জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি অনেক গভীরে প্রথিত। ব্রিটিশ বাংলার সঙ্গে জাপানের মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় যাঁর অবদানের কথা সর্বাগ্রে স্মরণ করা হয়, তিনি হলেন জাপানি চিন্তাবিদ, সমাজ গবেষক ও শিল্পচর্চায় নিবেদিত অগ্রপথিক তেনশিন ওকাকুরা। ভারত সফরে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ওকাকুরা এসেছিলেন এবং ১৯১৩ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দূরে থেকে হলেও রবীন্দ্র সাহচর্য তিনি বজায় রেখেছিলেন। ওকাকুরা স্বপ্ন দেখেছিলেন চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যে অতীতের সমৃদ্ধ ইতিহাসের আলোকে ঘনিষ্ঠ মৈত্রী গড়ে তোলার। তবে আমরা জানি, ইতিহাসের ধারা পরবর্তী সময়ে সেই পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও এশিয়ার প্রাচীন তিন সভ্যতার মধ্যে যে মেলবন্ধন, যুগ যুগ ধরে ধরে তা তিনটি দেশের অগ্রসর অনেক ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে গেছে।
বাংলাদেশ যেহেতু সেই প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত এক ভৌগোলিক সত্তা, জাপানে অনেকেই তাই মাত্র পাঁচ দশক আগে বিশ্ব মানচিত্রে নিজের স্বতন্ত্র জায়গা করে নেওয়া দেশটি নিয়ে উৎসাহী। বাংলার এই ভূখণ্ডকে ঘিরে নতুন করে দেখা দেওয়া উৎসাহের সূচনা গাথা আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকদের চালানো গণহত্যা এবং হানাদারদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আমাদের মুক্তির সংগ্রাম অতীত সেই সম্পর্কের আলোকেই খুব সহজে জাপানের মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। রাষ্ট্র হিসেবে জাপান বাংলার মানুষের সেদিনের স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সোচ্চার হয়ে না উঠলেও জাপানের জনমত সেই ঘাটতি নানাভাবে পূরণ করে দিতে পেরেছে।
১৯৭০-এর দশকের সূচনালগ্নে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তেমন বলিষ্ঠ ভূমিকা জাপানের ছিল না। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শিবিরে দেশটির দৃঢ় অবস্থান ভিন্ন ভূমিকা পালনের সুযোগ টোকিওর জন্য করে দেয়নি। তবে তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রশ্নে ভিন্ন এক জাপানের দেখা আমরা পাই, যে জাপান হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের পরিচিত ছক থেকে বের হয়ে আসা দেশ। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে যে দেশটি আজও দাঁড়িয়ে আমাদের পাশে।
১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে জাপান সরকার প্রকাশ্যে আমাদের সমর্থনে এগিয়ে না এলেও দেশটির নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক। বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের পক্ষ অবলম্বনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার আহ্বান নিজের দেশের সরকারের প্রতি তাঁরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় থেকেই জানিয়ে আসছিলেন। তাঁদের সেই দৃঢ় অবস্থানের কারণেই, টোকিওর পাকিস্তান দূতাবাসের দলত্যাগী বাংলাভাষী কূটনীতিকেরা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যাতে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন, সেই চেষ্টা জাপান সরকার সেই দিনগুলোতেও পরোক্ষভাবে করে গেছেন। আর সেই পথ ধরে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার দুই মাসের কম সময়ে(১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২) স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। জাপানের সেই স্বীকৃতি সেদিন আমাদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কেননা সেই স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বৈরী সেই সময়ে নানা রকম অপপ্রচারের মুখে আত্মপ্রত্যয়ী হতে আমাদের সাহায্য করেছিল। পাশাপাশি জাপানের সেই স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে সূচিত হয়েছিল নতুন এক মৈত্রীর বন্ধনের, গত অর্ধশতকে যে বন্ধন এখন আরও অনেক দৃঢ় হয়ে উঠেছে। সময়ের আবর্তে জাপান পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথযাত্রার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এক অংশীদারে।
বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে দায়িত্ব পালনের সুযোগ তাঁর হলেও উন্নয়নযাত্রার এক ব্যতিক্রমী অংশীদার হিসেবে কেবল বাংলাদেশ তাঁর হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি যে দুই দেশের মধ্যে মৈত্রীর ভাবাদর্শের ভিত্তি গড়ে তোলা এই পারস্পরিক বোধগম্য ভবিষ্যতেও চলার পথের সঙ্গী হিসেবে জাপানকে পাশে পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের জন্য করে দেবে। পাঁচ দশক ধরে পাশাপাশি অবস্থান করার মধ্য দিয়ে জাপান এখন আমাদের সবচেয়ে পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্রের একটি হিসেবে স্বীকৃত। আগামীতেও জাপান আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে এবং এ কারণেই জাপানের কাছ থেকে আরও অনেক অভাবনীয় প্রাপ্তি বাংলাদেশ ভবিষ্যতেও সহজেই প্রত্যাশা করতে পারে।
জাপান হচ্ছে বাংলাদেশকে প্রথম দিকে স্বীকৃতি দেওয়া অগ্রসর বিশ্বের প্রধান রাষ্ট্রগুলোর একটি। জাপান কিন্তু সেদিন স্বীকৃতি দিয়েই বসে থাকেনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে দ্রুত নিজস্ব দূতাবাস চালুর পদক্ষেপও টোকিও একই সঙ্গে নিয়েছিল। পাশাপাশি জাপানের জনগণের একটি অংশও সেই সূচনার দিনগুলো থেকে চেষ্টা করে গেছে বাংলাদেশকে নানাভাবে সাহায্য করতে এবং আমাদের মৈত্রীর বন্ধনকে দৃঢ় এক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে।
মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় বিজয় জাপানের জনগণের কাছে বাংলাদেশের নতুন এক পরিচয় তুলে ধরে। এর ফলে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর সাধারণ জনগণের পাশাপাশি জাপানের নেতৃস্থানীয় অনেক বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকও নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের দিকে আলোকপাত করতে শুরু করেন। যুদ্ধকালে জাপানে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলায় সক্রিয় অবদান যাঁরা রেখেছিলেন, সেই দলে ক্ষমতাসীন দলের তৎকালীন সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী তাকাশি হায়াকাওয়া এবং অধ্যাপক ৎসুইয়োশি নারার মতো ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি আরও ছিলেন মাঠপর্যায়ের অনেক তরুণ কর্মী। বাংলাদেশের দুর্দশার পাশাপাশি দেশটির সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের প্রতিরোধযুদ্ধ যাঁদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ভিন্ন অবস্থানের বেশ কিছু জাপানি নাগরিক নতুন দেশের প্রতি মমতা ও ভালোবাসা অনুভব করে সূচনার সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। সেই তালিকায় সর্বাগ্রে যাঁর নাম উল্লেখ করতে হয়, তিনি হলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক নাগিসা ওশিমা। ১৯৭২ সালের শীতে ওশিমা বাংলাদেশে এসেছিলেন নতুন দেশের নেতাকে নিয়ে একটি প্রামাণ্য ছবি তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে। তাঁর সেই অসাধারণ সৃষ্টির প্রতি এখনো অবাক হয়ে তাকাতে হয়। কেননা জাপান থেকে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাটির সম্পর্কের খোঁজ পেতে খুব বেশি সময়ের দরকার তাঁর হয়নি। ফলে ওশিমা যখন তাঁর সেই ছবির একটি অংশে বলেন, ‘বিশ্বের কোনো সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান এতটা সাধারণ জীবন যাপন করছেন, তার দ্বিতীয় প্রমাণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল’; আমরা তখন বিস্ময় নিয়ে ভাবি, আমরা নিজেরা বুঝতে না পারলেও একজন বিদেশি কীভাবে এত সহজে এটা ধরে নিতে পারলেন। কেবল ধরে নেওয়াই নয়, প্রমাণ হিসেবে মন্তব্যের সঙ্গে যে ফুটেজ ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে আমরা দেখি সপরিবার বঙ্গবন্ধু সকালের নাশতার টেবিলে বসা এবং সামান্য রুটি, ভাজি আর অল্প আরও কয়েকটি পদে পরিবার সেরে নিচ্ছে প্রাতরাশ। বঙ্গবন্ধুর জীবনের এসব সাদামাটা অংশ জাপানিদের মুগ্ধ করেছিল এবং তাঁদের অনেকেই এটাকে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখেছিলেন।
অনেকটা একই ধরনের ভিন্ন এক মন্তব্যের দেখা আমরা পাই প্রথম জাপানি সাংবাদিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নিতে আসা ফুমিও মাৎসুওর পাঠানো প্রতিবেদনে। জাপানি বার্তা সংস্থা কিওদো নিউজের সেই সময়ের ব্যাংকক ব্যুরোপ্রধান মাৎসুও বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৭২ সালের মে মাসে। পুরোনো গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে বিরল যে দৃশ্যের দেখা তিনি পেয়েছিলেন, তা হলো ভবনের বাইরে অতি সাধারণ লোকজন বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ লাভের আশায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে এবং বঙ্গবন্ধু তাঁদের কাউকে নিরাশ করছেন না। ফলে যে মন্তব্য মাৎসুও সেদিন তাঁর লেখায় করেছিলেন, তা হলো বিশ্বের অনেক দেশই আজকাল গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে নিজেদের পরিচয় বিশ্বের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করে গেলেও বাংলাদেশ মনে হয় এ কারণে সেই তালিকার এক ব্যতিক্রমী সংযোজন। গণপ্রজাতন্ত্র সেখানে কেবল ফাইলপত্রে আবদ্ধ নেই; বরং রাষ্ট্রনায়ক নিজে অতি সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে চলেছেন যে নামের সঙ্গে দেশটির অমিল একেবারেই নেই।
বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের পাঁচ দশকের মৈত্রীর বন্ধনের ভিত ওশিমা এবং মাৎসুওর মতো আরও অনেকেই তৈরি করে দিয়েছেন। সেই দলে যেমন আছেন আমলা ও রাজনীতিক, একইভাবে সেখানে দেখা মেলে একেবারে মাঠপর্যায়ে কাজ করা জাপানি তরুণদের। শেষোক্ত এই দলের একজন হলেন বর্তমানে বার্ধক্যে উপনীত অধ্যাপক মাসাআকি ওহাশি, আজও যিনি সক্রিয় জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায়। সেই দলে আরও আছেন ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত জাপান-বাংলাদেশ সমিতির নেতারা, যাঁদের মধ্যে অনেকেই অতীতে একসময় বাংলাদেশে কাজ করে গেছেন জাপানের রাষ্ট্রদূত কিংবা জাপানের কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান অথবা জাইকা কিংবা জেট্রোর মতো সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানে। বাংলাদেশে কাটানো সময়কে তাঁরা দেখছেন নিজেদের জন্য শিক্ষণীয় এক সময় হিসেবে, তুলনামূলক নতুন একটি দেশের যে অগ্রযাত্রা, সেটা তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছে।
১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক তাকেও ইগুচি যেমন এই প্রতিবেদকের কাছে করা মন্তব্যে বলেছিলেন, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে দায়িত্ব পালনের সুযোগ তাঁর হলেও উন্নয়নযাত্রার এক ব্যতিক্রমী অংশীদার হিসেবে কেবল বাংলাদেশ তাঁর হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি যে দুই দেশের মধ্যে মৈত্রীর ভাবাদর্শের ভিত্তি গড়ে তোলা এই পারস্পরিক বোধগম্য ভবিষ্যতেও চলার পথের সঙ্গী হিসেবে জাপানকে পাশে পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের জন্য করে দেবে। পাঁচ দশক ধরে পাশাপাশি অবস্থান করার মধ্য দিয়ে জাপান এখন আমাদের সবচেয়ে পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্রের একটি হিসেবে স্বীকৃত। আগামীতেও জাপান আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে এবং এ কারণেই জাপানের কাছ থেকে আরও অনেক অভাবনীয় প্রাপ্তি বাংলাদেশ ভবিষ্যতেও সহজেই প্রত্যাশা করতে পারে।
• মনজুরুল হক জাপানপ্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক