছিল। ১৮ মার্চ প্রথম করোনাক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হলেও মার্চ মাসে সংক্রমণ ধীরগতির ছিল এবং এপ্রিল থেকে এর বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার যে পর্যায়ে ছিল, তা দেখে মনে হচ্ছিল যে প্রথম দিককার এসব পূর্বানুমান ধোপে টিকছে না। যদিও এসব সরকারি সংখ্যা নিয়ে অবিশ্বাস ছিলই জনমনে। ১৮ কোটির বেশি যে দেশের জনসংখ্যা সেখানে টেস্টের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মাত্র একটি হাসপাতালেই টেস্ট করার সুযোগ ছিল, ঢাকায়। ঢাকার বাইরে কোভিড-১৯–এর উপসর্গ নিয়ে অনেকেই মারা গেলেও তাঁরা দেশে লকডাউন থাকায় ঢাকায় আসতে পারেননি। বিনা টেস্টেই মারা গেছেন। অনেকেই সামাজিক লাঞ্ছনার ভয়ে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন কোভিড-১৯ লক্ষণ। সেসব মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি টেস্ট থেকে পাওয়া সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়নি গণনায়। তবু এসব অনিয়মকে বিবেচনায় নিয়েও, এপ্রিল পর্যন্ত যে সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল, তা থেকে ধারণা করা হচ্ছিল মে মাসের শেষ নাগাদ হয়তো স্থিতিবিন্দুতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
এপ্রিল মাস পর্যন্ত পাওয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কেবল বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার পাশ্চাত্যের দেশগুলোর তুলনায় দৃশ্যমানভাবে কম বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। শ্রীলঙ্কা ও ভুটান তো কোভিড-১৯ থেকে একরকম পরিত্রাণ পেয়েই গেছে। ভুটানে একজন এবং শ্রীলঙ্কায় সাতজনের মৃত্যুর খবর জানা যায়। এক পাকিস্তানকে বাদ দিলে বাংলাদেশ এবং ভারতের অবস্থাও আশঙ্কার চেয়ে কম মাত্রায় ছিল। ভারতে লকডাউন কার্যকর হয়েছে, পাকিস্তান লকডাউনে না যাওয়ার খেসারত দিয়েছে।
বাংলাদেশ ছিল মাঝামাঝি অবস্থানে। বাংলাদেশ ১৭ মার্চ থেকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে এবং ২৩ মার্চ থেকে প্রথমে সারা দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে এবং পরে এই ছুটি দুই দফায় বাড়ানো হয়েছে। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ পোশাকশিল্পের মালিক প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ তার শ্রমিকদের বেতন না দিয়েই সরকার–ঘোষিত প্রথম দেশব্যাপী ছুটি ৫ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ ঘোষণা করলে কয়েক লাখ শ্রমিক সারা দেশে নিজেদের গ্রামে, মহল্লায়, বাড়িতে ফিরে যান এক দফা। তাঁরা ফের ৪ ও ৫ এপ্রিল পায়ে হেঁটে ঢাকায় আসেন বেতন পাবেন আশায় এবং ছুটি ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানোর সরকারি ঘোষণা শুনে ফের পায়ে হেঁটে, ফেরিতে করে বাড়ি ফিরে যান। অনেকে ঢাকায় থেকে যান।
এই ছুটির মধ্যেই অন্তত বড় দুটি ধর্মীয় সমাবেশ দেখা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, যেখানে প্রায় লাখো মানুষের জমায়েত হয়েছে এবং লকডাউনের একটা বড় অংশজুড়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। ফলে লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। তবু এই লকডাউনের সময়টুকুতে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হারের গ্রোথকার্ভ থেকে দেখা যাচ্ছে, স্থিতিবিন্দুর সম্ভাব্য সময়, মৃত্যু এবং সংক্রমণের সংখ্যা। বেলজিয়ান গণিতবিদ পিয়েরে ফ্রাঁসোয়া ভেরহালটস প্রদত্ত লজিস্টিক মডেল সমীকরণ ব্যবহার করে এই করোনাজনিত মৃত্যু ও সংক্রমণের হার নির্ণয় করা হয়েছে। ( “Our World in Data (<https://ourworldindata.org/coronavirus-source-data)> থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।)
চিত্র ১:
চিত্র ২:
চিত্র ৩:
চিত্র ১ ও ২ থেকে যথাক্রমে করোনাজনিত অনুমিত মোট মৃত্যুসংখ্যা ও মোট সংক্রমণসংখ্যা দেখা যাচ্ছে ১৮১ ও ৬ হাজার ৮২৭। চিত্র ৩ থেকে পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের স্থিতিবিন্দু যথাক্রমে ৬০ দিন, ৮০ দিন ও ১০০ দিন—যদি লকডাউন বহাল থাকে।
কিন্তু, ইতিমধ্যে দুটি ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথমত, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পোশাক কারখানা খুলে গেছে। পোশাকশ্রমিকেরা যেমন করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হচ্ছেন, তেমনি যেসব এলাকায় তাঁদের বসবাস, সেসব এলাকাতেও সংক্রমণ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বলা হচ্ছে, সংক্রমণ এখন কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে টেস্ট সেন্টার বাড়ানো হয়েছে। যত বেশি টেস্ট, তত বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। ফলে পরিচিত গ্রোথ কার্ভের প্রবণতাটিও পাল্টে যাচ্ছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পাওয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে করা গ্রোথ কার্ভের স্থিতিবিন্দুর সঙ্গে ২ মে পর্যন্ত নেওয়া উপাত্ত নিয়ে করা গ্রোথ কার্ভে সংক্রমণ স্থিতিশীল হওয়ার সময়, মৃত্যু ও সংক্রমণের হার ভিন্নপথে প্রবাহিত হচ্ছে।
চিত্র ৪:
চিত্র ৫:
চিত্র ৬:
চিত্র ৪ ও ৫ থেকে দেখা যাচ্ছে, ১ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত প্রাপ্ত উপাত্ত আগের মডেল থেকে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। মোট অনুমিত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯০ এবং সংক্রমণের সংখ্যা ৯ হাজার ৯২৬। চিত্র ৬ থেকে দেখা যাচ্ছে, অনুমিত স্থিতিবিন্দু যেখানে ছিল ৬০ দিন, সেখানে মাত্র ৬ দিনের ব্যবধানে প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে করা মডেলে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ ৭০ থেকে ৭৫ দিন, ভারত ৮৫ দিন এবং পাকিস্তান আগের অবস্থানে ১০০ দিন। এখানেও শর্ত থাকে যে যদি লকডাউন যেমন ছিল, তেমন করে বহাল থাকে।
কিন্তু লকডাউন বহাল থাকেনি সব সেক্টরে। ২৫ এপ্রিল পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে, অন্য কিছু ক্ষেত্রেও শৈথিল্য দেখা গেছে এবং টেস্টের সংখ্যাও হঠাৎই বেড়েছে। যত বেশি টেস্ট, তত বেশি সংক্রমণসংখ্যা। ফলে আজ সংক্রমণের সংখ্যা ১০ হাজার পেরিয়েছে, যা ২ মে পর্যন্ত উপাত্ত নিয়ে করা গ্রোথ কার্ভের অনুমিত স্থিতিবিন্দুতে সম্ভাব্য সংক্রমণের চেয়ে বেশি এবং মৃতের সংখ্যা ১৯০, যা সংক্রমণ শেষে সম্ভাব্য মৃতের সংখ্যার সমান। সবচেয়ে মারাত্মক হলো অনুমিত স্থিতিবিন্দু ৬০ দিনের মাথায় হওয়ার কথা ছিল, যা এখন ৭৫ দিনে গড়িয়েছে। সংক্রমণ এই হারে বাড়তে থাকলে স্থিতিবিন্দু কত দিনে গিয়ে ঠেকবে, অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়েছে, একই সঙ্গে মৃত্যুহার। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দোকানপাট খুলে দেওয়ার ঘোষণা অত্যন্ত বিপজ্জনক। নিশ্চয়ই এই ঘোষণা তুলে নেওয়া হবে বলে আশাবাদী হতে চাই, একই সঙ্গে পুরো মে মাসে সব সেক্টরে লকডাউনের ঘোষণা দেবেন অনেক বড় ক্ষতি এড়ানোর জন্য, সেই দাবি জানাই।
কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাস্থ্য যোগাযোগ তাঁর অন্যতম গবেষণাক্ষেত্র।