রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভেবেছিলেন, তিনি দ্রুত কিয়েভ দখল করে এবং ইউক্রেনের সরকারকে ফেলে দিয়ে সেখানে তাঁর আজ্ঞাবহ একটি সরকার বসিয়ে ভালোয় ভালোয় ফিরে আসবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পুতিন হয় তাঁর নিজের দুর্বল বুদ্ধিমত্তার দ্বারা, নয়তো ইতিহাস সম্পর্কে নিজের স্মরণশক্তির অভাব দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছেন। ইউক্রেনবাসীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে তাঁর প্রথম নেওয়া ‘গুঁড়িয়ে দিয়ে মুঠোয় পোরো’ ধরনের সমর কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। এই কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি বেসামরিক জনগণকে তাঁর আনুগত্য মেনে নিতে তাঁদের আতঙ্কিত করার কৌশল নিলেন। এর অংশ হিসেবে তিনি মারিউপোল এবং খারকিভের মতো শহরগুলোতে নৃশংসভাবে বোমাবর্ষণ শুরু করলেন। ঠিক এই একই কায়দা তিনি ইতিপূর্বে গ্রোজনি এবং আলেপ্পোতে অনুসরণ করেছিলেন। তবে দুঃখজনক ফলাফল হলো, এই কয় দিনে ইউক্রেনের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেসামরিক লোকের দুর্ভোগও তেমন বেড়েছে।
প্রশ্ন হলো, এই দুঃস্বপ্ন থেকে দ্রুত মুক্তির কি কোনো উপায় আছে? এই মুহূর্তে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সামনে একটি ‘রুজভেল্ট মুহূর্ত’ আছে। চাইলে তিনি সেই মুহূর্তটিকে কাজে খাটাতে পারেন। ১৯০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে নৃশংস যুদ্ধের পর, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট মধ্যস্থতায় এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি উভয় পক্ষকে আপস করার জন্য কঠোর চাপ দেন এবং শেষ পর্যন্ত তাদের সমঝোতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন। এর ফলে আমেরিকার বৈশ্বিক প্রভাব অনেক বেড়ে যায় এবং রুজভেল্ট নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতে নেন।
এ মুহূর্তে তুরস্ক, ইসরায়েল ও ফ্রান্স ইউক্রেন যুদ্ধে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু মিত্রদের মধ্যে সি চিন পিং যতখানি পুতিনের ওপর জোর খাটাতে পারেন, তা অন্যদের খাটানোর সামর্থ্য নেই। তবে সি চিন পিংয়ের মনে সে ধরনের কোনো ভাবনা আসবে কি না এবং সে অনুযায়ী উদ্যোগ নেওয়ার সাহস তাঁর আছে কি না, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে এ প্রশ্নের উত্তর হলো ‘না’।
যদিও চীন দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার নীতির রক্ষক হিসেবে চিত্রিত করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বেইজিং পুতিনের জাতিসংঘ সনদের নির্লজ্জ লঙ্ঘনকে সহ্য করছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা প্রস্তাবে ভোট হলে চীন সেখানে ভোটদানে বিরত ছিল। চীন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছে। যদিও ন্যাটো বারবার বলে আসছে ইউক্রেনকে সদস্য করা হবে না, কিন্তু রাশিয়া অভিযোগ করে আসছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ন্যাটোতে সংযুক্ত করে ন্যাটোকে সম্প্রসারিত করতে চায়। রাশিয়ার বক্তব্য হলো, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা মস্কোর নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আর সেই হুমকি থেকেই মস্কো ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে। রাশিয়ার এই বক্তব্য চীন তোতাপাখির মতো আওড়ে যাচ্ছে।
রাশিয়ার সমালোচনা করতে চীনের অনিচ্ছা তাকে কূটনৈতিক সাইডলাইনে বসিয়ে রেখেছে। বেইজিংয়ের এই অবস্থান তার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারছে না। যদিও চীনের সংবাদমাধ্যমে এই যুদ্ধসংক্রান্ত খবরকে তথ্য কর্মকর্তারা অনেক যাচাই–বাছাই করে নিয়ন্ত্রিত আকারে প্রকাশ করার অনুমতি দিচ্ছেন, তারপরও এই যুদ্ধ নিয়ে চীনের বর্তমান কূটনৈতিক অবস্থান তার জাতীয় স্বার্থের জন্য কতটুকু কাজ করছে, তা নিয়ে বেইজিংয়ে কেউ কেউ প্রকাশ্যে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। উদাহরণস্বরূপ, বেইজিংয়ের সেন্টার ফর চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের প্রেসিডেন্ট ওয়াং হুইয়াও পরামর্শ দিয়েছেন, পুতিনকে বিপর্যয়কর ইউক্রেন নীতি থেকে সরিয়ে আনতে চীনের মধ্যস্থতা করা উচিত।
চীনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হওয়ায় ক্ষমতাসীন দল তার শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করছে। ক্রমবর্ধমানভাবে তারা জাতীয়তানির্ভর হয়ে পড়ছে। এ কারণেই চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম এবং জাতীয়তাবাদী ওয়েবসাইটগুলো পুতিনের দাবির পুনরাবৃত্তি করছে। রাশিয়ার সুরে সুর মিলিয়ে তারাও বলছে, ইউক্রেন পশ্চিমের হাতের পুতুল হয়ে গেছে। তারা বলছে, রাশিয়া ও চীন উভয়ের প্রতি আমেরিকার উত্পীড়নমূলক আচরণের জবাবে রাশিয়া লড়াই করে যাচ্ছে।
এ ধরনের মধ্যস্থতা করায় চীনের স্বার্থ কতটুকু থাকতে পারে? আছে, স্বার্থ আছে। চীন নিজেকে প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার অধিকারকে সমর্থন দেয়—বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতিবেশীদের কাছে বেইজিং প্রায়ই এ দাবি করে থাকে। কিন্তু ইউক্রেন সংকট নিয়ে চীনের বর্তমান অবস্থান তার সেই সার্বভৌমত্বের রক্ষক হওয়ার দাবিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
অন্যদিকে, ইউরোপকে সমীহ করতে বাধ্য করার যে ‘সফট পাওয়ার’ বা অন্তস্থ শক্তি চীনের রয়েছে, এ যুদ্ধে তার নিরপেক্ষ অবস্থান সেই সফট পাওয়ারকে ভোঁতা করে দিচ্ছে। ইউরোপে রাশিয়ার তুলনায় চীনের বাণিজ্য পাঁচ গুণ বেশি। ফলে ইউরোপে বেইজিংয়ের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন ইস্যুতে চীন চুপচাপ থাকায় ইউরোপের সমীহ কমতে পারে বলে ধারণা করা যায়। এ যুদ্ধ চীনের তেল ও শস্য আমদানির খরচও বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনে গত বছরের মতো এ বছরও যদি ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, তাহলে শস্য আমদানিতে তাদের আরও বেশি খরচ পড়বে।
যুদ্ধ যত তীব্র হবে, পশ্চিমা অবরোধ তত বাড়বে। পরবর্তী দফার নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপ করার পর তার আঁচ চীনের গায়েও এসে পড়বে। চীন যদি পুতিনের মুখ রক্ষা নিশ্চিত করে ইউক্রেন ইস্যুতে একটি সমঝোতার অবস্থা তৈরি করতে পারে, তাহলে তা যুদ্ধের অন্যান্য বিপদের আশঙ্কা কমিয়ে দেবে। এটি করতে পারলে তা চীনের ওপর রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান নির্ভরতাকে আরও গভীর করবে এবং চীনের নিজস্ব বৈশ্বিক ভাবমূর্তি ও অবস্থানকে বাড়িয়ে তুলবে। এমনকি সি চিন পিং হয়তো নোবেল শান্তি পুরস্কারও জিততে পারেন।
এটি অবশ্যই ঠিক, এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিতে গেলে তার জন্য মূল্য দিতে হয়। সতর্ক চীনা কূটনীতিকেরা ইউক্রেনের যুদ্ধকে নিশ্চিতভাবে পশ্চিমাদের ভেতরের সংঘাত হিসেবে দেখছেন। যদি এ যুদ্ধ চলতে থাকে তাহলে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মতো পুরোনো পরাশক্তিদের শক্তি ক্ষয় হবে এবং তাদের সংঘাতের আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে চীন লাভবান হতে পারে। এমন একটি ভাবনা থেকেও চীন যুদ্ধটি থামানোর বিষয়ে আন্তরিক না–ও হতে পারে।
এ যুদ্ধ যদিও–বা চীনের একটি মিত্রকে দুর্বল করছে, তারপরও এটি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে পরিবর্তিত করছে। এটি চীনের জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতিই তৈরি করছে। এ যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর এশিয়ার বিষয়ে কথা বলতে পারছে না। এশিয়ায় চীনের তৎপরতা নিয়ে কথা বলার ফুরসতই যুক্তরাষ্ট্র পাচ্ছে না। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মহামন্দার পর চীনা নেতারা এ উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের পতন ঘটতে চলছে এবং এটি তাঁদের অনুসৃত দেং জিয়াওপিংয়ের ‘ধৈর্যশীল এবং সতর্ক বৈদেশিক নীতি’কে ত্যাগ করতে প্ররোচিত করেছিল।
সি চিন পিংয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে প্রাথমিক বাধা অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া ছাড়া চীনের মিত্রের সত্যিকার অর্থেই অভাব রয়েছে। সি এবং পুতিন ব্যক্তিগত একটি সম্পর্ক তৈরি করেছেন, যা আগে থেকে বিদ্যমান থাকা বন্ধুত্বকে আরও শক্তিশালী করেছে। তবে রুজভেল্টিয়ান পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চীনা নেতৃত্বকে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে। আমার একজন চীনা বন্ধু সম্প্রতি আমাকে বলেছেন, সি চিন পিং নতুন মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। এ কারণে তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা।
চীনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হওয়ায় ক্ষমতাসীন দল তার শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করছে। ক্রমবর্ধমানভাবে তারা জাতীয়তানির্ভর হয়ে পড়ছে। এ কারণেই চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম এবং জাতীয়তাবাদী ওয়েবসাইটগুলো পুতিনের দাবির পুনরাবৃত্তি করছে। রাশিয়ার সুরে সুর মিলিয়ে তারাও বলছে, ইউক্রেন পশ্চিমের হাতের পুতুল হয়ে গেছে। তারা বলছে, রাশিয়া ও চীন উভয়ের প্রতি আমেরিকার উত্পীড়নমূলক আচরণের জবাবে রাশিয়া লড়াই করে যাচ্ছে।
রাশিয়ার এ যুদ্ধের সমর্থনে সি চিন পিং মূলত তাঁর সরকারের জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তিকেই প্রচার করেছেন। তিনি সে কারণে ইউক্রেন ইস্যুতে সরাসরি ঢুকতে চাইছেন না। তবে সি চিন পিং এখনো তাঁর ‘টেডি রুজভেল্ট’ সুযোগটি ব্যবহার করে ইউক্রেন সংকটে গতিশীল পরিবর্তন আনতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যাচ্ছে।
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● জোসেফ এস নাই জুনিয়র হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক